বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হলেও এবারের পহেলা বৈশাখ অনেকটা ভিন্ন আঙ্গিকে ও শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলো। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আশাকরি এই ধারাবাহিকতায় আগামীতে বিকৃত সংস্কৃতি চর্চা ও ‘ইলিশ নিধন উৎসব’ মুক্ত পরিবেশে আরো পরিচ্ছন্ন ১ বৈশাখ পালনে আমরা সক্ষম হব। যাতে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভব হবে।
মন্দের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত এবং প্রবলতরও। সেই ক্ষেত্রে নিয়ম নৈতিকতার কঠোরতার পরিবর্তে কেবলই সুড়সুড়ি দেয়ার সূর্যমুখী আয়োজনে পরিস্থিতি যা হওয়ার তা না হওয়াটাও প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলা চলে। গভীর রাত পর্যন্ত বাঁধনদের বাঁধনহীন উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতা যে প্রগতি নয় বরং দুর্ভোগের কারণ নির্যাতনের শিকার হয়েও এ বিষয়ে সঠিক উপলব্ধি হলো কিনা সন্দেহ। কারণ এত কিছুর পরও এক শ্রেণির তরুণ-তরুণী পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে মদ আর অনৈতিক কর্মকা-কে নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করার বিরামহীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত। তবে এবারের ১ বৈশাখ এ বিবেচনায় অনেকটা ব্যতিক্রম হওয়া প্রকারান্তে এটাই প্রমাণ করল যে, প্রশাসনের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা ও ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কতটা জরুরি। ভালো কাজের ফলাফল ভালোই হয়, তা যদি ইসলামের নাম প্রকাশ না করেও হয়।
উৎসবের নামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা অপসংস্কৃতি ও অশ্লীলতার সয়লাবে এক সময় রুচিশীল মানুষগুলো নিজেদের গুটিয়ে রাখাটাই শ্রেয় বিবেচনা করলেন কোনো প্রকার প্রতিরোধ বা রুচিসম্পন্ন বিকল্প উপস্থাপনা ছাড়াই। সুতরাং আজকের পঙ্কিল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাদের ভূমিকাকে আদৌ দায়মুক্ত মনে করা যায় না। ইসলামের সাথে ১ বৈশাখ উদযাপনে কোনো বিরোধ নেই, তথ্যমন্ত্রীর এই মূল্যায়ন যেমনি অসত্য নয়, তেমনি বৈশাখ উদযাপন পূজাও নয়, ইবাদতও নয়, এই চেতনাটিও মিথ্যা নয়। বরং বলা চলে একই লক্ষ্য অর্জনে পরস্পর পরিপূরক ও সম্পূরকের মতোই। তবে এই বিশ্বাস ও চেতনাগুলোর গঠনমূলক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন থাকলেও দূর অতীত থেকেই দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। অনাবাদি জমিতে আগাছা জন্মনোর মতো। এ সুযোগে অপসংস্কৃতি আর অল্প বিশ্বাসের সয়লাব ঘটে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। সুতরাং এসব জঞ্জাল অপসারণ ছাড়া শুধু উপদেশ বা পরামর্শদানে তেমন কোনো কাজ হবে মনে হয় না। সুতরাং ‘ইসলামের সাথে বিরোধ নেই’ বা ‘পূজা নয়, ইবাদতও নয়’ এ ধরনের বক্তব্যগুলো অর্থবহ করে তোলার জন্য ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো যেমনি পরিহার করা উচিত, তেমনি একে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙানোর প্রবণতাও প্রতিহত করা জরুরি। যাতে করে দ্বিধা-সংশয়হীনভাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব পক্ষের সমভাবে অংশগ্রহণে বৈশাখী উৎসব আরো সুন্দর ও সার্থক হয়ে ওঠে। অবশ্য মন্দ দিকগুলোকে ছাঁটাই করলে আর যা থাকে তা বেনামিতে হলেও ইসলামীই হয়ে যায় বলে কেউ যদি জিদ ধরেন তবে সেই কপাল পোড়ার জন্য অন্যদের কী করার আছে?
সত্য বলতে কী আজ এই ব্যর্থতারই অনিবার্য শিকার জাতি। এ সুবাদে শুধু মুলসমানদের বেলায় এক অদ্ভুত প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ‘তুমি মুসলমানই থাকবে না বাঙালি হবে’? ‘গড়ের মাঠে বাঙালি আর মুসলমানদের ফুটবল খেলা’ শরৎবাবুর এমন একটি উক্তি নিয়ে শতবর্ষ আগে বিতর্ক হয়েছিল অনেক, আর এখন এক শ্রেণির শেখ-সৈয়দরাই যেন একই চেতনায় দিশাহারা! অতএব ভেজাল ও মিথ্যের সয়লাব এ বেলাও। অবস্থা এমন যে, যদি বলি মরণ মিয়া বা বাঁচন বেগম সংস্কৃতমনা ব্যক্তিত্ব, আর তারা যদি পূর্ব পরিচিত না হন তাহলে প্রাথমিকভাবে তাদের সম্পর্কে যে ধারণা জন্মায় তা সম্মানজনক নয় মোটেও। কারণ অপসংস্কৃতির সয়লাবে মুসলমান ও সংস্কৃতমনা শব্দ দুটি এখন যেন বাঙালিত্বের মতোই বিপরীত অর্থবোধক। অতএব মরণ মিয়ার বেলায় যেমন তেমন, বাঁচন বেগমের বেলায় যে ধারণাটি জন্মায় তা আরো জঘন্য। মনে হতে পারে তসলিমার মতোই কোনো এক ভ্রষ্টা নারী আর কি? কিন্তু মরণ মিয়া না হয়ে যদি তিনি শ্রী মরণ চাঁদ হন তাহলে চেতনায় এক ভিন্ন চেহারাই ভেসে ওঠে। মরণ চাঁদ তার সাম্প্রদায়িক চেতনা, বেদ-পুরাণ, দেব-দেবী, পূজা-অর্চনা, মন্দির-আশ্রম, টিকি-পৈতা, ছোঁয়া-ছুঁই, জাত-পাত সবকিছু ঠিকঠাক রেখেও একজন সংস্কৃতমনা হতে বাধা নেই, বিপত্তি সব মিয়া আর বেগমদের বেলায়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কি তা স্পষ্ট করার জন্য একটা উদাহরণ দিতে চাই। মহল্লার ইমাম সাহেবের প্রগতিপন্থি স্ত্রীকে রমনা বটমূলে নাচের অনুষ্ঠানে তবলা বাজাতে বা খোদ ইমাম সাহেবকে চারুকলার আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছেলেমেয়েদের সাথে নাচানাচি করতে দেখার পর কোনো বার্ষিক নামাজিও তার পেছনে ইক্তেদা করতে রাজি হওয়া তো দূরের কথা, বরং মসজিদে ফেরার আগেই চাকরিটা ‘নট’ করার কাজে লেগে যাবেন। এখন প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতিমনা বা কথিত বাঙালি হতে গিয়ে বেচারা ইমাম সাহেবের বেলায় যে বিপত্তি দেখা দিল মন্দিরের পুরোহিত-ঠাকুরের বেলায় তেমনটি আদৌ ঘটবে কী? জবাবটা সবারই জানা। এই বেলা ঠাকুর দাদার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ারই ষোলআনা সম্ভাবনা। দুজনই বাঙালি এবং উদ্দেশ্য অভিন্ন হওয়ার পরও একই যাত্রায় দুই বিপরীতমুখী ফল কেন? সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কী তা অনুধাবনের জন্য আশা করি এতটুকুই যথেষ্ট। অপসংস্কৃতিও কীভাবে সংস্কৃতি হয় তারও একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মিডিয়া কর্মী। চাকরির সুবাদে পরিচয় দীর্ঘদিনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স। কথা প্রসঙ্গে একদিন ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে বললাম। সহাস্যে বলেলন, ‘পাত্রী তো আছে কিন্তু আপনাদের চলবে কি? উদার সংস্কৃতমনা, প্রগতিশীলা। চারুকলার ছাত্রী তো।’ বললাম, ‘কেন, আমরা তো তেমনটিই চাই’। চোখ কপালে তুলেÑ ‘আসলে কী তাই’! বললাম, ‘আপনার বর্ণনায় যদি ভুল না থাকে অর্থাৎ মেয়েটি যদি প্রকৃত অর্থেই সংস্কৃতমনা ও প্রগতিশীল চেতনার ধারক হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই শালীন ও পরিশীলিত জীবনাচারে অভ্যস্ত এবং মাদক, আড্ডা, বেহায়াপনাসহ সব অপসংস্কৃতির ছোঁয়ামুক্ত হওয়ারই কথা। আশা করি, পরহেজগার দীনদারও বটে। আর পর্দানশিন না হয়ে তো প্রগতিশীল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব আলোচনা চলতে পারে।’ অতঃপর ভদ্র মহিলার সাথে বহুবার দেখা হলেও এই বিষয়টি আর আলোচনায় আনেননি একবারও। আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব-পর্বে ভেজাল, পরিত্যক্ত পচা মাল চালিয়ে দেয়ার রেওয়াজ বা সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের। কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতির পাইকাররাও তাদের হাজার বছরের পুরনো পচা দুর্গন্ধময় পরিত্যক্ত মালগুলো বাজারজাত করার জন্য ১ বৈশাখ আর একুশে ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়েছেন যেন। ঐতিহ্য ও চেতনার নামে বিক্রয় চলছে ভালো। (এই যেমন পান্তা-ইলিশ, মদ-মুখোশ) তাদের উদাত্ত আহ্বান ‘উৎসে ফিরে এসো, যেখান থেকে তোমাদের বিভ্রান্ত পিতামহরা ছিটকে পড়েছিল হাজার বছর আগে। বিষয়টি জরুরি, কারণ অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাঙালি সনদ প্রাপ্তির জন্য এ ছাড়া কোনো কোর্স বা সিলেবাস নেই।’ করিম-রহিমরা আর ঘরে থাকে কীভাবে? চারুকলার পৌরোহিত্যে পেঁচা আর হনুমানের মুখোশে যদু-মধু, করিম-রহিমরা ‘মঙ্গল মিছিলে’ একাকার হয়ে গেল। একদিনেই গুদামের সব পচা মাল খালাস! পেঁচা আর ভরা কলস মঙ্গলের প্রতীক হয়ে গেল এ ডিজিটাল যুগেও! বাকি রইল গো-মূত্র ও গো-মল (গোবর)। হয়তো আগামী প্রজন্মকে খাঁটি বাঙালি হওয়ার শর্ত হিসেবে তাও মেনে নিতে হবে সব শূচিতা ও বিশুদ্ধতার উৎস হিসেবে। নব প্রজন্মের পাঠ্যবইতে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া পশুর মাংস হালাল করা হলেও কোরবানির গোশত বাঙালির জন্য বৈধ করা গেল না! দুর্ভাগ্য! ৯০ ভাগ মানুষের কোরবানির ঈদ, শব-ই-বরাত সর্বজনীন হতে না পারলেও সরস্বতী আর দুর্গাপূজা ৯০ ভাগ মানুষের অজান্তেই সর্বজনীন হয়ে গেল কেবল প্রচারণার জোরেই।
সংস্কৃতি কি? এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ই.বি টেইলর প্রদত্ত সংজ্ঞাটি শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে এখনো প্রণিধানযোগ্য। তার মতে ‘সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজস্থ মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস (ধর্ম-দর্শন) কলা, নীতি-নিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য যে কোনো বিষয় দক্ষতার এক জটিল সমাবেশ, যা একজন সদস্য হিসেবে মানুষ অর্জন করে।’ এর বিপরীত দিকগুলো যেমনÑ অজ্ঞতা ও মূর্খতা, অন্ধবিশ্বাস, যুক্তি ও বিজ্ঞানবর্জিত ধ্যান-ধারণা, অমানবিক ও অনৈতিক যাবতীয় কর্মনীতি ও নিয়ম এসবই এক কথায় অপসংস্কৃতি, উৎস তার ধর্ম বা চেতনা যাই হোক না কেন। অজ্ঞতা হেতু এক সময় ‘এপ্রিল ফুল’ এর মতো অপসংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিম সবার কাছে বাজার পেয়েছিল। এপ্রিল ফুলের উৎস জানার পর এই অপসংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত প্রায়। এবার সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির ঠিকাদারদের ঠেকানোর পালা। এদের চরিত্র অনেকটা মাছির মতো। যেখানে ময়লা-আবর্জনা সেখানেই ওরা, তাই ৩১ ডিসেম্বরের রাতেও এরা রাস্তায় নামে অনাসৃষ্টির উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি ঘটায় বাঁধনদের হাজার মানুষের সামনে। এটা সবারই প্রত্যাশা, আগত বর্ষটি বিগত বর্ষের চেয়ে সুন্দর ও সফল হোক! এমনটি কী কারো কাম্য হতে পারে যে, নতুন বছরটি জাতীয় জীবনে আদিম যুগের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঢালি খুলে দিক, সফলভাবে ফিরিয়ে দিক প্রগতি ও সভ্যতার চাকা প্রস্তর যুগ বা বৈদিক যুগের দিকে? তা না হলে বর্ষবরণের নামে চার হাজার বছর আগের পরিত্যক্ত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারগুলো ইতিহাসের ডাস্টবিন থেকে টেনে তুলে বাজারজাতে এমন মরিয়া প্রয়াস কেন? অবাক হওয়ার বিষয়, এই অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কারে ইন্ধন দেয়া হচ্ছে কিন্তু প্রগতি আর আধুনিকতার নামেই! (চলবে)
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।