Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন

গ্রামে সকালে বিদ্যুৎ চলে যায় আসে সন্ধ্যায়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

আশ্বিন মাস যেখানে সন্ধ্যা ও ভোর রাতে শীত পড়ার কথা সেখানে খরতাপে পুড়ছে দেশের মানুষ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র গরম ও লোডশেডিংয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছে। রাজধানীতে প্রতিদিন সকালে ১৫ মিনিট, দুপুরে একঘণ্টা, বিকেলে ৩০ মিনিট, সন্ধ্যায় ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ থাকছে না। এলাকাভেদে রাত ১২টায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর রাত আড়াইটায় আসে। আবার সকালে বিদ্যু চলে যায়। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় চলছে লোডশেডিং। গ্রামের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অনেক এলাকায় ভোর বেলায় বিদ্যুৎ থাকে না বললেই চলে। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ এলেও কিছুক্ষণ পর আবার চলে যাওয়ায় অতিষ্ঠ গ্রামের মানুষ। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ বিভিন্ন এলাকার জনগন। এদিকে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমানে ৯৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায়। ২০২১ সালে দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। গতকাল শনিবার বিকালে গণভবনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লায়ন্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোনিবেশ করি। কিন্তু ২০০৮ সালে ফের ক্ষমতায় এসে দেখলাম বিদ্যুৎ উৎপাদন যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখান থেকে কমে গেছে। আমি বুঝলাম না কিভাবে সেটি কমে। এখন আর বিদ্যুৎ কমে যায় না বাড়ছে।

প্রতিদিন কমপক্ষে ছয়-সাত ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর লোডশেডিং বেশি হয়। গত দুই দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হলেও গরম কমছে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে তাতে, বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ীই ভারতের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আনবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫০০-এর স্থলে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনলেও পুরো ৫০০ মেগাওয়াটের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আবার যদি ভারত কোনও কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করতে পারে, তাহলে আনুপাতিক হারে ক্যাপাসিটি চার্জ কম নেবে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি খাতায় লোডশোডিং নাই। যে টুকু হচ্ছে তা লাইনের কারণে। তিনি বলেন. আগের তুলনায় এখন বিদ্যুৎ লোডশোডিং কমে গেছে। আমরা সেটাও সমস্যা সমাধনের জন্য কাজ করছি। এখন মানুষ বিদ্যুৎ না নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আগের মতো নয়। প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়, ২০০৯ সালের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ২০ হাজার ১৩৩ মেগাওয়াট। নয় বছরে বাড়ছে ১৫ হাজার ১৯১ মেগাওয়াট। গত মাসের ১৯ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১১হাজার ৬২৩ মেগাওয়াট। এছাড়া ২০০৯ সালে সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার। বর্তমানে সঞ্চালন লাইন বাড়িয়ে ১১হাজার ১৫৩ হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে ১১৬০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার তা বাড়িয়ে এখন হয়েছে ৪ লাখ ৭১ হাজার। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৮ লাখ বর্তমানে তা বাড়িয়ে দাড়িয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ। ২০০৯ সালে সেচ সংযোগে সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার এখন তা বাড়িয়ে দাড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার। বর্তমানে সামগ্রিকভাবে সিষ্টেম লস নাই।
এদিকে পিডিবির দাবি, সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের উৎপাদনও সমান পরিমাণ হচ্ছে। কোথাও কোনও লোডশেডিং নেই। এরমধ্যে ঢাকায় মোট বিদ্যুতের চাহিদা ৪ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে এক হাজার ৩৪, খুলনায় ১ হাজার ৩৬৯, রাজশাহীতে ১ হাজার ২২৩, কুমিল্লায় ৯২৪, ময়মনসিংহে ৭৪২, সিলেটে ৪৭৭, বরিশালে ২৯৯ এবং রংপুরে ৫৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের কোনও সমস্যা নেই। শুধু মোহাম্মদপুর আদাবরের কিছু অংশে একেবারে ছিল না। ৫০ মিনিট পর ঠিক হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, আমাদের কোনও লোডশেডিং নেই। ঢাকা শহর জরাজীর্ণ, ওভারহেড লাইন। ফলে ইন্টারনাল ফল্টের কারণে কোথাও কোথাও সমস্যা হতে পারে। ১ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
রাজধানীতে এলাকাভেদে ২ থেকে ৪ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানি-ডিপিডিসির বিতরণ এলাকা মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকার ওয়ারী, চানখাঁরপুল, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, ফার্মগেট, গ্রিন রোড, মগবাজার, ফার্মগেট, ধানমন্ডিসহ আশপাশ এলাকা। ডিপিডিসির এলাকায় আকর্ষিক লোডশেডিং বেড়েছে।
ঢাকার আরেক বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি-ডেসকো। এ সংস্থার বিতরণ এলাকা উত্তরা, বনানী, গুলশান, মিরপুর এলাকায়ও নিয়মিত লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানির এলাকায় গড়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। ডিপিডিসি ও ডেসকোর গ্রাহক সেবাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদেরকে প্রতি জোনে পর্যায়ক্রমে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদ সারওয়ার জানান, াহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। ফলে লোডশেডিং করা ছাড়া উপায় নেই। কিছু কিছু এলাকায় হচ্ছে। তবে সব স্থানে নয়। উৎপাদন ক্ষমতা গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য উদযাপন করেছে সরকার। তাহলে লোডশেডিং কেন? এর উত্তরে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গড়ে কমবেশি প্রতিদিন ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ করা হচ্ছে। প্রকৃত চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেশি। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে আরও কয়েক বছর লাগবে।
ঢাকার দুই বিতরণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) জানায়, তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিচ্ছে। কোনও লোডশেডিং হচ্ছে না। তবে কোনও কোনও এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে লাইন ও ট্রান্সফরমার সমস্যার কারণে। অন্যদিকে, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) বলছে লাইনের সমস্যার কারণে তাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কথা বলতে গিয়ে উত্তরার বাসিন্দা গালিব হোসেন বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যায় একবার, রাত ১২টার দিকে একবার, এরপর রাত আড়াইটার দিকে আবারও বিদুৎ চলে যায়।’ একই অভিযোগ করেন বাড্ডার এলাকার বাসিন্দা আরিফ খান। তিনি বলেন, রাত তিনটার দিকে একবার আবার ভোর ৫টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। বসিলা ও মোহম্মদপুর, মিরপুর, সাভার এবং আমিনবাজার এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজধানীর মকবাজার এলাকার কামাল হোসেন বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে রাতে পর পর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। আসছে ঘণ্টাখানেক পর। রাতে ১১টা ২০মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া পর এসেছে রাত ২টার দিকে। এ সময় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বনশ্রী কন্ট্রোল রুমের মোবাইল নম্বরে অন্তত ৫০বার ফোন করলেও কেউ রিসিভ করেনি। প্রতিদিন একই সময়ে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে আবার আসাকে লোডশেডিং ছাড়া আর কী বলা যায়?’
সূত্র মতে, সারাদেশের ১২৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৪৫ মেগাওয়াট। এরসঙ্গে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে এমন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১৭ হাজার ৬০৫ মেগাওয়াট।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও চাহিদার চেয়ে তা কম। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করা হচ্ছে না। সক্ষমতার কথা বিবেচনা না করেই গণহারে সংযোগ বাড়ানো হচ্ছে। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লোডশেডিং

২৮ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ