Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রওজা চোর ও হারামাইন গ্রাসে উদ্যত গোস্তাখ ক্রুসেডারদের ধ্বংস কাহিনী-৩

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

সুলতান সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইউব সকল বন্দীকে হত্যার নির্দেশ দেন, যাতে আল্লাহর হেরম ও তার হেরমের ওপর আগ্রাসন চালানোর দুঃসাহসকারী প্রত্যেকের শিক্ষা হয়। তাদের প্রত্যেকের হত্যা সম্পন্ন হওয়ার পর কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপথগুলোতে তাদের লাশ প্রদর্শন করা হয়।
পর্যটক ইবনে জুবাইর এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে বর্ণনা করেন; হিজরি ৫৭৮ সালের জিলহজ মাসের প্রথম দিকে মোতাবেক ১১৮২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রত্যক্ষ করে ক্রুসেড বন্দীদের দেখার জন্য লোকদের এক সমাবেশ, যাদের উটে আরোহণ করিয়ে শহরে আনা হয়। যাদের চেহারা ছিল উটের লেজের দিকে এবং তাদের আশেপাশে ছিল ঢোল ও বিহগনের বাদ্য।
এভাবে সালাহউদ্দীন আইউবি লোহিত সাগরকে ক্রুসেডারদের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখেন এবং এমনভাবে ব্যবস্থা করেন যে, উহা খাঁটি ইসলামি সাগর হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় এবং সালাহউদ্দীন ও তার প্রতিনিধিদের যুগ পর্যন্ত কখনো অনৈসলামিক নৌযান লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়নি, যা ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
সুলতান সালাহউদ্দীন যেভাবে মানত পূরা করেন, ঐতিহাসিক হিত্তিন যুদ্ধে ক্রুসেডারদের (দ্বিতীয় ক্রুসেড) শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের পুনরায় অধিকারে আসে। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাদশাহও সৈন্যদের সাথে বন্দী হন। সুলতান সালাহউদ্দীন যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে তার তাঁবুও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি নির্দেশ দেন যে, কয়েদিদের তার সামনে উপস্থিত করা হোক।
জেরুজালেমের বাদশাহ ‘গাই’ এবং খ্রিষ্টান রেজিনাল্ড ‘চাইলুন’কেউ তার সামনে হাজির করা হয়। সুলতান জেরুজালেমের বাদশাহকে তার পাশে বসান এবং তাকে পিপাসার্ত দেখে ঠাÐা পানির একটি পাত্র দেন। গাই পানি পান করার পর পাত্রটি খালি করে রেজিনাল্ডকে দেন। সুলতান দেখে অসন্তুষ্ট হন এবং দোভাষীকে বলেন, বাদশাহ গাই তার ভাইকে এভাবে বললেন, যেভাবে আমরা রুটিতে নমক দিয়ে থাকি, তাকে নিরাপদ মনে করা হয়। কিন্তু এ লোকটি এমন নয় যে, আমার প্রতিশোধ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
সালাহউদ্দীন এতটুকু বলে দাঁড়িয়ে যান এবং রেজিনাল্ডের সামনে আসেন। তাঁবু থেকে আসার পর থেকে রেজিনাল্ড দাঁড়ানো ছিল। সুলতান তাকে লক্ষ করে বলেন; “শুন! আমি তোকে হত্যা করার জন্য দুইবার শপথ করেছিলাম, একবার তুই যখন মক্কা ও মদিনার পবিত্র শহরগুলোর ওপর হামলা করতে চেয়েছিলি, দ্বিতীয়বার তুই যখন ধোঁকাবাজি করে হাজীদের কাফেলার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলি।’
কাজী ইবনে শাদ্দাদের বর্ণনানুযায়ী, যখন ওই অসহায় হাজীদের কাছে মানবতা ও শরাফতের আবেদন জানায়, তখন সে বেআদবির সুরে বলে, ‘তোমাদের মোহাম্মদ (সা.) কে বলো তোমাদের মুক্ত করতে।’ এ বাক্য সালাহউদ্দীনের কাছে পৌঁছে এবং তিনি মানত করেন যে, এ বেআদব যদি আমার নাগালে আসে তাকে আমি নিজ হাতে হত্যা করব। ‘দেখ! এখন তোর গোস্তাখি ও অবমাননার প্রতিশোধ নিচ্ছি।’ এ কথা বলেই সালাহউদ্দীন তরবারি বের করেন এবং যেভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই রেজিনাল্ডকে স্বহস্তে হত্যা করেন, প্রাণ যতটুকু বাকি ছিল তা পাহারাদারেরা এসে খতম করে দেয়।
বাদশাহ গাই এ হত্যাকাÐ দেখে প্রকম্পিত হয়ে উঠেন যে, এবার তাকে হত্যা করা হবে। সালাহউদ্দীন তাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘বাদশাহদের রীতি নয় যে, তারা বাদশাহকে হত্যা করেন, ওই ব্যক্তি বারবার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল। এখন যা হয়ে গেছে, তা শেষ।’ ইবনে শাদ্দাদ লিখেছেন, সুলতান রেজিনাল্ডকে তলব করে বলেন, ‘হা আনা আনছুরুলি মোহাম্মদ (সা.)’, ‘দেখো! আমি মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিশোধ নিচ্ছি।’
সুলতান সালাহউদ্দীন স্বহস্তে যাকে হত্যা করেনÑ কারো কারো মতে, তার নাম আর্নাথ। এ সম্পর্কে আধুনিক যুগের বিখ্যাত আরব লেখক হাসানাইল মোহাম্মদ রাফি ‘জিহাদু সালাহউদ্দীন আল আইউবি যিদ্দাছ ছালিবিয়্যিন’ (ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সালাহউদ্দীন আল আইউবির জিহাদ) শীর্ষক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে আর্নাথের পরিকল্পনার পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সালাহউদ্দীন ও ক্রুসেডারদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। কার্ক শাসক ক্রুসেডার আর্নাথ নির্বোধের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে, যা ব্যক্তিগতভাবে আর্নাথ ও সমষ্টিগতভাবে ক্রুসেডারদের জন্য ডেকে আনে মহাবিপর্যয় ও শোচনীয় পরিণতি (হিত্তিন যুদ্ধে পরাজয়)।
হিজরি ৫৮২ সালের শেষ দিকে মোতাবেক ১১৮৭ সালে কায়রো থেকে দামেস্কের পথে মুসলমানদের কাফেলার ওপর হামলা চালায়, তাদের বিপুল পরিমাণ সফর সামগ্রী ও সম্পদ জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং মুসলমানদের এক বিরাট দলকে বন্দী করে, সম্পাদিত চুক্তিগুলোর কোনো তোয়াক্কা করেনি। সুলতান সালাহউদ্দীন আর্নাথের কাছে এসব সম্পদ ফেরত চেয়ে এবং আটককৃত মুসলমানদের ফেরত চেয়ে একজন দূত পাঠান। আর্নাথ এসব ফেরত দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো তার কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে বসে। অর্থাৎ মুসলমানদের কোনো দাবি গ্রহণ করেনি এবং চরম ঔদ্ধত্য ও অবজ্ঞার সাথে বললÑ ‘কুলু লিমোহাম্মদ (সা.) ইউখলিছুকুম’ অর্থাৎ ‘মোহাম্মদ (সা.) কে বলো, তিনি তোমাদেরকে রেহাই দেবেন।’ সুলতান সালাহউদ্দীন ভীষণ ক্রোধান্বিত হন এবং আর্নাথের রক্ত মানত করেন। আল্লাহ তাকে কামিয়াব করলে তিনি তাকে হত্যা করবেন। ক্রুসেডাররা হিত্তিন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সুলতান সালাহউদ্দীন বন্দী আর্নাথকে শপথ অনুযায়ী নিজ হাতে হত্যা করেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।



 

Show all comments
  • Ameen Munshi ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১১ এএম says : 0
    Thanks to Writer for this Beautiful write-up. We want such articles more and more
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Mosharraf ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১২ এএম says : 0
    ইহুদিরা মুসলমানদের চির শত্রু, তারা কখনও মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না। গোটা বিশ্বে যেখানেই মুসলিম নিধন হচ্ছে সেখানেই তাদের হাত আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Shah Alam ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৪ এএম says : 0
    মুসলমান হিসেবে দূর্ভাগ্য আমাদের, যেই ইহুদিরা প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (স.) এর রওজা চুরি করার মতো দু:সাহস দেখিয়েছিল তাদের সাথে অনেক মুসলিম দেশ আঁতাত করে চলছে, তাদের কথামতো চলছে।
    Total Reply(0) Reply
  • আমিন গাজী ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৬ এএম says : 0
    ক্রুসেডের প্রথম যুদ্ধেই জেরুজালেম মুসলমাদের হাত ছাড়া হয়। এর প্রায় ২০০ বছর পর জেরুজালেম আবার পুনরুদ্ধার করেন মুসলিম সেনাপতি, অকুতোভয় সেনা নায়ক, সুলতান গাজী সালাউদ্দীন আল আইয়ুবী। ঝড়গতি সম্পন্ন, আপোষহীন অকুতোভয় আইয়ুবী যখন ইসলামের তরবারি হাতে আবির্ভূত হন তখন ক্রুসেডের সাজানো কৌশল বারেবারে কেপে উঠে। চক্রান্তের জাল ছিড়ে জেরুজালেম ছিনিয়ে এনে শত বছরপর আবার মুসলমানদের হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসেন গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী। আল্লাহ এই মহাবীরকে উত্তম প্রতিদান দিও।আমীন
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৭ এএম says : 0
    ১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন। ১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা ও হিমস জয় করেন। জেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিল। এরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হন।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Arfatur Rahman ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৭ এএম says : 0
    আল্লাহ আইয়ুবীর মতো একজন বীর ইসলামি যোদ্বা তুমি ফিলিস্তিন এবং ইসরায়লে প্রেরণ কর।সমগ্র মুসলিমদের রুকে দাড়ানোর শক্তি দাও যেন ইসলামের মহান বাণি সারা পৃথীবিতে সুন্দর প্রয়াস সৃষ্টি করে।
    Total Reply(0) Reply
  • Masum Molla ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৮ এএম says : 0
    অত্যন্ত যুগোপযোগী ও সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • Anowar Hossain ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:১৯ এএম says : 0
    We, the muslims are declining day by day for the lack of our unity, proper education, future planning and ill characters
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন