স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে যেসব ইসলামী উৎসব, তার মধ্যে ফিতর ও ঈদুল আজহা প্রধান। এই দু’টি পর্ব সমগ্র মুসলিম জাহানেরই জাতীয় আনন্দ-উৎসব। ঈদুল ফিতর আত্মসংযম ও সমমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে, আর ঈদুল আজহা আত্মোৎসর্গের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সমসাময়িককালেই । প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সঙ্গে আরব দেশের নৌপথে নিবিড় বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদেই আরব বণিকগণ হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলেই বাংলাদেশে ইসলামের বার্তা বয়ে নিয়ে আসেন। এও জানা যায় যে, চীন ও সুমাত্রা অঞ্চলে নৌপথে বাণিজ্য জাহাজে গমনকারী কোনো কোনো সাহাবায়ে কেরাম সফর বিরতি করেছেন বাংলাদেশের উপক‚লীয় সমুদ্র বন্দরে। তবে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচারের সূত্রপাত ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে। ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের মননকে যে পরিচ্ছন্ন চেতনায় উদ্ভাসিত করে, যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, তা অতি দ্রæত প্রসারিত হতে থাকে এ দেশের বৃহৎ অংশে। এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বহুত্ববাদের দীর্ঘকালীন নিগড় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে একাত্মবাদের মুক্ত সড়কে এসে সত্যিকার জীবন জোয়ারে আপ্লুত হয়। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অচলায়তন। সত্য-সুন্দরের সুলন্দ আওয়াজে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আঙিনা। ইসলামের ঈমান-আকিদা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অনুশাসনের প্রভাবেÑ যা কালে কালে এদেশী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের স্বকীয় পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।
ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিপ্লবাত্মক প্রভাব ফেলে আসছে সেই আদিপর্ব থেকেই। ঈদুল আজহা এমন এক আনন্দ-উৎসব যা শুধু জীবনকে জানার এবং উপলব্ধি করার প্রেরণাই দান করে না, বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নৈকট্য লাভের পথও প্রশস্ত করে দেয়। ঈদুল আজহা বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ নামেই সমধিক পরিচিত। একে বকরি ঈদও বলা হয়। আরবি কুরবান শব্দটির অর্থও নৈকট্য। অন্যদিকে, ঈদুল আজহার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জবেহের আনন্দ-উৎসব। যে উৎসবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দেয়া হয় এবং যার মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত বা নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয় সেটাই কোরবানির ঈদ।
কোরবানির ঈদ বাংলাদেশে বকরি ঈদ নামেও পরিচিত। আরবি বাকারা শব্দের অর্থ গাভী। কেন ঈদুল আজহা বাংলাদেশে গরু কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত হলো সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়। এর পেছনে এই দেশের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটও লুকিয়ে রয়েছে। এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলিম। তাদেররই চিন্তা-চেতনা, আনন্দ-আহ্লাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ এ দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে সংস্থাপিত করছে শক্ত বুনিয়াদের উপর। কোরবানির সঙ্গে তাদের জাতীয় ঐতিহ্য, চেতনা এবং জাতীয় সংহতির সম্পর্ক গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু কোরবানি তো গরু ছাড়া ছাগল, ভেড়া, মহিষ দ্বারাও হতে পারে। সে সবের বদলে গরুকে ঘিরে এ দেশে কোরবানির মূল প্রথা গড়ে উঠার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। এর একটি কারণ, এ দেশে মহিষের তুলনায় গরুর সহজলভ্যতা। দ্বিতীয়ত, ছাগল বা ভেড়া মাত্র একজন লোক কোরবানি দিতে পারে। তার স্থলে গরু সাতজন মিলে দিতে পারে বলে তা তুলনামূলকভাবে সস্তাও হয়। এ দেশের একটি বিশেষ সম্প্রদায় যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা করছে আদিকাল থেকেই। তরা গরু কোরবানির বিরোধিতা করেছে। তাদের কেউ দিয়েছে ধর্মীয় যুক্তি, কেউ অর্থনৈতিক। ধর্মীয় যুক্তির উত্তরে মুসলমানদের বক্তব্য ছিল, তারা তো অন্য কোনো সম্প্রদায়ের উপর গো-হত্যা চাপিয়ে দিচ্ছে না। অর্থনৈতিক যুক্তিও ধোপে টেকে না, কারণ গরু যখন মরণশীল প্রাণী, মরার পর গরুকে শিয়াল শকুনের খাদ্য করার আগে বেঁচে থাকতে জবেহ (কোরবানি) বরে মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করাই অধিক মানবিক ও ইকনমিক হয়। বাংলাদেশে এসব বাস্তবতার নিরিখেই গো-কোরবানি অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে।
এ দেশে ইসলামের আগমনের প্রথম পর্যায় থেকেই মুসলিম সমাজের উপর আক্রমণ এসেছে কখনো পরোক্ষ, কখনো প্রত্যক্ষভাবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব আগ্রাসন রুখে দাঁড়াতে মুসলমানরা তাদের স্বাতন্ত্র্য ও ঐক্য চেতনাকে জোরদার করেছে। সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে সেসব উপাদান কাজ করেছে, যেসব উপাদান মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা দান করেছে তাঁর মধ্যে কোরবানির ঈদ অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই ঈদুল আজহার গরু কোরবানির ঈদ নামকরণ লাভ করে। মুসলিম মননকে বিপ্লবী সহাসড়কে এক সুদৃঢ় ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে এবং তাদেরকে আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে বাংলার জমিনে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে।
আমরা যদি ইতিহাসের আরো পেছনে ফিরে তাকাই, তা হলে দেখব সেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে যখন এ দেশে সুসলিম হওয়ার অপরাধে হিন্দু রাজার হাতে কোথাও কোথাও অত্যাচারিত হতে হয়েছে। এমন কি সিলেটে বুরহানুদ্দীন নামক এক মুসলিমকে গরু কোরবানির অপরাধে রাজা গৌরগোবিন্দের নির্দেশ জল্লাদের খাঁড়ার আঘাতে হারাতে হয়েছে শিশুপুত্রকে। গরু কোরবানির অপরাধে বুরহানুদ্দীনকে বন্দী করা হয়েছে, তাঁর উপর নির্দয়ভাবে চালানো হয়েছে অত্যাচার। প্রহারে প্রহারে তাঁর সমস্ত দেহ জর্জরিত করা হয়েছে, শুধু তাই নয়, যে হাত দিয়ে তিনি গরু কোরবানি করেছিলেন, সেই হাতও কেটে দেয়া হয়েছে। তাঁর নবজাতক শিশুসন্তানকে তাঁর সামনে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। এই করুণ খবর শুনে জালিম রাজা গৌরগোবিন্দকে শায়েস্তা করতে এসেছেন এক বিশাল মুসলিম বাহিনীর মধ্যমণি হিসেবে হজরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি’। সেই বাহিনী রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করেছে এবং সিলেটের জমিনে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছে। সিলেট গড়ে উঠেছে এ দেশের রূহানি রাজধানী রূপে।
ঈদুল আজহার নামকরণ গরু কোরবানির ঈদ যে কারণেই হোক না কেন, এর মধ্যে যে এক সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিহিত ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ দেশের মুসলমানদের আপন সত্তা বিকশিত করার ক্ষেত্রে বকরা ঈদ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এই পশু কোরবানির সময় মুসলিম উচ্চারণ করে আমার সালাত ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। এই উচ্চরণ তাকে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করতে সাহস যোগায়। তৌহিদের আসল অর্থ সে বুঝতে পারে, বারবার তার হৃদয়ের গভীর থেকেই উচ্চারিত হয় লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
ঈদুল আজহা পশু কোরবানির মধ্যদিয়ে সামাজিক বিপ্লবের পথও প্রশস্ত করে দিয়েছে বাংলাদেশে। ব্রিটিশ ভারতে গরু কোরবানির বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন চালিয়েছে হিন্দুসমাজ। হিন্দু জমিদারগণ তাদের জমিদারি এলাকায় গরু কোরবান কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে হিন্দু জমিদারি এলাকায় গর কোরবানি করা তখন ভীষণ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর যে মহাবিপ্লবী জিহাদি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল গরু কোরবানির উপর হিন্দু জমিদারের নিষেধাজ্ঞা সমূলে উৎখাত করা।
ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে এর উপস্থিতি অবলোকন করলেই। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানরা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করে আসেন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই। ব্রিটিশ ভারতে আমরা কবি কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী প্রমুখ কবিদের লেখায় আত্ম কোরবানির প্রতীক রূপে কোরবানির ঈদকে দেখতে পাই। অনল প্রবাহের কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিজের জান কোরবানি দেয়ার শপথ গ্রহণ করতে জাতিকে আহবান জানান।
বাংলা সাহিত্যে কোরবানির ঈদকে ব্যাপকভাবে এবং সঠিক পরিচয়ে উপস্থাপিত করেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কোরবানির উপর তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন। তিনি এক স্থানে বলেন, ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ইব্রাহিমের মতো আবার/কোরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবিহুল্লাহ ছেলেরা হোক...।
ঈদুল আজহা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এর আনন্দ এনে দিয়েছে সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংরক্ষণের অনুপ্রেরণা। কোরবানির পশুর গোশ্ত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং আর এক ভাগ নিজের পরিজনের জন্য রাখাই বণ্টন নীতি, ঈদের আনন্দ সবাই সমানভাগে ভাগ করে নেয়ার প্রেরণায় উদ্ভাসিত করেছে। ঈদুল আজহা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে এবং আত্মসচেতনতায় বলীয়ান করে। ঈদুল আজহার দিনে সামর্থ মতো ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে, নিজেকে সুন্দর করে সজ্জিত করে ঈদগাহে গিয়ে বৃহৎ জামাতে দুই রাকাত নামাজ ইমামের পেছনে আদায় করার মধ্যে, নামাজ শেষ ধনী, নির্ধন একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলির মধ্যে, তারপর যাদের সামর্থ্য আছে তাদের পশু কোরবানির মধ্যে, কোরবানির গোশত ধনী, নির্ধন সবার মাঝে বণ্টনের মধ্যে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐক্য প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এক মিলন মোহনায় এসে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়।
ঈদুল আজহা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এনে দেয় মহামিলনের অনুভব।
লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরিফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।