বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
তারেকুল ইসলাম
একবিংশ শতক ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও সার্বিক মূল্যায়ন বিভিন্ন কারণে প্রাসঙ্গিক। জাতীয় সার্বভৌমত্ব-আত্মনিয়ন্ত্রণ-স্বাধীনতা অর্জনে, প্রতিটি জাতির স্বকীয় সত্ত্বা ও ব্যক্তিত্ব্যের স্ফূরণে জাতীয়তাবাদ একটি অপরিহার্য ও অপ্রতিরোধ্য মতবাদগত শক্তি হিসেবে একসময় পরিগণিত ছিল। জাতিকেন্দ্রিকতা ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয়তাবাদের বিকল্পস্বরূপ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বব্যাপী মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে এক বিশাল উদার মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের বিপুল সম্ভাবনা ও আশাবাদ জাগিয়েছে।
একদা জাতীয়তাবাদী চেতনায় ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পৃথিবীর বহু শোষিত ও নিপীড়িত জাতি বা গোষ্ঠী একদিকে যেমন ঔপনিবেশবাদ-বিরোধী কিংবা নিজেদের জুলুমবাজ সরকারের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে তেমনি নিজেদের সরকার গঠনের পক্ষে এবং রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হওয়ার প্রচেষ্টায় আন্দোলন পরিচালনাও করেছে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক পরাধীন ও অবদমিত জাতি বিভিন্ন সময়কালে সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশি শাসন-শোষণ-পীড়ন, দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্তির জন্য এবং সকল প্রকার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্রতী হয়েছে। তাছাড়া জাতীয় জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে, কোনো জাতির নিজস্বতা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠাকরণে এবং তার আত্মোপলব্ধির দিক-নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল আদর্শ ও শক্তিরূপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতীয়তাবাদÑ বিংশ শতাব্দীতে যার উজ্জ্বলতম প্রমাণ : এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, সুদূর প্রাচ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিপক্ষে লড়াই করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছিল। কিন্তু অপরদিকে সেই বিংশ শতকেই উগ্র, অন্ধ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদ দুটি বিভীষণ মানবঘাতী বিশ্বযুদ্ধ উপহার দেয় এ বিশ্বকে। যার ফলে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ, সামরিকতাবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জাতীয়তাবাদের নামে সৃষ্টি হয় যুদ্ধ, ধ্বংস, নৈরাজ্য, বর্ণবাদ, জাত্যাভিমান, জাতিবিদ্বেষ, জাতিবৈষম্য, জাতিগত অহমিকা ও জাতি বিস্তারের প্রাধান্য। তৈরি হয় রেসিজম। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ অবশেষে হয়ে ওঠে সামরিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পথপ্রদর্শক।
জাতীয়তাবাদের চরম পরিণতির প্রেক্ষাপটে বিকল্প মতবাদ হিসেবে উদ্ভাবিত হয় আন্তর্জাতিকতাবাদ। বিশ্বের বড় বড় তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মনীষীরা জাতীয়তাবাদের এহেন বিকৃতি ও নির্মম পরিণতি দেখে আন্তর্জাতিকতার তত্ত্ব হাজির করেছেন। বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব। এ সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষ সাধনের ফলে এবং বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় নৈকট্য ও সহজলভ্যতা পৃথিবীর অধিকাংশ মানবগোষ্ঠীকে একে অপরের খুব কাছে নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা অতি সহজেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি ও মত বিনিময়ের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো দেশই এখন আর অন্যান্য দেশ থেকে দূরে কিংবা বিচ্ছিন্ন নয়। বরং এক দেশের সাথে আরেক দেশের কূটনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থায় আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী যে-কারো মধ্যেই কট্টর জাতীয়তা ও জাতিবিদ্বেষ তথা রেসিজম ধারণের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে এখানে প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান সময়ে প্রবল আলোচিত-সমালোচিত বিশ্বায়নের কথা না এসে পারে না- বিশেষ করে বিশ্বায়ন আন্তর্জাতিকতাবাদ কিনা সেই প্রশ্নে। গত শতাব্দীর শেষভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনিবার্য বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো ইতিহাস সমৃদ্ধ রাজনৈতিক আদর্শগুলো হয়ে পড়ে আবেদনহীন ও অকার্যকর। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী একাধিপত্য স্থাপনকারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রশক্তিগুলো ‘বিশ্বায়ন’ নামক পরিকল্পিত প্রজেক্ট মোতাবেক পুঁজিবাদী স্বার্থকে সামনে রেখে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা কায়েম করেছে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকেই যদি বিশ্বায়ন বলে অভিহিত করি তাহলেও সেটা অমূলক হবে না; কেননা বিশ্বায়নের মাধ্যমে সবদিক থেকে এই বিশ্বকে ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী করে রাখার একটি সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া চলমান। বস্তুতপক্ষে বিশ্বায়ন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতিমালার অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন, ‘বিশ্বায়নবাদের উদ্ভব ঘটেছে পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার ধারা ধরে। যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সাম্রাজ্যবাদের ধারক, বাহক, বাস্তবায়নকারী ও বিকাশকারী, সেগুলোই বিশ্বায়নবাদেরও উদ্ভাবক, ধারক, বাহক, বাস্তবায়নকারী ও বিকাশকারী। বিশ্বায়নবাদ সাম্রাজ্যবাদেরই সম্প্রসারণ। অত্যুন্নত ও নতুন প্রযুক্তির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নবাদে উন্নীত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতা ও বহুত্ববাদের নামে বিশ্বায়নবাদীরা অবলম্বন করেছে এককেন্দ্রিক বিশ্ববিস্তৃত পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার দূরদর্শী কর্মনীতি’ (বিশ্বায়ন ও বিশ্বায়নবাদী সংস্কৃতি, দৈনিক যুগান্তর)। সুতরাং বিশ্বায়ন যে প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের রক্ষক ও বহুমুখী প্রজেক্ট তা এখন আর অস্পষ্ট নয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বায়ন হলো আন্তর্জাতিকতার মূল লক্ষ্য ও আদর্শের পরিপন্থী।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি পরিচয় : আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় যখন জাতীয়তাবাদের বিকল্পস্বরূপ বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিকতার প্রবল উপস্থিতি ও উদ্ভব, তখন আমাদের বিশেষ একটি রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যবাদী মহল উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে স্ব-স্ব স্বার্থবুদ্ধি চরিতার্থ করতে সঙ্কীর্ণতা ও আদর্শিক গোড়ামির মাধ্যমে অযথা জাতির মধ্যে ক্রমশ বিভেদের প্রাচীর তুলে দিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্যের পরিবর্তে আমরা কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, কেউবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এ দুই স্বার্থান্ধ দলীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মেরুকরণের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি করেছি মাত্র। কিন্তু এটি আমাদের জন্য কল্যাণজনক হয়নি মোটেও, উপরন্তু আমাদেরকে জাতীয় ঐকমত্যের চেতনা থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে বহুদূরে। ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্ব আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। আর স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই ভূ-রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় পরিচয় হলো ‘বাংলাদেশি’। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই ধীরে ধীরে অচল হতে শুরু করে। কেননা এটাই স্বাভাবিক যে, একটি বহুজাতিক ও বহুভাষিক দেশের গোষ্ঠীবিশেষের কোনো একটি নৃতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে যখন রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়, তখন অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সাথে সেটি অবিসংবাদী হয়ে ওঠে। কেননা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে গারো, চাকমা, হাজং, সাঁওতাল ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর পক্ষে বাঙালি হওয়া সম্ভব নয়। বাঙালিত্ব যেমন একটি নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে অপরিবর্তনীয়, তেমনি তাদের নৃ-পরিচয়ও বদলযোগ্য নয়। নৃতাত্ত্বিক পরিচয় প্রকৃতি প্রদত্ত, তাই এখানে কারো হাত নেই। চাইলেও কেউ এটা পরিবর্তন করতে পারে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিচয় বদলযোগ্য, তাই ভারতভাগের সময় আমরা প্রথমে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ধারণ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়েছিলাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতায় আমরা যতদিন ছিলাম ততদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ছিল পাকিস্তানি। এরপর পাকিস্তানের সাথে আমাদের বনিবনা না হওয়ায় আমরা সময়ের প্রয়োজনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। বলা যায়, এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এখন সাবেকী। তাই এখন যৌক্তিকভাবেই আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাঙালি না হয়ে বাংলাদেশি হওয়াই সমীচীন; যেহেতু আমরা বিশ্বস্বীকৃত স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তার অধিকারী। রাষ্ট্রীয় পরিচয় যেকোনো পরিস্থিতির অনিবার্যতায় পরিবর্তিত হতে পারে; কিন্তু নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তনক্ষম নয়। সুতরাং কোনো একটি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা যৌক্তিক হতে পারে না। হ্যাঁ, ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমরা ধারণ করেছিলাম একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ফ্যাসিজম কায়েম করতে চেয়েছিল, তখনই আমরা সময়ের তাগিদে আমাদের বিশেষ নৃ-পরিচয় ‘ভাষা’কে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে রক্তঝরা সংগ্রাম করে মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। মূলত এখান থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলস্বরূপ আমরা সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিক অব্যাহত প্রক্রিয়ায় একাত্তরে এসে স্বাধীনতা-যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছি। কিন্তু আমরা স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তায় উন্নীত হওয়ার পর এবং আমাদের সেই ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের প্রেক্ষাপটগুলো অতীত হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের আর কোনো প্রয়োজনীয়তা বা আবশ্যকতা থাকে কি? স্বাভাবিকভাবেই থাকে না। তো এখন আমরা যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে উগ্রতা ও ফ্যাসিজমের চর্চা করি তাহলে সেটা আমাদের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না; বরং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদ ও সার্বিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে ন্যায়সঙ্গত লড়াই করেছিলাম, ঠিক সেরকম প্রতিক্রিয়া যদি আমাদের দেশের অন্যান্য স্বতন্ত্র ও স্বকীয় জাতিসত্তার অধিকারী ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীদের মধ্যে দেখা যায় তাহলে কি সেটি ন্যায্য হবে না? তাহলে কেন অযথা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা শোভেনিজমের চর্চা করে আমরা জাতীয় জনসমাজের মধ্যে অনৈক্য কিংবা পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টি করবো? কেন বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করবো? আমরা নিশ্চয়ই চাই না যে, আমাদের দেশের কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হোক। সুতরাং উগ্র বাঙালি জাতীয়তার জিগির তুলে তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলার চেষ্টা না করাই শ্রেয়।
উল্লেখ্য যে, ‘ভাষা’ জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সত্ত্বেও এককভাবে এই নৃ-পরিচয়টিকে কেন্দ্র করে একটি জনসমাজের জাতীয়তাবোধ পূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করে না। বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন, আত্মিক ঐক্য, রাষ্ট্রীয় সংগঠন এবং রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষা ইত্যাদির সমন্বিত রূপই হলো একটি জনসমাজের জাতীয়তাবোধ। সুতরাং এককভাবে বিশেষ একটি নৃ-বৈশিষ্ট্য জাতীয়তাবোধের সামগ্রিকতা ধারণ করে না।
জাতীয়তাবাদ একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। জাতীয়তাবাদ কোনো একটি পরাধীন ও অবদমিত জাতির মধ্যে মানসিকভাবে তীব্র আবেগ ও অনুভূতির সঞ্চার করে। এই আবেগ ও অনুভূতির জাগরণে তারা স্বাজাত্যবোধ, জাতীয়তাবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধে উন্নীত হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই তারা নিজেদের রাষ্ট্রগঠন অথবা নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে নিজেদের মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জন করে থাকে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতা-যুদ্ধ পর্যন্ত আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত ছিলাম বটে, এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও বহুজাতিক রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ নৃ-বৈশিষ্ট্যকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া মোটেও বিবেচনাপ্রসূত হয়নি। তারা এটা মেনে নিতে পারেনি। তাই অবধারিতভাবেই তারা নিজেদের স্বতন্ত্র নৃ-বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অস্তিত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করবে এবং করছেও। এমনকি উগ্র ও অন্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কারণে বর্তমানে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর উপাদান তথা ইসলাম বা মুসলমানিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। অর্থাৎ কেউ যদি এখন নিজেকে ‘বাঙালি’ হওয়ার চেয়েও বেশি মুসলমান ভাবতে চায় তাহলে সেটাও তার জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তখন হয়ত পাকিস্তানি ভূত বলেও তাকে অপবাদ দেয়া হতে পারে। এটা যে স্রেফ রেসিজম তথা জাতিবিদ্বেষ, জাতিবৈরিতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পাকিস্তানি জাতির প্রতি অব্যাহত ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়ায় আমরা প্রকারান্তরে জাতিগত বিদ্বেষ ও জাতিবৈরিতা পোষণ করছি। আর তাছাড়া না বললেই নয় যে, বাঙালি সংস্কৃতির নামে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে হিন্দুয়ানি উপাদান-উপসর্গের আধিপত্য বিস্তৃত করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চেতনা ও আক্বিদা-বিশ্বাসে চিড় ধরানোর অপচেষ্টা বাঙালি জাতীয়তার ধ্বজাধারী কথিত ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সুদূরপ্রসারী ইসলামবিরোধী পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ।
অন্যদিকে, কেউ যদি এখানে ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বের সাথে ধর্মীয় সত্তা তথা ইসলামের বিরোধ তুলতে চায়, তাহলে অবশ্যই সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মুসলমানি পরিচয়ের কারণে আমাদের বাঙালিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ বা আশঙ্কা নেই। আশঙ্কা যদি থেকেই থাকে তাহলে সেটি আমাদের নয়, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ভারতীয় বাঙালিদের। কারণ তাদের ওখানে হিন্দি আর ইংরেজির দৌরাত্ম্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি অস্তিত্ব হারানোর মুখে রয়েছে। অন্ততপক্ষে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের সেই আশঙ্কা নেই। তাই আমরা অতিসত্তর সঙ্কীর্ণ ও সাস্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিহার করে এবং দলীয় ও মহলবিশেষের হীন রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে যতদ্রুত সম্ভব সর্বজনীন বাংলাদেশি রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে গ্রহণ করবো তত তাড়াতাড়ি আমরা জাতীয় ঐকমত্যেরভিত্তিতে অসমাপ্ত জাতিগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য কাজটি নির্বিঘেœ সেরে ফেলতে পারবো। পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদ পরিহার করে আমরা প্রত্যেকে যদি আন্তর্জাতিকতার ধারণা পোষণ করি তাহলে আশা করি সেটাই আমাদের জন্য সামগ্রিকভাবে কল্যাণজনক হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।