বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
রাজু আহমেদ
শহরের সুউচ্চ ভবন, আমাদের মসৃণ পথচলার আয়োজনের পরতে পরতে মিশে আছে শ্রমিকের অবদান। সকালের শহরে ভদ্রভাবে হেঁটে চলার পরিবেশ বিরাজ করতো না যদি শহরের এক কোণে অবহেলায় বসবাসরত শ্রমিকেরা সূর্য উদয়ের পূর্বে স্তূপীকৃত ময়লা-আবর্জনার জঞ্জাট সরিয়ে না দিত। যে খাদ্য খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করছে সেই খাদ্যের এক কণাও উৎপাদিত হতো না যদি শ্রমিকের দল সূর্যের তীব্র তাপ এবং বর্ষার অবিরাম বর্ষণ সহ্য করার জন্য তাদের শরীরকে উন্মুক্ত করে না দিতেন। আজকের পৃথিবীতে যারা ধনের বাহাদুরি করে তাদের একটি পয়সাও অর্জন সম্ভব ছিল না শ্রমিকদের শ্রম ছাড়া। যারা তাদের সুন্দর-সুশৃঙ্খল জীবনের বাহাদুরি দেখায় তাদের এক সেকেন্ড সামনে গড়াতো না যদি শ্রমিকেরা তাদের রক্ত, ঘামের বিনিময় অন্যের জীবনকে সাজিয়ে দেয়ার দায়িত্ব না নিত। পৃথিবীর যে উন্নতি, সভ্যতার যে উৎকর্ষতার আলোকচ্ছটা আমরা দেখাচ্ছি তার অবদান শ্রমিকের। শ্রমিকরাই হাড়ভাঙ্গা, হৃদয়ভাঙ্গা প্ররিশ্রমে সজ্জিত করে দিয়েছে আমাদের সভ্যতা। শ্রমিক যদি শ্রম না দিত তবে কালের চাকা থেমে যেত, সভ্যতা থমকে দাঁড়াত এবং পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলত। তাইতো শ্রমিকের শ্রমকে মানব সভ্যতার জনক বলা হয়। কোনভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে যাদের অধীনে শ্রমিকরা যুগের পর যুগ কাজ করে গেল, সেই প্রভুরা শ্রমিকের শ্রমকে পুঁজি করে বিলাসী জীবনযাপন করলেও শ্রমিকরা বেঁচে আছে হাড়ক্লিষ্ট দেহে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলায় আধাপেট খাওয়ার নিশ্চয়তা তারা আজও পায়নি। মানব সৃষ্ট শ্রমনীতি শ্রমিকদের শোষণ করেছে মাত্র কিন্তু কল্যাণ আনতে পারেনি মোটে। সেই দাস প্রথার যুগের মতো না হলেও আজও বিশ্বের নানা দেশের শ্রমিকরা ভাগ্য বিরম্বনার শিকার। অন্যায়, অবিচার আর শোষণের যাঁতাকলে বারবার পিষ্ঠ হয়েছে শ্রমিকের ভাগ্য, তবে তার বিনিময়ে ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে কতটুকু তা আজকের পৃথিবীর শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থান দেখলে সহজে অনুমান করা যায়। কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের শুঁষে-ফুলে-ফেঁপে বেড়েছে চারদিক। মালিকপক্ষ অর্থবিত্তের সাম্রাজ্য গড়ে তুললেও শ্রমিকদের হাড় জিরজিরে অভুক্ত, অপুষ্ট ও মলিন চেহারা বদলায়নি মোটে। শ্রমিকরা তাদের সর্বশক্তি বিনিয়োগ করে কাজ করলেও বেশিরভাগ সময়েই তারা মালিকপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে মালিকদের দ্বারা শ্রমিকদের ওপর নেমে এসেছে অবর্ণনীয় অত্যাচার-অবিচার। মালিকপক্ষের দৃষ্টি লুকিয়ে কালেভদ্রে শ্রমিকরাও সকল অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং তাদের দাবি আদায়ে কিছুটা সাফল্যও পেয়েছে। তবে তারা শুধু মানবাধিকারের একাংশ ফিরে পেতে শ্রমিকদের বুকের রক্ত গড়িয়েছে পিচঢালা রাস্তায়। উৎসর্গ করতে হয়েছে অগণন জীবন।
সভ্যতার ঊষালগ্নে আমরা বর্তমান সময়ের শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক আচরণ দেখে আঁৎকে উঠি। কিন্তু মাত্র দেড় শতাব্দীকাল পূর্বে বর্তমানের তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সাথে যে আচরণ করত তা বর্বরতম আচরণের যুগকেও হার মানাত। প্রতিবছরের পহেলা মে সারা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও তাদের পেশার প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হয় ‘মহান মে দিবস’ তথা আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। মূলত শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই এ দিনের অবতারণা। আজকের শ্রমিকরা যতটুকু অধিকার পাচ্ছে তার অবতারণা ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ১ মে তারিখে আমেরিকার শিকাগো নগরীর ‘হে’ মার্কেট থেকে। সে মার্কেটের শ্রমিকরাই জীবন দিয়ে কাজের ৮ ঘণ্টা সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল। এর পূর্বে শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে তাদের মধ্যে নানা অসন্তোষ বিরাজ করছিল। সেজন্য শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে নগরীতে এক শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। পুলিশ সে সমাবেশে গুলি চালালে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক হতাহত হয়। শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণের খবর শুনে ক্ষোভে ফেটে পরে আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের জীবন উৎসর্গে অবশেষে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১ মে তারিখকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি ও কর্মজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশ্বের ট্রেড ইউনিয়নগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতির পাশাপাশি মুক্ত শ্রমবাজার, মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহের পাশাপাশি শ্রমিকদের অবাধ চলাচলের ন্যায় নতুন নতুন দাবি উত্থাপণ করছে। আমাদের দেশে পহেলা মে তারিখে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন র্যালি, আলোচনাসভা, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে একদিনের এ আয়োজন আমাদের দেশের শ্রমিকদের ভাগ্য কতটুকু বদলিয়েছে তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই একবিংশ শতাব্দীতে ৮ ঘণ্টা শ্রমের নীতি মানা হয় না। কোথাও কোথাও সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা নেই। কিছু প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ঘোষণা কাগজ-কলমে দিয়ে রাখলেও তা গঠনের প্রতিকূলে নানাবিধ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আচরণ দেখিয়ে যাচ্ছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। প্রত্যেক কর্মজীবীর চাকরি হারানোর শঙ্কা তো সর্বদাই বিরাজ করছে। শুধু কাজে টিকে থাকার জন্য শ্রমিকরা মালিকের ইচ্ছার কল-কাঠিতে পরিণত হয়েছে। কেননা আমাদের লক্ষ বেকারের দেশে একবার কাজ হারালে পুনরায় কাজ পাওয়া দুঃসাধ্যের বটে।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে মহান আল্লাহ তা’য়ালা মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দ্বারা যে শ্রমনীতি প্রণয়ন করিয়েছিলেন সেই শ্রমনীতি যদি বাস্তবায়ন থাকত তাহলে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকত না। কিংবা শ্রমনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাউকে প্রাণ দিতে হতো না। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সত্যের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে এমন সব মানব রচিত বিধানের পিছনে ছুটছি যার পুরোটাই ভুলে ভরা। মহানবী (স.) ঘোষণা করেছিলেন, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করবে তাদের শরীরের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে’-আমরা শ্রমিকের কল্যাণে এ কথাগুলো না মেনে সমাজতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র তথা মার্কস, লেলিনের মতবাদে এমনভাবে আকৃষ্ট হয়েছি যার কারণে আমাদের সত্য দেখা এবং উপলব্ধি করার অর্গান বিকল হয়ে পড়েছে। ইসলাম শুধু শ্রমিকের স্বার্থে কথা বলেনি বরং শ্রমিক এবং মালিক উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের তথা সাম্যের সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম একদিকে যেমন মালিককে নির্দেশ দিয়েছে, তোমরা শ্রমিকদের পাওনা ঠিকমত পরিশোধ করবে, তেমনি শ্রমিককেও নির্দেশ দিয়েছে, তোমরা মালিকের কাজে ফাঁকি দেবে না। শ্রমিক মালিকের দ্বন্দ্ব নিরসনে ইসলাম যে নীতির প্রবর্তন করেছে তার চেয়ে উত্তম কোনো নীতি আকাশের নিচে আর মাটির উপরে অতীতে সৃষ্টি হয়নি এবং ভবিষ্যতে সৃষ্টি হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কোরআন-হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলে বোঝা যায়, নবী-রাসূলগণ শ্রমিকদের কত উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামের প্রায় সকল নবী মাঠে ছাগল চড়িয়ে নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদাত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিজিক থেকে আহার কর।’ (সুরা-মূলক, আয়াত-১৫)। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, ‘ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করা একটি ফরজ ইবাদত’ (বায়হাকী)। নবী-রাসূলগণ শুধু কথায় নয় বরং নিজে কাজ করে বাস্তবেই শ্রমের মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন। কোনো কাজকে ক্ষুদ্র কিংবা অপমানের ভাবা উচিত নয়। শ্রমজীবী যে আল্লাহর বন্ধু তার প্রমাণ মেলে নবী-রাসূলদের পেশা দেখে। হযরত আদম (আ.) কৃষক ছিলেন। হযরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হযরত দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন। হযরত ইদ্রিস (আ.) দর্জি ছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) রাজমিস্ত্রি ছিলেন। হযরত ইসমাঈল (আ.) রাজমিস্ত্রির যোগাড়ি ছিলেন। হযরত মূসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (স.) ছাগলের রাখাল ছিলেন। এছাড়া সাহাবীদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে কর্মের প্রতি অনুরাগের বর্ণনা মেলে।
মে দিবসের চেতনা যদি শুধু পহেলা মে তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তবে এদেশের শ্রমিকদের ভাগ্য বদলাবে না কোনদিন। যে শ্রমিকদের রক্ত, ঘামকে পুঁজি করে একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদ- গঠিত হয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পায়, সে শ্রমিকদের অবহেলা করার অধিকার রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির থাকা উচিত নয়। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক নিরুপনে আমাদেরকে ইসলামমুখী হতে হবে। কেবল ইসলাম পারে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব দূর করে একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। আল হাদিসের শিক্ষানুযায়ী, শ্রমিকের ওপর ওই পরিমাণ কাজের দায়িত্ব চাপানো উচিত যা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার শক্তি শ্রমিকের থাকে। শ্রমিকের রক্তচুষে, মেহনত চুরি করে নির্মাণকৃত সম্পদের পাহাড় টিকবে না। শ্রমিকের সাথে অমানবিক আচরণ করে যদি কিছু অর্জন করা হয় তবে তা শ্রমিকের বুকফাঁটা নিঃশ্বাসে ধ্বংস হবে নিশ্চিতভাবে।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।