বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ
আমরা ভালো নেই, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় বাংলাদেশে।’ বহির্বিশ্বের নানা প্রান্তে এখন বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাস করেন। এ হৃদয় মথিত আকুতি কিন্তু তাদের কারো নয়Ñ এই পাশের দেশে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কিছু দূরে ভৌগোলিক সীমারেখায় ভিন্ন আরেকটি দেশে বাস করা বহু মানুষেরÑযারা এক সময় জন্মভূমি ত্যাগ করে মান-সম্মান রক্ষা, নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনের আশায় সে দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজ তাদের বেশির ভাগই প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন, বালক যুবক হয়েছেন, যুবক প্রৌঢ় হয়েছেন, প্রৌঢ় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বার্ধক্যের ধূসর বারান্দায়। তারপরও মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে চান অনেকেই। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর সুবিখ্যাত ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় যেমনটি বলেছেনÑ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে’Ñ কবির সেই কাব্যিক কল্পনার রূপে নয় , দেশত্যাগী উদ্বাস্তুরা মানুষের বেশেই ফিরে আসতে চান জন্মভূমির মাটিতে, এই নবান্নের দেশে, আম-কাঁঠালের ছায়ায়।
দেশত্যাগের বিষয়টি বড় দুঃখের, বড় কষ্টের। এত দুঃখ ও এমন কষ্টের যে জীবনে তা কখনো ভোলা যায় না। যারা দেশত্যাগের অবর্ণনীয় পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তারা প্রায় কেউই ভুলতে পারেননি। আমরা স্মরণ করতে পারি যে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দু’টি শব্দের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব মানুষ ভারতে গেলেন তাদের আখ্যায়িত করা হল উদ্বাস্তু, আর ভারত থেকে যারা পাকিস্তানে এলেন তাদের আখ্যায়িত করা হল মুহাজির নামে। সেকালের যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কথায় জানা যায়, তখন সদ্য স্বাধীন দু’দেশে উদ্বাস্তু ও মুহাজিরদের অনিঃশেষ ঢল নেমেছিল। এ ঢলের কোনোদিন শেষ হবে, এ রকম সম্ভাবনার কথা তখন কেউ যেন ভাবতে পারতেন না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং পাক-ভারত যুদ্ধ এক্ষেত্রে আংশিক যতিরেখা টানে। আংশিক বলা এ কারণে যে ১৯৭১ সালের পর ভারত থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মুহাজিরদের আগমন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভারতে উদ্বাস্তু গমন বন্ধ হয়নি এবং যতদূর জানা যায়, এই ২০১৬ সালেও বাংলাদেশ থেকে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাচ্ছেন। তারা সবাই হিন্দু।
গত ১৯ এপ্রিল, ২০১৬ অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলামেইল ২৪ ডটকম ভারত ঘুরে আসা তাদের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রতন বালোর এক সরেজমিন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া বেশ কিছু হিন্দু পরিবারের হাল অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এ রিপোর্টটির পড়তে পড়তে মিশে আছে মানুষের সর্বস্ব হারানোর অপরিসীম বেদনা, প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার অসহ্য কষ্ট, দুঃসহ দুর্ভোগ-ভোগান্তির কথা, অমর্যাদাকর জীবন-যাপনের মর্মন্তুদ বয়ান এবং সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে ফেলে যাওয়া জন্মভূমিতে ফিরে আসার আকুল আকুতি। রিপোর্টটি পড়ে তাদের বর্তমান অবস্থা জেনে অনেকেই ভীষণ কষ্ট অনুভব করবেন।
এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে এসেও শান্তিতে নেই ৯০ ভাগ দেশত্যাগী। তাদের ভাষায় সন্ত্রাসীদের হামলা, হুমকি-ধমকি, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ থেকে রক্ষা পেতেই তারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাদের প্রায় সবাই এখন আছেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু বদলে গেছে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। সেখানে গুরুজনের সম্মান নেই। প্রকাশ্যে বসে মদের হাট। যেখানে সেখানে বসে জুয়ার আসর। মানুষ খুন, অন্যের জমি দখল, হুমকি-ধমকি আর টাউট-বাটপারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন। বিশেষ করে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ফালাকাটা, আলিপুর, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদহ, বালুরঘাটসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এসব অত্যাচার একটু বেশি। আর এসব এলাকায় বাস বাংলাদেশ ত্যাগী হিন্দুদের।
রিপোর্টে কিছু দেশত্যাগী মানুষের হাল অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তাদের একজন হলেন সাধুচরণ সরকার। মানিকগঞ্জ জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের অত্যন্ত সম্পন্ন পরিবারের লোক সাধুচরণ সরকার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোলমালে জড়িয়ে পড়েন। মামলা-হামলা-অত্যাচারসহ নানা হয়রানিতে জেরবার হয়ে নব্বই-র দশকে ভারতে চলে যান পঞ্চাশোর্ধ সাধুচরণ। তিনি বলেন, মানসম্মানের ভয়ে অঢেল ধনসম্পদ ফেলে ভারতে এসেও শেষ সম্মানটুকু ধরে রাখতে পারলাম না। কামলা খেটে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যোগাড় করতে হয়। অভাবের কষাঘাতে সংসার থেকে সুখ দূরে সরে গেছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সুকান্ত পল্লীতে ১০ বাই ১৬ ফুটের একটি ঘরে স্ত্রী ও দু’ ছেলেকে নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন তিনি। গত ২২ মার্চ বিকেলে বাংলামেইল প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সোনার সংসার ফেলে এখন হয়েছি কাঙাল। ছেলে দু’টোকে ঠিকমত লেখাপড়া করাতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছি। আর আমরা স্বামী-স্ত্রী কেরালা-আন্দামান প্রদেশ-মধ্যপ্রদেশে চলে যাই কাজের সন্ধানে। এভাবেই চলছে আমাদের সংসার।”
ভাষাণ সরকার (ভাষাণ মাস্টার) ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়ে অবসর নিয়ে ১৯৮৫ সালে চলে যান ভারতে। এখন আছেন উত্তর দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে। নব্বই ঊর্ধ্ব বয়সের ভাষাণ মাস্টার বলেন, “মাতৃভূমির জন্য এখনো মন কাঁদে। ... এখনো ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখি আমাদের ফেলে আসা গ্রামটিকে।”
পাবনা থেকে যাওয়া প্রবীণ শিক্ষক জ্ঞানরঞ্জন রায় থাকেন গাজোল শহরের নেতাজি সুভাষ পল্লীতে। তার ভাষায়, মান-সম্মানের ভয়ে ৩০ বছর আগে তিনি বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন। তার কথা হচ্ছে, এখানে প্রবীণ ব্যক্তির সম্মান নেই। একজন ভালো শিক্ষকের সম্মান নেই।
রায়গঞ্জ শহরের রূপহারে থাকেন কিরণচন্দ্র ম-ল। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে ৮০ শতাংশ এলাকায় মানুষ প্রকাশ্যে মদ পান করে। প্রকাশ্যে বসে মদের হাট। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার মোড়ে বসে জুয়ার আসর। আমরা মান-সম্মান বাঁচিয়ে সামনের দিনগুলো ভালোভাবে চলতে পারব কিনা এ নিয়ে শংকার মধ্যে আছি।
মানিকগঞ্জের বারারচর ছেড়ে এখন দক্ষিণ দিনাজপুরের নকশাল হাট গ্রামে মাথা গুঁজেছেন গৌরাঙ্গ সরকার। এখনো জন্মভূমির জন্য তার মন কাঁদে।
মানিকগঞ্জের বালিরটেক গ্রামের নিতাই চন্দ্র রায় গাজোলে গিয়ে বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো অবস্থান তৈরি করতে না পারায় বাড়ি বিক্রি করে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। তার মতো আরো অনেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাদের ঘর-বাড়ি বিক্রি করতে চাইছেন। কিন্তু রেশনকার্ড সমস্যাসহ নানা জটিলতায় তা পারছেন না।
বুনিয়াদপুর এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ভক্ত সরকার বাংলামেইল প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা এখানে এসে তেমন কিছুই করতে পারেনি। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। এখানে দেশপ্রেম নেই কারও মনে। যার যার মত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সবাই।’
বাংলামেইলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু সাধুচরণ সরকার নয়। তার মতো যারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের শতকরা ৯০ ভাগেরই এ অবস্থা। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই হিন্দুরা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে অন্তত খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদা, নদীয়াসহ জেলাগুলোতে দেশত্যাগী যে হিন্দুরা বাস করছেন তাদের মধ্যে এখন শুধুই হতাশা।
আমরা ইতিহাসের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার এক বিরাট অংশকে রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন, উন্মুুল করে দিয়েছিল। তৎকালীন পূর্ববাংলার অধিবাসী বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে শুরু করেন। খুব সংক্ষেপে বললে, এর প্রধান কারণ ছিল তাদের এই ভীতিবোধ যে মুসলিম প্রধান দেশে আর আগের মতো নিরাপদ থাকা যাবে না, হিন্দুদের ধর্ম-মান-সম্মান বজায় থাকবে না, মা-বোন-স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করা যাবে না, ধন-সম্পদ রাখা যাবে না। অতএব হিন্দু প্রধান ভারতই ভরসা। অতএব চল চল, ভারত চল। তবে ইতিহাসের সত্য হলো, এপার বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে এ ভীতি সৃষ্টির জন্য অন্তত সে মুহূর্তে মুসলমানরা দায়ী ছিলেন না। বাঙালি হিন্দুদের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা, বিশেষ করে জমিদাররা অবস্থান করতেন কলকাতায়। তারা তখন স¦-সমাজের লোকদের পাশে এসে না দাঁড়িয়ে বরং তাদের দেশত্যাগকেই সমর্থন করেছেন। সেই যে হিন্দুদের দেশত্যাগের শুরু, তা আর বন্ধ হয়নি। একশ্রেণির মুষ্টিমেয় জমি লোভী, বাড়ি লোভী, স্বার্থান্ধ, কুচক্রি মুসলমানের অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত তৎপরতা তাদের অনেকের দেশত্যাগে আংশিক ইন্ধন যোগায়। তৎকালীন সরকার হিন্দুদের দেশত্যাগকে যেমন উৎসাহিতও করেনি তেমনি তা রোধেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হয়তো প্রয়োজনও বোধ করেনি। হয়তো সরকার খুব একটা হিন্দু বান্ধব ছিল না যেমন মুসলিম বান্ধব ছিল না ভারত সরকার। আজ এত বছর পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মনে হয়, সে সময় পাকিস্তান সরকারের উচিত ছিল সম্পূর্ণ মানবিক কারণে শক্ত হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা, তাদের মনে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনা। তাহলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের এত ব্যাপক দেশত্যাগ হতো না। তবে সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে যে তাতে আসলে কাজ হতো কী? ধরা যাক, পাকিস্তান আমলে বৈরি ভাবাপন্ন সরকারের কারণেই হিন্দু ভাইয়েরা জন্মভূমি ত্যাগ করেন। কিন্তু তা কি সত্য? তাহলে বাংলাদেশ আমলে তাদের দেশত্যাগ ঘটল কেন, এমনকি এখনো তা ঘটছে কেন?
অনেকেরই জানা যে ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে ‘৭৪ পর্যন্ত সাবেক পাকিস্তান আমলের দেশত্যাগী হিন্দুদের অনেকেই এসে তাদের পুরনো বাড়িঘর ঘুরে গেছেন, এমনকি কেউ কেউ জবরদখল হওয়া বাড়িঘর-জমি ফেরত পর্যন্ত পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ’৭২-৭৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বলে কার্যত কিছু ছিল না। দু’ দেশের মানুষ বিনা বাধায় চলাফেরা করতেন। বাংলাদেশ আমলে শুধু এ সময়টিতেই হিন্দুরা সম্ভবত সবচেয়ে কম সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর হতাশ হয়ে কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। ’৭৫-এর ঘটনার পরও কিছু হিন্দু উদ্বেগে দেশ ছাড়েন। উল্লেখ্য, হিন্দুদের দেশত্যাগ নিয়ে বহু কথা হলেও একটি বিষয় নিয়ে কিন্তু কেউই বলেন না। তা হলো, হিন্দুরা সম্পত্তি বে-দখল, নানা রকম ভীতি প্রদর্শন, অত্যাচার, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি বা হুমকি ইত্যাদি কারণে থাকতে না পেরে জন্মভূমি ত্যাগ করেন। তারা মনে করেন, ভারতে গেলে তাদের সব কিছু নিরাপদ থাকবে। তা তারা নয় জমি-বাড়ি ছেড়ে-ছুড়ে ভারতে গিয়ে বাকি আর সব বাঁচালেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কুচক্রিরা একইভাবে বাংলাদেশে মুসলমানদেরও জমি দখল, স্ত্রী-কন্যা-বোনকে ধর্ষণ, ভীতি প্রদর্শন করেছে ও করছে। এ মুসলমানরা কোথায় যাবেন? তাদের তো কোথাও যাবার জায়গা নেই। মুসলমানের কাছে মুসলমান সর্বস্ব হারালেও তাকে কিন্তু এদেশেই আহাজারি করে, মানবেতর অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়। কারণ, ভারতে হিন্দুদের জায়গা হয়, মুসলমানদের হয় না।
বাঙালি হিন্দুরা তাদের ভাষায় পাকিস্তান আমলে অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করেছেন, সেই একই কারণে এখনো এই ২০১৬ সালেও তারা দেশত্যাগ করছেন। আজ ৬৯ বছর ধরে তাদের এ জন্মভূমি ত্যাগের বেদনাদায়ক অনিঃশেষ আখ্যান রচিত হয়ে চলেছে। কেউ জানে না এর শেষ কবে। অথচ এ দেশের মুসলমানরা কিন্তু হিন্দুদের দেশত্যাগ চান না। কিন্তু তারপরও তা ঘটছে। কেউ কেউ হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতনের জন্য নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সরকারকে দায়ী করেন। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা একটি বিশেষ অবস্থানে নিজেদের পরিচয় চিহ্নিত করে ফেলেন, সেখান থেকে তাদের কোনোভাবেই আর সরানো যায় না। আজ হিন্দুরা যে অবস্থায় আছেন, জিয়া বা এরশাদের আমলে এর চেয়ে তুলনামূলকভাবে খারাপ অবস্থায় ছিলেন না। যারা বলেন, বিএনপি ও বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে হিন্দুরা ভীষণ খারাপ অবস্থায় ছিলেন, তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলবেন যে বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে তারা সে আমলের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছেন? শোনা যায় যে, বর্তমান সরকারের আমলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে হিন্দুরা উচ্চ থেকে নি¤œপদে সর্বোচ্চ সংখ্যায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু তারপরও কি হিন্দুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ-দেশত্যাগ শতভাগ বন্ধ হয়েছে?
মাতৃভূমি প্রতিটি মানুষের কাছেই পবিত্র স্থান, ভালোবাসার স্থান। বাংলাদেশের মাটিতে যারা জন্ম নিয়েছে এ মাটি তাদের কাছে পরম প্রিয়। এ মাটিতে অধিকার তাদের জন্মগত। তা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। এ দেশের হিন্দুরা যখনি যে পরিস্থিতির শিকার হয়েই দেশত্যাগ করুন না কেন, তা বেদনাদায়ক, সর্বতোভাবে অনাকাক্সিক্ষত। শত শত বছর ধরে এ দেশে হিন্দ-মুসলমান পরস্পরের প্রতিবেশী। সুদীর্ঘকাল সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে এসেছেন তারা। মাঝে-মধ্যে যে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি তা নয়। এমনকি এখনো ঘটছে। কিন্তু দেশত্যাগ তার প্রকৃষ্ট সমাধান নয়। দেশত্যাগের পিছনে থাকে সর্বস্ব হারানোর অনিঃশেষ বেদনা আর বুক ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস। প্রতিটি মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন ব্যক্তির হৃদয়কেই সে বেদনা ভারাক্রান্ত করে। চোখকে অশ্রুসজল করে তাদের দেশে ফেরার আকুতি। বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ সকল অবস্থায় শান্তি ও সম্প্রীতিতে বাস করবে, এটাই সবাই চায়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এ দেশের আহাওয়াকে বিষাক্ত করেনি। এ দেশ কারো একার নয়, সবার। সম্মিলিত জনগোষ্ঠির। হিন্দুদের যাতে দেশত্যাগ করতে না হয়, তারা যাতে জন্মভূমির মাটিতে নির্বিঘেœ বাস করতে পারেন, সরকার তার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবে-এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।