Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুআ : মুমিনের লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

দুআর গুরুত্ব, উপকারিতা ও মর্যাদা:
মানব জীবনে দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মুসীবত, বিপদাপদ, শয়তানের ধোঁকা, দুশমনের ষড়যন্ত্র, অভাব-অনটন, দুশ্চিন্তা, ঋণের চাপ, ক্লান্তি, রোগ-ব্যাধি এবং বিভিন্ন রকমের ফিতনা-ফাসাদ এসেই থাকে। এগুলো মানব জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তাই এগুলো এসে গেলে তা থেকে রক্ষা পাওয়া বা যেন না আসে সে উপায় কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উপায়টি হলো কুরআন-হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন রকমের দুআ ও আমল যথা সময়ে করা। দুআ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে দুআ কর, আমি তোমাদের দুআ কবূল করবো।’ [সূরা গাফির: ৬০] সাহাবী হযরত নুমান ইবনে বশীর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুআ হচ্ছে ইবাদতের উৎস’। এ কথা বলার পর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, তোমাদের প্রভু বলেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে দুআ কর, আমি তোমাদের দুআ কবূল করবো।’ [আবু দাউদ, হাদীস: ১৪৭৯; তিরমিযী, হাদীস: ২৯৬৯; মুসনাদে বাযযার, হাদীস: ৩২৪৩] বর্ণিত হাদীসে ‘দুআ হচ্ছে ইবাদতের উৎস’ এ বাক্যের মর্মকথা হচ্ছে, কেউ যেন এ কথা মনে না করে যে, মানুষ যেমন নিজের বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্য নানা রকম চেষ্ট-সাধনা করে থাকে, দুআও এ ধরনের একটি প্রচেষ্টা মাত্র। যদি তা কবূল হয়ে যায়, তাহলে সে সাফল্য লাভ করল এবং তার সাধনার ফল সে পেয়ে গেল। আর যদি কবূল না হয়, তাহলে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল; বরং দুআর একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট রয়েছে। তা হচ্ছে, ইচ্ছা পূরণের মাধ্যম হওয়া ছাড়াই দুআ নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইবাদত এবং ইবাদতের উৎস। এ দিক দিয়ে দুআ বান্দার একটি মর্যাদা সম্পন্ন আমল। যার প্রতিদান পরকালে অবশ্যই পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে অন্য এক হাদীসে সাহাবী আনাস ইবনে মালিকের বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুআ ইবাদতের সার’ [তিরমিযী, হাদীস: ৩৩৭১] সকল ইবাদতের সার যদি দুআ হয়, তাহলে আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে দুআর মর্যাদা ও গুরুত্ব কি পরিমাণ? সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বাচনিক এক হাদীসেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিকট দুআর চেয়ে প্রিয় অন্য কোন আমল নেই।’ [তিরমিযী, হাদীস: ৩৩৭০ ] উপরোক্ত হাদীস দুটি দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, দুআ ইবাদতের সার ও তা হীরক খন্ডের চেয়েও মূল্যবান। আর ইবাদতই মানব সৃষ্টির মূল ও প্রকৃত উদ্দেশ্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানব ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য।’ [যারিয়াত: ৫৬] তাই এ কথা প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সকল কাজ বা আমলের মধ্যে দুআই সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও মূল্যবান এবং আল্লাহ তাআলার রহমত ও কৃপা লাভের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। সাহাবী ইবনে উমরের বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের থেকে যার জন্য দুআর দরজা খুলে দেয়া হলো, তার জন্য আল্লাহর অফুরন্ত দয়া ও রহমতের দরজাও খুলে দেয়া হলো এবং সুস্থতার জন্য দুআ করার চেয়ে আল্লাহর নিকট আর কোন প্রিয় দুআ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, নিশ্চয় দুআ যে সকল বালা-মুসীবত অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা অবতীর্ণ হবে সকল ক্ষেত্রেই অত্যন্ত উপকার করে। কাজেই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমারা দুআকে খুব শক্তভাবে আকড়ে ধর।’ [তিরমিযী, হাদীস: ৩৫৪৮]

দুআর প্রকৃত অর্থ
দুআ কেবল মাত্র দুআ নামক আবৃত্তির মাধ্যমে আদায়কৃত কতগুলো শব্দ বা বাক্য ঝংকারের নাম নয়। তাকে দুআ পোশাক বা বাহ্যিক আকৃতি বল যেতে পারে। দুআর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, মানুষের আত্মার আকুতি ও অন্বেষণ। উল্লিখিত হাদীসে এ ধরনের দুআর সৌভাগ্য হওয়াকেই রহমাতের দরজা খুলে যাওয়া বলা হয়েছে। যখন বান্দার এ ধরনের দুআর সৌভাগ্য হবে তখন তার জন্য রহমতের দরজাও খোলে যাবে। সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না তার উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’ [তিরমিযী, হাদীস: ৩৩৭৩] সাহাবী জাবির রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজের কথা বলব, যা তোমাদেরকে তোমাদের শত্রু থেকে রক্ষা করবে এবং তোমাদেরকে পূর্ণ জীবিকা দান করবে। তা হচ্ছে, তোমরা দিবা-রাত্রি আল্লাহর নিকট দুআ করবে। কেননা দুআ মুমিনে হাতিয়ার।’ [মুসনাদে আবি ইয়ালী মুসলী, হাদীস: ১৮১২] উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, দুআ মুমিনের লক্ষ্য পূরণের অব্যর্থ হাতিয়ার। সকল ক্ষেত্রেই এ হাতিয়ার ব্যবহার করা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।

দুআ কবূল হওয়ার বিশেষ কয়েকটি সময় ও স্থান:
আল্লাহ তাআলা সব সময় বান্দার দুআ কবূল করে থাকেন। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময় ও স্থান বা মাকামে দুআ কবূল হওয়ার সুসংবাদও রয়েছে। সে সব মুহূর্তে ও মাকামে দুআ করা এবং বিশেষভাবে কবূলের আশা রাখা বাঞ্চনীয়। দুআ কবূল হওয়ার সেই বিশেষ বিশেষ সময় ও স্থানগুলো হচ্ছে এই- ১. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। ২. অযু করে দুই রাকআত নামায আদায়ের পর। ৩. জুমার দিনে জুমার নামাযের দুই খুতবার মাঝখানে ও মাগরিবের নামাযের পূর্ব মুহুর্তে। ৪. শবে বরাতে সূর্যাস্তের পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। ৫.শবে কদরে। ৬. রমযানের প্রতি রাত ও দিন। ৭. আযানের সময়। ৮. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে। ৯. যুদ্ধের সময়। ১০. ইকামতের সময়। ১১. জিহাদে কাতার বন্দীর সময়। ১২. ফরয নামাযের পর। ১৩. কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত ও খতমের সময়।

১৪. ইফতারের সময়। ১৫. আরাফাত দিবসে। ১৬. বৃষ্টির সময়। ১৭. যমযমের পানি পান করার সময়। ১৮. রওজা মুবারক যিয়ারতের সময়। ১৯. ছফা-মারওয়ায় সাঈর সময়। ২০. জামারাতে শয়তানকে কংকর মারার সময়। ২১. মুযদালিফায়। ২২. মিনায়। ২৩. বায়তুল্লায়। ২৪. মসজিদে নববীতে। ২৫. সফা-মারওয়ায়। ২৬. মাকামে ইবরাহীমের কাছে। ২৭. মীযাবে রহমতের নিচে। ২৮. রুকন ও মাকামে ইবরহীমের মধ্যবর্তী স্থানে। ২৯. মুলতাযাম জড়িয়ে ধরা অবস্থায়। ৩০. রুকু-সিজদায়। [মুসলিম, হাদীস: ৪৭৯, ৭৫৮; আবু দাউদ, হাদীস: ৫২১; আসসুনানুল কুবরা, নাসাঈ, হাদীস: ১৭০৯; মুআত্তা মালেক, হাদীস: ২৩৯,৭২৬; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৬০, ৬১, ৩৩৩৪, ৩৫৪২, ৩৫৫৫; আদ দুআ, তবরানী, হাদীস: ৪৮৩, ৪৮৪, ৪৮৫, ৪৮৬, ৪৮৭, ৪৮৮, ৪৮৯, ৪৯০; আত তারগীব ওয়াত তারহীব, হদীস:১৭৬৮]

যাদের দুআ বিশেষভাবে কবূল হয়:
যথানিয়মে দুআ করলে সকলের দুআই কবূল হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষ কিছু মানুষের দুআ বিশেষভাবে আল্লাহ তাআলা কবূল করেন। যেমন: ১. মা-বাবার দুআ। ২. সন্তানের দুআ। ৩. মুসাফিরের দুআ। ৪. মযলূমের দুআ। ৫. রোযাদারের দুআ। ৬. ন্যায়পরায়ণ বাদশার দুআ। ৭. তাওবাকারীর দুআ। ৮. হাজী সাহেবের দুআ ঘরে প্রবেশের পূর্বে। [আবু দাউদ, হাদীস: ১৫৩৬; তিরমিযী, হাদীস: ১৯০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৭৫১০, ১০৭৭১, ১০৭৭২; ইবনে মাজা, হাদীস: ৩৮৬২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৭০৬০; আদ দুআ, তবরানী, হাদীস: ১২৮, ১২৯, ১৫০, ১৮৯, ৪৮৩]

দুআর কিছু নিয়ম-কানুন:
দুআর কিছু নিয়ম-কানুনও বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। দুআ করার সময় সেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। এতে দুআ কবূলের বেশি আশা করা যায়। নিয়মগুলো হলো- ১. যখন অন্য কারো জন্য দুআ করবে, তখন প্রথমে নিজের জন্য দুআ করবে। তারপর অন্যের জন্য দুআ করবে। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরীকা ছিল। ২. হাত তুলে দ্আু করবে। ৩. দুআর সময় হাতের তালু চেহারের দিকে রাখবে। ৪. দ্আু শেষে হাতের তালু মুখের উপর বুলাবে। ৫. দ্আুর পূর্বে হামদ ও সালাত পড়বে। ৬. দুআর শেষে আমীন বলবে। ৭. দুআ করার সময় এই বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ তাআলা আমার দুআ অবশ্যই কবূল করবেন। ৮. দিল ও অন্তরকে আল্লাহ মুখী করে দুআ করবে। কারণ আল্লাহ নিকট গাফেল অন্তরের দুআ কবূল হয়না। ৯. দৃঢ়তার সাথে দুআ করবে। সন্দেহ-সংশয় নিয়ে দুআ করবে না। অর্থাৎ দুআয় এভাবে বলবে না যে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান, তাহলে আমাকে দান করুন; বরং এভাবে বলবে যে, হে আল্লাহ! উহা আমাকে দিয়েই দিন। এভাবে মজবুতীর সাথে প্রার্থনা করবে। ১০. দুআর পর তা কবূলের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করবে না। কিছু মানুষ এমন আছে, যারা দুআ করার পরই তা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তারা মনে করে আমরা যা চেয়েছি তা তৎক্ষণাৎ এসে যাক। ফলে তৎক্ষণাৎ না আসলে হতাশ হয়ে দুআ করা ছেড়ে দেয়। এমনটি করা নিষেধ; বরং ধৈর্যের সাথে দুআ করে যেতে থাকবে। এটাই নিয়ম। [বুখারী, হাদীস: ৭৪৭৭, ৬৩৩৮, ৬৩৩৯, ৬৩৪০; মুসলিম, হাদীস: ২৭৩৫; আবূ দাউদ, হাদীস: ৯৩৮, ১৪৮১, ১৪৮৫, ১৪৮৬, ১৪৯২; তিরমিযী, হাদীস: ৩৪৭৯, ৩৪৭৭, ৩৩৮৫]

দুআ কবূল হয় তিনভাবে:
অনেক মানুষকে দেখা যায় দুআ করার পর কাঙ্খিত বস্তু বা বিষয় পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে যায়। তারা মনে করে আমরা যা চেয়েছি তা তৎক্ষণাৎ এসে যাক। ফলে তৎক্ষণাৎ না আসলে যারপর নাই হতাশা প্রকাশ ও আফসোস করে থাকে। আর মনে মনে বা প্রকাশ্যে বলতে থাকে আমার দ্আু কবূল হয়নি। এ সকল ধারণা ও চিন্তা-ভাবনা মূলত অজ্ঞতা ও মূর্খতার বহি:প্রকাশ। কারণ দুআ তিনভাবে কবূল হতে পারে। ১. দুআ কারী যা চেয়েছে তাই দিয়ে দেওয়া। ২. যা চেয়েছে তা না দিয়ে এরচে উপকারী অন্য কোন বস্তু দিয়ে দেওয়া বা তার সম্ভাব্য কোন বিপদ দূর করে দেয়া হয়। ৩. এ দুটোর কোনটাই না দিয়ে পরকালের জন্য সঞ্চিত রাখা। দুআকারী পরকালে সঞ্চিত দুআগুলো দেখে আফসোস করবেন আর বলবেন, হায়! আমার একটি দুআও যদি দুনিয়ায় কবূল না হয়ে পরকালে জন্য সঞ্চিত রাখা হতো, তাহলে তাই আমার জন্য বেশী উপকারী হতো। সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোন মুমিন বান্দা যদি এমন দুআ করে যাতে কোন গুনাহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার কথা না থাকে, তাহলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনটি বস্তুর যে কোন একটি অবশ্যই দেওয়া হয়। ১. দুআ কারী যা চেয়েছে তাই দিয়ে দেওয়া হয়। ২. তার দুআকে তার জন্য পরকালের সঞ্চিত সম্পদ বানিয়ে রাখা হয়। ৩. তার সম্ভাব্য কোন বিপদ দূর করে দেওয়া হয়।’ [আহমাদ, হাদীস: ১১১৩৩] সাহাবী জাবির রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে বন্দা দুনিয়ার জীবনে অসংখ্য দুআ করেছে কিন্তু বাহ্যত তার অনেক দুআই কবূল হয়নি, সে সকল দুআসমূহের ফল আল্লাহ তাআলা যখন তাকে পরকালে একত্রে দান করবেন তখন বান্দার কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসবে- হায়! আমার কোন দুআই যদি দুনিয়ায় কবূল না হয়ে সকল দুআর প্রতিদান এখানে পেতাম!’ [মুসতাদরাকে হাকীম, হাদীস: ১৮১৯]

নিষিদ্ধ দুআসমূহ:
মানুষ সাধারণত একটুতেই ধৈর্যহীন ও বিচলিত হয়ে পড়তে অভ্যস্ত। ফলে তারা অনেক সময় আল্লাহর দরবারে এমন দুআ করে বসে যদি তা কবূল হয়ে যায়, তাহলে তারই মারাত্মক ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রকম দুআ করতে নিষেধ করেছেন। সাহাবী জাবির রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কখনো নিজেদের উপর, সন্তানদের উপর এবং সম্পদের উপর বদদুআ করবে না। কারণ হতে পারে সেটা দুআ কবূলের সময়। ফলে তোমাদের সে দুআ আল্লাহ কবূল করে নিবেন। [এতে তোমাদের নিজেদের উপর, সন্তানদের উপর এবং সম্পদের উপর কোন বিপদ এসে যেতে পারে। ফলে তোমরা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হবে।] [মুসলিম, হাদীস: ৩০০৯; আবূ দাউদ, হাদীস: ১৫৩২] এভাবে দুঃখ-কষ্ট বা বিপদাপদে পড়ে অনেকেই নিজের মৃত্যু কামনা করে থাকে। ইসলামে এটাও নিষিদ্ধ। সাহাবী আবূ হুরায়রার বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘তোমরা কেউ মৃত্যু কামনা করো না এবং সময়ের পূর্বে মৃত্যু আসারা জন্য আল্লাহর কাছে দুআ কর না। কারণ মৃত্যু এসে গেলে নেক আমলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মুমিনের হায়াত বৃদ্ধি কেবল তার মঙ্গল ও কল্যাণই বৃদ্ধি করে। [তাই মৃত্যু কামনা করা এবং এ জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা মারত্মক অপরাধ] [মুসলিম, হাদীস: ২৬৮২] সাহাবী আনাস রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমদের কেউ যেন আপতিত বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা না করে। যদি কাউকে এমন দুআ করতেই হয়, তাহলে সে যেন এভাবে বলে যে, হে আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা আমার জন্য কল্যাণকর, ততদিন পর্যন্ত আমাকে জীবত রাখুন। আর যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হয়, তখন আমাকে মৃত্যু দান করুন। [মুসলিম, হাদীস: ২৬৮০; তিরমিযী, হাদীস: ৯৭০; ইবনে মাজা, হাদীস: ৪২৬৫] বর্ণিত হাদীসগুলোর ভাষ্যমতে দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মুসীবতে পড়ে মৃত্যু কামনা করা বা এর জন্য দুআ নিষেধ। কারণ তা ধৈর্যের খেলাফ। যে ধৈর্যের অনেক সুফলের কথা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকে, ততক্ষণ তার জন্য তওবা-ইস্তিগফার ও ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র করার এবং নেক আমল ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের পরকালের সঞ্চয় বৃদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ খোলা থাকে। সুতরাং মৃত্যুর জন্য দুআ করার অর্থ হচ্ছে, সে খোলা পথ বন্ধ করার দুআ করা। অতএব মৃত্যুর জন্য দুআ করার মধ্যে মারাত্মক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। অবশ্য অল্লাহর প্রিয় বান্দাদের যখন মৃত্যুর নির্ধারিত সময় এসে যায়, তখন আল্লাহ তাআলার অধিক নৈকট্য লাভের আশায় কখনো সখনো তাদের থেকে মৃত্যু কামনা ও মৃত্যুর জন্য দুআ প্রকাশ পায়। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ইউসূফ আ. এর দ্আু- ‘হে আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা! আপনিই আমার ইহকালীন-পরকালীন অভিভাবক। আপনার আনুগত্যে থাকা অবস্থায় আপনি আমাকে তুলে নিন এবং আপনার নেককার বান্দাদের সঙ্গী করে নিন।’ [সূরা ইউসূফ: ১০১] জীবন সায়াহ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এমন দুআই করেছিলেন। ‘আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার পালার দিনে আমার ঘরে আমার হলকুম ও সীনার মধ্যস্থলে ওফাত লাভ করেন। [আমাদের নিয়ম ছিল] তিনি অসুস্থ হলে আমাদের কেউ সূরা ইখলাছ, নাস, ফালাক পড়ে তাঁর শরীর মুছে দিতেন। নিয়ম অনুপাতে আমি তাঁর কাছে গেলাম সূরা ইখলাছ, নাস, ফালাক পড়ে তাঁর শরীর মুছে দিতে। তখন তিনি তাঁর মাথা আকাশের দিকে উঠিয়ে বললেন,“ফিররাফীকিল আ‘লা, ফিররাফীকিল আ‘লা” [উর্ধ্বলোকের বন্ধুর সাথে মিলিত হতে চাই; উর্ধ্বলোকের বন্ধুর সাথে মিলিত হতে চাই অর্থাৎ আল্লাহর সাথে মিলত হতে চাই] এ সময় [আমার ভাই] আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর আগমন করলেন। তার হাতে ছিল তাজা ডালের একটি মিসওয়াক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে দিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর মিসওয়াকটির প্রয়োজন। আর্থাৎ তিনি মিসওয়াক করতে চাচ্ছেন। তাই আমি আব্দুর রহমানের হাত থেকে মিসওয়াকটি নিয়ে সেটির মাথা চিবিয়ে পরিস্কার করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে দিলাম। [চিবানোর কারণ হলো, তখন মিসওয়াক চিবানোর মতো শক্তি তাঁর গায়ে ছিলনা। যা বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে] তখন তিনি এর দ্বারা আগের মতো [সুস্থ অবস্থার মতো] সন্দুর করে মিসওয়াক করলেন। তারপর তিনি মিসওয়াকটি আমাকে দিলেন। এ অবস্থায় তাঁর হাত হেলে পড়ল বা তাঁর হাত থেকে মিসওয়াকটি পড়ে গেল। এরপর আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা আমার থুথুকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর থুথুর সাথে মিলিয়ে দিলেন তাঁর দুনিয়ার জীবনের শেষ ও পরকালের প্রথম দিনে। [বুখারী, হাদীস:৪৪৫১] সবশেষে এ কথা বলা যায়, দুআ মুমিনের লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার। বিপদাপদ থেকে মুক্তির উপায়। তাই দুআ হোক মুমিনের সর্ব সময়ের উত্তম সঙ্গী।



 

Show all comments
  • ১৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:০৭ পিএম says : 0
    Thanks,
    Total Reply(0) Reply
  • Taslima Asif ১৬ এপ্রিল, ২০২১, ৯:৫৭ এএম says : 0
    Assalamu alaikum , your writing is so nice and reference of Quran hadees were there.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুআ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ