বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. ইশা মোহাম্মদ
গণসমর্থনহীন উন্নয়নের দায়ে রাজনৈতিক দল অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের বোধের স্তরের সাথে উন্নত সমাজের বোধের স্তর একই সমতলে না থাকার কারণে সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের বোধকে পাত্তা দিতে হয়। অনেকেই স্বৈরতান্ত্রিক মডেলে উন্নয়ন চাপিয়ে দিতে চায়। তারা সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা হারায়। তা ছাড়া যে কাজ কৌশলে করা যায় সে কাজে জবরদস্তি না করাই তো ভালো। কদিন আগেই গুলি চালানো হয়েছে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ওপরে। কয়েকজন মারাও গেছেন। গুলি না চালিয়েও তো ওই কাজটি কৌশলে করা যেত। জমির যা দাম তার চেয়েও বেশি দাম দিলেই কৃষকরা নিজেরাই দলিল করে জমি দিয়ে যেত। এখন আর ব্রিটিশ মডেলে জমি অধিগ্রহণের দিন নেই। ব্রিটিশদের যে অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত আছে, তার মধ্যে জমি অধিগ্রহণের কথাও আছে। তারা অনেক কম টাকা দিত। পাকিস্তান আমলেও জমির বাজার দরের চেয়েও কম দামে জমি অধিগ্রহণ করা হতো। এখনো তাই-ই হয়। অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা পেতে অনেক ঘুষ দিতে হয়। ন্যায্য দাম কখনই পাওয়া যায় না। যা করতে হয়ে তা হচ্ছে জমির দামের দ্বিগুণ, তিনগুণ দাম থাকতে হবে। যার জমি সে নিজেই টাকা নিয়ে দলিল করে দিয়ে যাবে। সময় বেঁধে দিলে যারা বুদ্ধিমান তারা ঠিকই দলিল করে দিয়ে যাবে। যখন দেখা যাবে যে, এলাকার অধিকাংশ লোকই দলিল করে দিয়েছে, তখন বাকিরাও একই পন্থা অনুসরণ করবে। প্রকল্প যদি বহুগুণ লাভজনক হয়, তবে প্রকল্পের ব্যয়েই জমির বেশি দাম ধরা থাকলে দোষ কি?
কৃষকের ভয় থাকে। তারা জমি হারালে আর জমি কিনতে পারবে না। কিন্তু যদি হারানো জমির পরিবর্তে দ্বিগুণ জমি পায় তবে তাদের ভয় থাকবে না। মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার উন্নয়ন করুক আর না করুক ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত থাকে তখনই, যখন তাদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়। সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে তাদের দাবির অসারতা প্রমাণ করা যায় না। জমি অধিগ্রহণ সিস্টেম আজকালকার দুনিয়ায় আর চলে না। রাষ্ট্রের জমিতেই প্রকল্প করতে হবে। অনেক জায়গাজমি আছে, যেগুলো বেদখল হয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করে তার আশপাশের জমি ন্যায্য মূল্যে বা দ্বিগুণ দামে কিনে নিয়ে প্রকল্প করা যায়। যেসব জমি ডিসিআর কেটে লিজ দেয়া হয়েছে, সেগুলো উদ্ধার করা খুবই সহজ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সারাদেশেই প্রায় অর্ধেক জমি রাষ্ট্রীয় ছিল। অ-হল্য, নিষ্কর ও রাষ্ট্রীয় জমি উদ্ধার করা হলে সরকারের আর জমির জন্য মারামারি করতে হবে না। যে এলাকায় গোলাগুলি হয়েছে, সে এলাকাতেও সরকারি খাস জমি আছে। খাস জমি দখল করা দোষের কিছু নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায় আছে, সরকার জমি নিলে অনেক টাকা দেয়। যেমন মুঘল আমলে স¤্রাটরা বাজার দরের চেয়েও বেশি দামে জমি কিনে নিত। কেতাবী মতে মুঘল বাদশাহরা রাজ্যের সব জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জনহিতকর কাজের জন্য টাকা দিয়ে জমি কিনতেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব জমি কিনে মসজিদ করেছিলেন। অধিগ্রহণ করেননি। মুঘলদের শাসনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বাঙালিরা ব্রিটিশ অধিগ্রহণ সিস্টেম পছন্দ করেনি। অত্যাচার হলে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এখনও যদি ব্রিটিশ অধিগ্রহণ সিস্টেম চাপিয়ে দেয়া হয় তবে কী হতে পারে? হাসিনার সরকার গণঘৃণার শিকার হবে।
যাদের জমি নেওয়া হবে, তারা ওই প্রকল্প থেকে বিশেষ কী সুবিধা পাবেÑসেটাও নিশ্চিৎ করা প্রয়োজন? বিশেষ সুবিধা পেলে তাদের আগ্রহ থাকবেই। ফিলিপাইনে একটা তেলক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত তেলের একটি বড় অংশ ওই গ্রামের লোকজনের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। এটি একটি উদাহরণ। সারা বিশ্বেই এরকম উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে নেই। কেননা, সেখানে মরুভূমি থেকে তেল তোলা হয় এবং বাদশাহ পুরো বাদশাহীর মালিক। এ ধরনের শাসন অন্যত্র চলে না। যদি সরাসরি কোনো লাভ ভূমির মালিকরা না পায় তবে অন্তত জমির দাম বেশি পেলেও খুশি হবে। গরিব কৃষককে দুটো পয়সা বেশি দিলে কি সরকার দেউলে হয়ে যাবে?
উন্নয়ন ধারণায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত। আবার জনগণের জন্য ভয়ংকর হয় এমন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প পরিত্যাগ করা উচিত। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
যদিও পারমাণবিক চুল্লির প্রয়োজন আছে। তবুও বারবার ভেবে দেখার বিষয়ও আছে। যদি মহাপ্রলয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটে তবে বাংলাদেশ এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে। সাধারণত এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয় জনবিরল জায়গায়। প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। জনমানবশূন্য স্থানে প্রকল্প তৈরি করা হলে ধ্বংসযজ্ঞের সময় অহেতুক প্রাণহানি এড়ানো যায়। আমরা তো চেরনোবিলের ঘটনার কথা জানি। এখনও সেখানে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়ের দ্বারা প্রাণ হরণ চলছে। সম্ভবত আগামী কয়েকশ বছর সেখানে জীবিত প্রাণী বাস করতে পারবে না। রাশিয়া ভৌগোলিকভাবে বিশাল। সেখানে মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জায়গা আছে। বাংলাদেশ ভৌগালিকভাবে খুবই ছোট। জনবসতি খুবই ঘন। এখানে মানুষজন সরিয়ে নেয়ার জায়গা নেই।
বলা হচ্ছে, প্রকল্পটি খুবই নিরাপদ। কিন্তু দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন কোনো কেতাবী নিরাপত্তা ঠেকাতে পারে না। যেমন জাপান অতি সাবধানে পারমাণবিক চুল্লিগুলি তৈরি করেছিল। তারা সুনামির চিন্তা মাথায় রাখেনি। সুনামির কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা থেকে সহজে তারা রেহাই পাবে না। জার্মানি পারমাণবিক প্রকল্পই বাতিল করেছে। বিশ্বের অনেক দেশই ভাবছে পারমাণবিকের বিকল্প। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এক সময় অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে। সে সময় আজকে যারা লাফালাফি করছেন, তারা বোকা সাজবেন। বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে সুলভ বিকল্প পাওয়া যাবে। কয়লা পুড়িয়ে এলাকা দূষিত করা আগামী দিনে লজ্জার বিষয় হিসেবে বর্ণিত হবে। বাংলাদেশ ইচ্ছে করলেই উত্তরের উচ্চতার সুবিধা নিয়ে প্রাকৃতিক সুবিধা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ নিতে পারে। নেপাল কিংবা তিব্বতও বিদ্যুৎ দিতে পারবে। হিমালয়ের হিমবাহ তাপে জল করে সেই জলপ্রবাহের শক্তিতে বিদ্যুৎ তৈরি করা খুবই সম্ভব। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে না। চীনের সাথে চুক্তিও করা যেতে পারে।
পারমাণবিক চুল্লি বাংলাদেশে এক সময়ে প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিরল জনবসতি এলাকায় তৈরি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের মধ্যখানে তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশে অনেক মূল্যবান খনিজ আছে। সারা বিশ্বই এক সময় এসব মূল্যবান খনিজের জন্য পাগল হবে। সে সময় বাংলাদেশের মূল্যবান খনিজ পারমাণবিক চুল্লির মাধ্যমে পণ্যে পরিণত করে বিশ্বময় বিক্রি করা যাবে। সাধারণ হিসেবে দেখা যায়, ইউরেনিয়াম রেডিয়ামই আছে হাজার বছরের ব্যয়ের সমান। এগুলো পণ্যে পরিণত করে কেবলমাত্র বাজারজাত করার অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু পারমাণবিক চুল্লির বিপদের আশঙ্কা সব সময়ই বর্তমান। সে কারণে পাহাড়ের মধ্যখানে তৈরি করলে বিপদ ঘটলেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না। উন্নয়নের নামে পরিবেশকে বৈরী না বানিয়ে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। উন্নত দেশের দেখাদেখি উন্নয়ন প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে, এমনটি মনে করা উচিত নয়। বরঞ্চ আমাদের জন্য লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব প্রকল্প চিহ্নিত করে সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সুন্দরবন ধ্বংস না করে কি অন্যত্র তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা যায় না? বিকল্প চিন্তা না করে জেদ ধরা কি ভালো? সুন্দরবন আগামী দিনে আমাকে অনেক কিছুই দেবে। কোনো বিশেষ মহলের শুভেচ্ছার জন্য বন ধ্বংস করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তৈরি করা উচিত নয়। কোনো কোনো কাজ আছে, যার কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অহেতুক জনপ্রিয়তা হারায়। আমাদের উচিত নয় সে কাজগুলো করা। বিরোধী দল এখন কোণঠাসা। তারা আন্দোলনের কোনো ইস্যুই পাচ্ছে না। তাদের হাতে আহ্লাদ করে ইস্যু তুলে দেওয়া ঠিক নয়। আগামী নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ তো এখন থেকেই করতে হবে। অনেক সময় আবেগের বশে ছোটখাটো ভুল হয়ে যায়। যা পরিণামে বড় ভুলে পরিণত হয়। আর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এমন কোনো কাজই করা ঠিক হবে না। নেতৃত্ব তো জানেইÑভেবেই কাজ করতে হয়। করে ভেবে খুব একটা লাভ হয় না।
য় লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।