Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রূপগঞ্জ পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিস ঘুষ ছাড়া কাজই হয় না!

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে মো. খলিল সিকদার | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হয় না রূপগঞ্জ পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। সাবরেজিস্ট্রিার শহিদুল ইসলাম হচ্ছেন দুর্নীতির বরপুত্র। ঘুষ আর দালাল ছাড়া এখানে কিছুই মেলে না। দুর্নীতি আর অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এ অফিসটি। জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমি, প্লট রেজিস্ট্রি করে দিয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছে সাবরেজিস্ট্রিার। ভূমি কর্মকর্তাদের নাম ও সিল স্বাক্ষর ব্যবহার করে ভুয়া কাগজ তৈরি করে সাব রেজিস্ট্রার জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে দলিল করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ অফিসে মাসে অন্তত ৬০ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। আর প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবরেজিস্ট্রার কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর মাস্টারপাড়া (উত্তর) এলাকার বাহারউদ্দিনের ছেলে শহিদুল ইসলাম। তার এলাকায় রয়েছে অট্রালিকা। রয়েছে কয়েক বিঘা জমি। থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। স্ত্রী-স্বজনদের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে কোটি-কোটি টাকা।

সাবরেজিস্ট্রি অফিস, দলিল লেখক ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমিশন দলিল করতে সরকারি ফি বাবদ ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করা থাকলে সাবরেজিস্ট্রার হাতিয়ে নেন হাজার হাজার টাকা। রূপগঞ্জ উপজেলার আওতাভুক্ত এলাকার কমিশনে (বাড়িতে বসে) দলিল করতে নেন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আর উপজেলার বাইরের এলাকার জন্য নেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবকবলা দলিল করতে শতকরা ১১ টাকা হিসাবে ব্যাংকে জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে দলিলপ্রতি লাখে ৩০০ টাকা দিতে হয় সাবরেজিস্ট্রারকে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলে কোন ফি না নেয়ার নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হয় দলিল করতে আসা লোকজনদের। এ দলিলে ঘুষ দিতে হয় ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা। হেবা ঘোষণা দলিল ফিবিহীন করার বিধান থাকলেও নেওয়া হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। বন্টননামা দলিলে নেওয়া হয় পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকা। কোন দলিলের মূল পর্চা না থাকলে ফটোকপি পর্চায় নেয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া দলিলের নকল তুলতে দলিলপ্রতি নেওয়া হয় দুই হাজার টাকা।

সাবরেজিস্ট্রি অফিসের জনৈক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গড়ে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি দলিল হয়। সে হিসাবে মাসে দলিল হয় ১৩০০ থেকে ১৫০০। এসব খাত থেকে প্রতিমাসে শুধু পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিসে আয় হয় ৪৫ লাখ টাকা। সাবরেজিস্ট্রার শহিদুল ইসলামের ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত এক কর্মচারী তার নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, রূপগঞ্জে যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে খাড়া (জাল ) দলিলেও তিনি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। এছাড়া সরকারী ‘ক’ তালিকাভুক্ত সম্পত্তিও মোটা অংকের বিনিময়ে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। বাদ যায়নি কুলিয়াদি মৌজার বনের জমিও।

সাবরেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জাঙ্গীর মৌজার আর এস ১০২২ দাগের সরকারের ‘ক’ তফসিলভুক্ত ৩২ শতক জমি ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে রেজিস্ট্রি সম্পাদন করে দিয়েছেন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আসাদুজ্জামানের নির্দেশকে অমান্য করেই এ জমি রেজিস্ট্রি দেওয়া হয়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৮০ লাখ টাকা। কথা হয় উপজেলার কেয়ারিয়া এলাকার ভুক্তভোগী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তার ১৮০ শতক জমি টাকার বিনিময়ে ভূয়া দলিলে একজনকে রেজিস্ট্রি করে দেয়। এনিয়ে তার দরবারে বেশ কয়েকবার ধরণাও দেওয়া হয়। কোন কাজে না আসায় পরে নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। নগরপাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেন। তিনি তার বোনের নিকট থেকে হেবানামা করে দুই শতক জায়গা রেজিস্ট্রি করাবেন। সাবরেজিস্ট্রি শহিদুল ইসলাম দিতে নারাজ। পরে তিনি ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে রেজিস্ট্রি করান।

গত মঙ্গলবার সকালে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে আসা কয়েকজন জমির মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, দুপুর ২ টা বাজলেই সাবরেজিস্ট্রার ইচ্ছাকৃত সময়ক্ষেপন করেন। বিকেল ৩ টার পর থেকে বিলম্ব ফি নেওয়া হয়। জমির পরিমাণ, ক্রেতাদের ধরণ অনুযায়ী আট হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বিলম্ব ফির মাধ্যমে অধিকাংশ সময়ই রেজিস্ট্রি চলে রাত ৯ টা পর্যন্ত। পূর্বাচল উপশহরের প্লট রেজিস্ট্রিতে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত আদায় করা হয়।

সাবরেজিস্ট্রার শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আমার এখানে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি হয় না। ‘ক’ তফসিল ভুক্ত জমি রেজিস্ট্রির ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, এটা আদালতের ব্যাপার। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যদি নিতে হয় সেটা আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আদালত দেখবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ