Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ২:০১ এএম, ১১ মে, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। রাজুর নেতৃত্বে চার সদস্যের জল্লাদ দল এই দন্ডাদেশ কার্যকর করে। এরপর সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা পালস পরীক্ষা করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর কড়া নিরাপত্তায় লাশ নিয়ে গাড়ির বহর পাবনার সাঁথিয়ায় নিজামীর গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর আগে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ কারা অধিদফতরে পৌঁছায়। এরপরই কারা কর্তৃপক্ষের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে কারাগার ও এর আশপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে কারাগারে নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকরে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়। এর আগে রাত ৭টা ৪৫ মিনিটে মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা তার সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য কারাগারে প্রবেশ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা সাক্ষাতের পর তারা বেরিয়ে আসেন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলেননি। নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী, বড় ছেলে ব্যারিস্টার নাজীব মোমেন, বড় পুত্রবধূ, দুই নাতি, ছোট মেয়ে মহসীনা, নিজামীর চাচাতো ভাই, ভাইয়ের মেয়েসহ ২৪ জন নিকটাত্মীয় তার সাথে শেষ সাক্ষাৎ করেন। কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করার পর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদেরকে ফাঁসির সেলের (কনডেমড) সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে  প্রায় ৪০ মিনিট সাক্ষাতে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা নিজামীকে ধরে কান্নাকাটি করেন। কারা সূত্র জানায়, অনেকটা অবিচল নিজামী তাদেরকে সান্ত¦না দেন এবং ভবিষ্যতে চলাফেরার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন।
কারা সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যদের পর্বের পরই একজন ডেপুটি জেলারকে দিয়ে আনন্দবাজার থেকে ২ সেট কাফনের কাপড় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে ২টি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের ডিআইজি ঢাকা বিভাগের অফিসের সামনে নিয়ে আসা হয়।
অন্যদিকে, নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগেই রাত ১০টার দিকে কারাগারে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকার সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক, স্থানীয় এমপি, পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পাশাপাশি ছিলেন অতিরিক্ত আইজি প্রিজন্স ইকবাল হাসান, ডিআইজি প্রিজন্স ঢাকা বিভাগ গোলাম হায়দার, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলম, কারা কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চিকিৎসক সহকারী সার্জন শামসুদ্দিন আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারা অভ্যন্তরে ফাঁসির মঞ্চের অদূরে টানানো ফ্ল্যাড লাইট ও সামিয়ানার নিচে তাদের বসতে দেয়া হয়।
পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ রুটিনমাফিক তাদের কাজ শুরু করে। এশার নামাজ পড়ার পরই কারা জামে মসজিদের ইমাম মনির হোসেন মতিউর রহমান নিজামীকে ওজু করিয়ে তওবা পড়ান। তাকে রাতের খাবার দেয়া হলেও তিনি খাননি। এরপরই তাকে কনডেমড সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের অদূরে বিশেষ একটি সেলে স্থানান্তর করা হয়। এরপরই জল্লাদ দলের কাজ শুরু হয়। সর্দার রাজুর নেতৃত্বে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করে জল্লাদরা। রাজুর নেতৃত্বে অংশ নেয় ৪ জন জল্লাদ। সকল প্রস্তুতি সম্পন্নের পর সিনিয়র জেল সুপারের ইশারায় ৩ জন জল্লাদ সেলে গিয়ে নিজামীকে কালো জমটুপি পরিয়ে দেয়। এ সময় নিজামী নিজে জল্লাদদেরকে সহযোগিতা করেন। এরপর সঙ্গীয় ২ জল্লাদ নিজামীর ২ হাতের বাহুতে ধরে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপরই ফাঁসির মঞ্চে জল্লাদরা তার হাত ও পা বেঁধে ফেলে। নির্ধারিত সময়ের আগেই জমটুপির ওপর দিয়ে ফাঁসির রশি (ম্যানিলা রোপ) তার গলায় পরিয়ে দেয়া হয়। তখন সকলের দৃষ্টি পড়ে পাশে লাল রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জেল সুপারের ওপর। নির্ধারিত সময়ের জিরো পয়েন্টে গেলেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ইশারায় সিনিয়র জেল সুপার হাতের লাল রুমালটি মাটিতে ফেলে দেন। আর তখনই জল্লাদ তার ফাঁসির কপিকলের সুইচ টেপে। তাৎক্ষণিক ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন নিজামী। কারা সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৪ মিনিট ঝুলন্ত রেখে নিজামীর নিথর দেহ তুলে পাশের নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়। সেখানে সিভিল সার্জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হাত-পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করার বিধান রয়েছে। এরপরই তার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে মৃত্যুর সনদপত্র দেয়া হয় মনোনীত অভিভাবকের কাছে। পাশাপাশি মৌলভী দিয়ে গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে নিজামীর লাশ তুলে দেয়া হয় নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্সে।
অ্যাম্বুলেন্সে লাশ তোলার পর পুলিশ ও র‌্যাব প্রশাসন নিজামীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স সতর্ক পাহারায় তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় দাফনের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করেন। পুলিশ, গোয়েন্দা ও র‌্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্সের কঠোর নজরদারিতে কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্স রওনা করে মতিউর রহমান নিজামীর গ্রামের বাড়ির  উদ্দেশে।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশও পৌঁছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি মতিউর রহমান নিজামী। তাই যেকোনো সময় তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে। মঙ্গলবার বিকালেই জল্লাদ রাজুকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ফাঁসি কার্যকরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। নিজামীর মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরের জন্য একদিন আগে থেকে কারাগারের ভিতরে বাইরে নেয়া হয় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একই সাথে সারাদেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কারাগার সূত্র জানায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেন কারা কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলমসহ বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে ফাঁসির মঞ্চসহ আশপাশের স্থান পরিদর্শন করেন তারা। বৈঠক শেষে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্ণেল মো. ইকবাল বের হয়ে যান। গত সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে মাওলানা নিজামীকে রায়ের কপি পড়ে শোনান সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। এসময় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি গোলাম হায়দার, জেল সুপার নেসার আলম এবং দুইজন ডেপুটি জেল সুপার উপস্থিত ছিলেন। একই দিন একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ খারিজের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রকাশের পর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে রায়ের কপি যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কারা কর্মকর্তাদের ব্যস্ত সময়
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে কারা কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। সকালেই অফিসে চলে আসেন জেলার নেসার আলম। কারাফটকেই তার বাসা। এর পর আসেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল কারাগারে আসেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বের হয়ে যান। তবে অন্য কর্মকর্তারা কারাগারেই ছিলেন। কারাফটকে কয়েকজন কারারক্ষী জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সবাই ব্যস্ত সময় কাটায়। কারাগারের বাইরে যেমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল, ভিতরেও ছিল তেমনই। দুপুরের মধ্যেই কারাবন্দীদের নিজ নিজ সেলে প্রবেশ করানোর পর তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। সোমবার থেকে কারাগারের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পর গতকাল তা আরও বাড়ানো হয়। কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান নেয়। অন্যান্য ফটকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একপর্যায়ে কারাগারের চারদিকের সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
গত সোমবার রাত ৯টার দিকে নিজামীকে রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়া রায় পড়ে শোনানো হয়। এদিন বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়া রায় প্রকাশ করেন। এরপর বিকেল ৫টার কিছু পর আপিল বিভাগের একটি প্রতিনিধিদল রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে দেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সেদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে লাল কাপড়ে মোড়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে রওনা হয়। পরে ৭টা ৫ মিনিটে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর রায়ের কপি নেন। গত রোববার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মতিউর রহমান নিজামীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।
গত বৃহস্পতিবার (৫ মে) মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ খারিজ করে দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এক শব্দের এই রায় ঘোষণা করেন। বেলা সাড়ে ১১টায় এজলাসে এসে প্রধান বিচারপতি শুধু বলেন, ‘ডিসমিসড’। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এর আগে, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী হিসাবে কাদের মোল্লা এবং ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এরপর গত বছরের ২১ নভেম্বর একই সঙ্গে কার্যকর করা হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদন্ড।



 

Show all comments
  • Palash Patoary ১১ মে, ২০১৬, ১০:৪০ এএম says : 0
    إِنَّا للهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ