বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
জাতীয় দৈনিক ইনকিলাবের গত ২২ এপ্রিলের শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘ব্যাংকিং খাতের ৭ বছরের চালচিত্র : ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি’। সংবাদটি ইনকিলাবের নিজস্ব প্রতিবেদকের কোনো সন্ধানী প্রতিবেদন ছিল না। আগের দিন অর্থাৎ ২১ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত “ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ, সাবেক ব্যাংকার ও বিশিষ্ট নাগরিকরা যা বলেছেনÑ প্রতিবেদনটিতে তা-ই তুলে ধরা হয়েছিল। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা এ বি আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় অভিযোগ করা হয়, সুশাসনের অভাবে গত ৭ বছরে ৬টি বড় ধরনের জালিয়াতির ফলে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রখ্যাত ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের মোহাম্মদ বখতিয়ার। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সুশাসন নিশ্চিত করা, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া ও ব্যাংকিং খাতকে সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত রাখার সুপারিশ করেন আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারগণ।
২১ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার প্রতিবেদন শুধু দৈনিক ইনকিলাব নয়, প্রায় প্রতিটি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করা ও ব্যাংকিং খাতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া গত ৭ বছরে সম্ভব হয়নি শুধু রাজনীতিবিদদের দলীয় বিবেচনায় প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আনয়নের জন্য। তাছাড়াও রয়েছে শঠতার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের পরে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় না এনে দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের নীরব সমর্থন দান করা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরে বেসিক ব্যাংকেরও দুর্নীতি সম্বন্ধে জানা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক থেকেও জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। সরকার দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে বসিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে ব্যাংকগুলোর তহবিল থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার সুযোগ করে দিয়েছে। ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে সব মহল বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো, গণমাধ্যম ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদগণের পক্ষে পরামর্শ দেয়া হয় যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকিং পেশা থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা হোক। এর পরেও সরকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিচালক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটনায় যারা দায়ী, তাদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের দুজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন, এ সম্বন্ধে জাতীয় সংসদে জানতে চাওয়া হলে অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে অপরাধীদের বিচার করার ব্যাপারে তার অসহায়ত্বই প্রকাশ পায়। গত জুন মাসের ৩০ তারিখে বাজেট পাস করার দিনে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, ‘সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের লোকের সমর্থনের কারণেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।’
পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতায় সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায়ও প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তও কার্যত বন্ধ রয়েছে। গত ছয় বছরে দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তা পাঁচবার বদল করেছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক পর্ষদ চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় জাতীয় সংসদ সদস্যরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো সদস্য এও বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কি আকাশে অবস্থান করছেন যে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
ব্যবসায়িক প্রয়োজন দেখিয়ে বা শিল্প স্থাপনের ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার সংস্কৃতি বাংলাদেশে বহুদিন যাবৎ অনুসৃত হয়ে আসছে। ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে, তখন পর্যন্ত দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত সাত বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে এবং যা আর আদায়যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে না তার পরিমাণ হচ্ছে ৩৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। আর আদায়যোগ্য বলে বিবেচিত না হওয়াতে রাইট অফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৩৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত টাকার সাথে এখনো যা খেলাপি ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়, তা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকারও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের দেয়া ঋণের মোট ৫৬.৬৭%, সোনালী ব্যাংকের দেয়া ঋণের মোট ২৯%, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের দেয়া ঋণের মোট ৪৩%, অগ্রণী ব্যাংকের দেয়া ঋণের মোট ১৯%, কৃষি ব্যাংকের ৩৩% এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দেয়া ঋণের মোট ৩৪% ঋণই খেলাপি ঋণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দেয়া হিসেবে মতে, বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণের হার ১০.৪৭% অর্থাৎ প্রতি একশত টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় সাড়ে দশ টাকাই খেলাপি ঋণ।
দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত সাত বছরে যা বেড়েছে অর্থনীতিবিদগণ তাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রধানত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণ নেয়া হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করার পরিমাণও সকল সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এক হলমার্ক গ্রুপের কথাই যদি ধরা যায়, তাহলে দুদক কর্তৃক অভিযুক্ত ২৭ জন ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মিলে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ উঠিয়ে নিয়েছে প্রায় দেড়শত কোটি টাকা।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, গত সাত বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এর আগেকার ৩৯ বছরের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি। খেলাপি ঋণ গ্রহীতা শিল্প প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করার জন্য জাতীয় সংসদেও দাবি উঠেছে। ২০১০ সালে একবার খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন যে, সংসদ সদস্যরা দাবি করলে পুনরায় তা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু গত এক বছরের মধ্যেও তা প্রকাশ করা হয়নি। ২১ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের উদ্যোগে যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সাবেক ব্যাংকার অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ সমস্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে সরকার ও জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। গণ-মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। সরকার বলে যাচ্ছে, দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন। তা মেনে নিলেও দেখা যায়, স্বাধীন (?) গণমাধ্যমে যা কিছু তুলে ধরা হচ্ছে, সুশীল সমাজ যা বলছেÑ তা আমলে নিয়ে পরিস্থিতির মধ্যে কোনো সংশোধনীমূলক ব্যবস্থা বা প্রতিকার করা হচ্ছে না। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যা বলার বলে যাক, ‘আমরা কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’ এই যদি সরকারের অন্তর্নিহিত মনোভাব হয়, তাহলে যেসব রাজনীতিক এখনো ‘রুটি হালুয়ার’ বখরা পাননি তারাও ব্যাংক লুটের কাজে আদাজল খেয়ে নেমে পড়বেন।
কিছু দিন আগের এক খবরে জানা গিয়েছিল যে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে এই গরিব দেশটির কিছুসংখ্যক ধনী মানুষের সঞ্চায়ের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০১৪ সালে বলা হয়েছিল যে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ধনী ব্যক্তিদের আমানতের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় একচল্লিশ কোটি চল্লিশ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় তা হয়, তিন হাজার একশত বাষট্টি কোটি টাকার সমপরিমাণ। গত দুই বছরে তা নিশ্চয়ই আরো বেড়েছেÑ এটা সহজেই বলা যায়। অতি সম্প্রতি পানামা পেপারস নামে ফাঁস হওয়া এক কোটি দশ লাখ নথিতে বলা হয়েছে যে, বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কগণ ও ব্যবসায়ীরা যেসব দেশে অর্থ সঞ্চিত রাখলে কর দিতে হয় না, সেসব দেশের ব্যাংকগুলোতে নিজ নিজ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে সঞ্চিত রেখেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে দেশের অন্যতম একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এসব ব্যক্তির একটি নামের তালিকা থেকে। উল্লেখ্য, যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছে তাদের কারো পক্ষ থেকেই কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণসহ কোনো প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়নি।
২১ এপ্রিলের আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনরা যা বলেছেন তা হচ্ছে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আর্থিক খাতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এবং পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় মনোনয়ন না দেয়াÑ এই সুপারিশগুলো গ্রহণ করলেই সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।