বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
জালাল উদ্দিন ওমর : জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি বিশ^জুড়ে আজ আলোচিত বিষয়। এদেশেও যেমন প্রতিদিন জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। এভাবে দেশ থেকে দেশান্তরে, বিশ^জুড়ে প্রতিদিন জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি নির্মূলের কথা বলা হচ্ছে এবং একে বিশ^শান্তির জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করা ইসলামী স্টেটের (আইএস) লোকেরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ভাষায় জঙ্গি এবং এদের তৎপরতা জঙ্গিবাদ। পাশাপাশি লিবিয়া, ইয়েমেনে আইএসের তৎপরতাও জঙ্গিবাদ। এদেরকে নির্মূলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আইএস যোদ্ধাদের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে। আফগানিস্তানে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইরত তালেবানরা দীর্ঘদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের কাছে জঙ্গি এবং এদের কর্মকা- জঙ্গিবাদ নামে অভিহিত। নাইজেরিয়ায় বোকো হারামও যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের কাছে জঙ্গি এবং এদের কর্মকা- জঙ্গিবাদ নামে অভিহিত। বোকো হারামের বিরুদ্ধে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালাচ্ছে। সোমালিয়ার আল শাবাব গোষ্ঠীও পশ্চিমাদের ভাষায় জঙ্গি সংগঠন এবং এদের কর্মকা-ও জঙ্গি তৎপরতা। আল শাবাব গোষ্ঠীকে নির্মূলের জন্যও সেখানে যুদ্ধ চলছে। জঙ্গি দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের ওয়াজিরস্তানে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। আল কায়েদা নেতা মরহুম ওসামা বিন লাদেন পশ্চিমাদের ভাষায় সবচেয়ে বড় জঙ্গি, তার সংগঠন আল কায়েদা সবচেয়ে বড় জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের তৎপরতা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি তৎপরতা। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে এবং তার লাশ সাগরে ফেলে দিয়েছে। এখানে শেষ নয়, জঙ্গি নির্মূলের জন্য প্রতিনিয়ত দেশে দেশে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে এটা নিশ্চিত যে, জঙ্গি নির্মূলের এই অভিযান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং এটা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনাও আরো বহুদিন অব্যাহত থাকবে।
জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি নিয়ে বিশ^জুড়ে যখন আলোচনা, সমালোচনা এবং আতঙ্ক, তখন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এই ইস্যুতে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। আইএসের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনকে রুখতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কঠোর পন্থা নেওয়ার ফলে জঙ্গিবাদ আরো বেড়ে গেছে।’ গত ১৫ জানুয়ারি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশে^র দেশগুলোর প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে তিনি একটি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। বান কি মুন প্রতিটি রাষ্ট্রকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে একটি জাতীয় পরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আইএস বা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি মোকাবেলায় এখন সংকীর্ণ পরিসরে কেবল সামরিক এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এদের মোকাবেলা করতে হলে এসব পন্থার বাইরে এসে পরিকল্পনা করতে হবে।’ তিনি বলেন- ‘অপরিকল্পিত নীতি, ব্যর্থ নেতৃত্ব, কঠোর পন্থা এবং কেবল বল প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূলের চেষ্টা হয়েছে। উপেক্ষিত হয়েছে মানবাধিকার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব পন্থা নেওয়ার ফলে জঙ্গিবাদ বরং বেড়েই গেছে।’ তিনি বলেন, ‘ভুল নীতির ফলে আমরা নিষ্ঠুর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে হেরে চলছি। এ ধরনের নীতি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কোণঠাসা হওয়া মানুষ আরো দিন দিন কোণঠাসা হচ্ছে। ফলে শত্রুর হাতই কেবল শক্তিশালী হচ্ছে। আমাদের মাথা ঠা-া রাখতে হবে এবং সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের একপেশে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রায়ই বিরোধী পক্ষ, সুশীল সমাজের সংগঠনও মানবাধিকার কর্মীদের কর্মকা-কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। কারো মুখ বন্ধ করতে বা কাউকে বাধা দিতে কোন সরকারেরই এ ধরনের আচরণ করা উচিত নয়। জঙ্গিবাদ সবসময় এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। আমরা যেন সেই ফাঁদে পা না দিই। জঙ্গিবাদের হুমকি মোকবেলায় আইনগত অধিকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রয়েছে। তবে এই সন্ত্রাসবাদের কারণ নির্ণয়ে ও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।’ তিনি জঙ্গিবাদ নির্মূলে ৭৯ দফা সুপারিশ পেশ করেন। এর মধ্যে প্রধানতম হলো যেসব মানুষ ইতোমধ্যে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে, তাদেরকে শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ দিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। বান কি মুন মানবাধিকার ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার প্রসারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, এর ফলে আইএস বা বোকো হারামের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো তরুণদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা বন্ধ করবে। বান কি মুনের এই বক্তব্যের পর জঙ্গিবাদের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আর নতুন কিছু বলার দরকার নেই।
অন্যান্য দেশের মতো আামদের দেশেও জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদ বেশ আলোচিত বিষয়। আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তারা বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী করছেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে জঙ্গিদের নেত্রী হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। এমনও বলা হচ্ছে যে, বিএনপি নেত্রীর সাথে কোনো সংলাপ হবে না, কারণ তিনি জঙ্গিদের নেত্রী। দেশে এখন কোনো অঘটন ঘটলেই তদন্তের আগে জঙ্গিদেরকে দায়ী করা হচ্ছে। আবার আইএসও এর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিচ্ছে। আমরা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে জঙ্গি, জঙ্গিবাদ এবং এ সম্পর্কে করণীয় নিয়ে জানতে চাই। আর সবকিছুর জন্য জঙ্গিদের দায়ী করার প্রবণতা প্রকৃত দোষীদের যেমন আড়াল করবে, ঠিক তেমনি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বারবার জঙ্গি সম্পর্কে কথা বলা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করবে। আর এটা দেশের জন্য কোনো ধরনের সুফল বয়ে আনবে না। সুতরাং সর্বত্রই জঙ্গি খোঁজার প্রবণতা বাদ দিতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে জঙ্গিদেরকে নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর কেনই বা এই জঙ্গিবাদের উদ্ভব হচ্ছে, তার অনুসন্ধান করতে হবে। জঙ্গিদের অবস্থান যতটুকু তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণাও ততটুকু করতে হবে। একইভাবে কোন ঘটনার জন্য জঙ্গিরা যতটুকু দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও ততটুকু নিতে হবে। তা না করে যদি সবকিছুর জন্য ঢালাওভাবে মন্তব্য করা হয়, তাহলে এই সুযোগে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার মাধ্যমে জঙ্গিরা বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জেএমবির প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান ও তার সহযোগী ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ সংগঠনটির অধিকাংশ নেতাই গ্রেফতার হয়। একইভাবে গ্রেফতার হয় হুজির প্রধান মুফতি আব্দুল হান্নানসহ অনেকে। পরে বিচারে শায়খ আব্দুর রহমান, তার ভাই আতাউর রহমান সানি, মেয়ের জামাতা আব্দুল আউআল এবং ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি হয় এবং তা কার্যকর করা হয়। অপরদিকে অনেক নেতাকর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- হয় এবং তারা এখন কারাগারে বন্দি। এভাবে জঙ্গি সংগঠনসমূহ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তারা দুর্বল হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কার হওয়ায় এবং অস্ত্রসহ জঙ্গি আটক হওয়ায় প্রমাণিত হয় এরা এখনো সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়নি। সুতরাং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জঙ্গি তৎপরতাকে নির্মূল করতে হবে।
রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার আর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হচ্ছেন রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং মুখপাত্র। সুতরাং তাদের যে কোনো বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাতে রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করে। একইভাবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যে কোনো কথাই দেশে-বিদেশে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় এবং তা সত্য বলেই গৃহীত হয়। বিভিন্ন পক্ষের জঙ্গিবাদ নিয়ে কিছু অতিরিক্ত কথায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি জঙ্গি কবলিত দেশ হিসেবেই পরিচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ব্যাপকভাবে বিনষ্ঠ হচ্ছে এবং এতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ইতোমধ্যে আমরা এর কিছু নমুনাও দেখতে পাচ্ছি। গত ২১ জানুয়ারি দেশের সকল পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় সিঙ্গাপুর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২৬ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠিয়েছে। ওরা সবাই সিঙ্গাপুরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করত। খবরে বলা হয়, জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশীকে আটক করে সিঙ্গাপুর সরকার। দেশটিতে তারা নির্মাণকর্মী হিসাবে কাজ করত। আটককৃতদের মধ্যে ২৬ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি একজন সিঙ্গাপুরের কারাগারে রয়েছেন। আমি এ ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি এবং এসব বাংলাদেশি বিদেশে জঙ্গিবাদে লিপ্ত হলে তার জন্য কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। কারণ এ ধরনের ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশীদের শ্রম বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সরাসরি আঘাত করবে। পাশাপাশি এসব শ্রমিককে জঙ্গি বানিয়ে এবং জঙ্গিবাদকে ইস্যু বানিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধ্বংসের জন্য কোনো পক্ষ কাজ করছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ লক্ষ বাংলাদেশী কাজ করে। তাদের প্রেরিত টাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল এবং উন্নত করেছে। এসব বাংলাদেশী ২০১৪ সালে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রেমিট্যান্স এনেছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১,১৫,৮৫৭ কোটি টাকা। সুতরাং বাংলাদেশের এই বিপুল আয় বন্ধ করার জন্য কোনো মহল ষড়যন্ত্র করছে কিনা এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করছে কিনা সেটাও আজ ভাবতে হবে।
পরিশেষ সবাইকে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রকৃত কারণ উদ্ভাবন এবং কীভাবে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদকে নির্মূল করা যায় তা নিয়ে গবেষণার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানছি।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।