Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাদ্দামকে ক্ষমতায় রাখলেই ভালো হতো

। জন নিক্সন । অনুবাদ : হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৪ এএম | আপডেট : ৩:৫৯ পিএম, ২০ আগস্ট, ২০১৮

ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল শাম (আইএস আইএস বা আইসিস)-এর হাত ধরেই মূলত ইরাকে ইসলামী উগ্রবাদের উত্থান ঘটে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অথচ এ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার কোনো প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না যদি সে ইরাকের দীর্ঘদিনের ও অনেকটা শক্তিহীন হয়ে পড়া শাসক সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতায় থাকতে দিত। তার মানে আমি এটা বলতে চাইছি না যে বহু বছর ধরে যার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল সেই সাদ্দাম হোসেন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক যার কারণে বিভিন্ন সময়ে দেশে গোলযোগ সৃষ্টি হয় ও রক্তপাত ঘটে। আজ এ কথা বলতে হয় যে আমেরিকার উর্দি পরা তরুণ-তরুণীরা যে বিশ্রি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ও তাদের উদ্যম অপচয়ের শিকার হয়েছে সে তুলনায় সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতায় থাকাই ভালো হত। এ ছাড়া ইতোমধ্যে ব্যয় হওয়া ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ও নতুন ইরাক গঠনে এখনো যে ব্যয় হচ্ছে সে কথা আর নাই বা বললাম।
সাদ্দাম হেসেন মার্কিনিদের হাতে আটক হওয়ার পর ২০০৩ সালে ডিসেম্বর ও ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে তাকে দীর্ঘদিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদকারী আমিই প্রথম আমেরিকান। আমি ছিলাম সিআইএ নেতৃত্বের সিনিয়র বিশ্লেষক। আমার আগের পাঁচ বছর কেটেছে ইরাক ও ইরান বিষয়ে গবেষণা করে। জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে আমি মনে করতাম যে আমি সাদ্দাম হোসেনকে জানি। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে আমি জানতে পারি যে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ও সুন্নি উগ্রবাদসহ ইসলামী বিশে^ উগ্রবাদী ¯্রােতের আপোসহীন শত্রæ হিসেবে তার ভূমিকা উভয়কেই ব্যাপকভাবে ভুল বুঝেছে।
হাস্যবর ব্যাপার এই যে মার্কিন নব্য রক্ষণশীলরা সাদ্দাম হোসেনকে যখন ৯/১১ ও আল-কায়েদার সাথে যুক্ত করার সর্বোত্তম চেষ্টা করছিল সাদ্দাম তখন ভাবছিলেন যে বিশ^ বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনের উপর হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে ইরাকের বাথপন্থী প্রশাসনের কাছে নিয়ে আসবে। সাদ্দাম মনে করেছিলেন যে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দু’দেশ হচ্ছে স্বাভাবিক মিত্র। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের দিনগুলোতে বহুবার তিনি বলেন যে তিনি বুঝতে পারেন নি যে কেন যুক্তরাষ্ট্র তার চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি। সাদ্দাম নিজে ছিলেন সুন্নি, তার বাথ পার্টি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে; তিনি সুন্নি উগ্রবাদকে তার ক্ষমতার ভিত্তির জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন। সাদ্দাম নিজেকে একবারে ভয়হীন হিসেবে প্রদর্শন করতেন, কিন্তু আমি বিস্মিত হই যখন তিনি আমাকে বলেন যে তিনি দেশে ইসলামী উগ্রবাদের উত্থানকে ভয় করতেন। তিনি জানতেন যে সুন্নি মৌলবাদ যাদের প্রদর্শিত নীতি সেই শত্রæর বিরুদ্ধে প্রধানত তার সুন্নি দমন যন্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা কত কঠিন।
ইসরাইলি পÐিত আমাতজিয়া বারাম লক্ষ্য করেছেন যে ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ নির্বিশেষে সাদ্দাম সব সময়ই প্রতিযোগিতারত এলিটদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সাদ্দাম বিশ^াস করতেন যে দেশে একজনই নেতা থাকতে পারে। তিনি আমাকে বলেন, আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে ইরাকিরা, বিশেষ করে শিয়ারা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ১৯৫৮ সালে রাজতন্ত্রের পতনের পর আপনি যদি ইরাকের ইতিহাসের দিকে তাকান, আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে সাদ্দামের কথায় যুক্তি ছিল। ইরাকি রাজনীতি ছিল প্রতিদ্ব›দ্বীদের মধ্যে রেষারেষিতে আকীর্ণ, একের হাত খুঁজত অন্যের গলা। সাদ্দাম হোসেনকে প্রায়ই অবিশ^াসী বা এমন লোক বলে অপবাদ দেয়া হত যিনি তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে সুবিধামত ব্যবহার করেন। আসলে যেমন বলা হয় তিনি ধর্মের প্রতি সে রকম বৈরি ছিলেন না, তিনি যা চাইতেন তা হল ইরাকে ধর্মীয় কর্মকাÐের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দিতে হবে। সাদ্দাম ধর্মবিশ^াসী ছিলেন, তবে তা তার নিজের মত। ১৯৯১ সালে উপসাগর যুদ্ধের পর তিনি ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতীককে অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় জনজীবনে নিয়ে আসেন।
তবে সাদ্দামের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট সীমা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি আমাকে যেমনটি বলেছিলন, ‘আমি তাদের বলেছিলাম যদি তারা তাদের ধর্ম পালন করতে চায়,তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু তারা পাগড়িকে (ধর্ম) রাজনীতিতে আনতে পারবে না। আমি তা অনুমোদন করব না।’ সাদ্দাম শিয়াদের উদ্দেশ্যে এ কথা বললেও তা সুন্নিদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। এক্ষেত্রে তার বিশেষ লক্ষ্য ছিলেন শিয়া ধর্মীয় নেতারা যেমন মুহাম্মদ বকর আল সদর ও মুহাম্মদ সাদিক আল সদর যারা সাদ্দামের বিরোধিতাকে বেছে নিয়েছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে যে রকম ইসলামী বিপ্লবে ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন সে রকম ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা তার প্রশাসনকে হুমকি দিয়েছিলেন। সাদ্দাম তাদের দু’জনকেই হত্যা করেন।
গত বিশ বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার। ওয়াহাবিবাদের উৎপত্তি সউদি আরবে। এর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের রাসূলুল্লাহ সা.-এর সময়ের মত কৃচ্ছ্রতার মধ্যে ফিরিয়ে আনা। ওয়াহাবিবাদের হুমকি সম্পর্কে তার উপলব্ধি এবং ইরানি মদদকৃত সন্ত্রাসবাদ ও ইরাকি শিয়া উগ্রপন্থীদের সাথে ইরানের সম্পর্ক বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিশেষভাবে কঠিন। তিনি ইরানের পারসীয়দের বিরুদ্ধে ইরাককে প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যূহ এবং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে সুন্নি প্রাচীর হিসেবে দেখতেন।
১৯৯০-এর দশক নাগাদ সাদ্দাম ইরাকে ওয়াহাবিবাদের বিস্তার শুরু হতে দেখেন এবং তার দেশে ওয়াহাবি সেলের সৃষ্টি হচ্ছে বলে শুনতে পান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের বলেন, ইরাকে ওয়াহাবিবাদ ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে এবং সম্ভবত তা কারো ভাবনার চেয়েও দ্রæতগতিতে। এ সব লোক কেন ওয়াহাবিবাদকে একটি আদর্শ ও সংগ্রাম হিসেবে দেখে তার কারণও তিনি বলেন। তিনি বলেন, যারা আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে চায় তাদের জন্য ইরাক হবে যুদ্ধক্ষেত্র। এখন ইরাক মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য একটি প্রকৃত রণাঙ্গন।
সাদ্দামের অপসারণ যে ক্ষমতা শূন্যতার সৃষ্টি করে তা ইরাকে ধর্মীয় পার্থক্যকে একটি গোষ্ঠিগত রক্তক্ষয়ে পরিণত করে। একটি সময়ের জন্য শিয়ারা আবু মুসা আল জারকাবির সুন্নি নেতৃত্বাধীন নৃশংসতার তাদের অন্য গাল ঘুরায় ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায়। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিয়া মিলিশিয়ারা যুদ্ধে যোগ দেয়।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্ত নামে গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়। ২০১১ সালে মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, সউদি আরব ও জর্দানে তা ছড়িয়ে দেয়। তারপর মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান এবং লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সাথে আসে আরব শীত।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমন করতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেন। প্রথমে মধ্যপন্থী সুন্নি বিদ্রোহীরা সরকারের বিরোধিতা করে। এক বছর পর তাদের সাথে যোগ দেয় সুন্নি মুসলিম ব্রাদারহুড যারা ছিল অনেক বেশীমাত্রায় জঙ্গি,কিন্তু ইসলামিক স্টেটের (আই এস) সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না (সিরিয়ার জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ সুন্নি, অন্যদিকে শিয়াদের একটি শাখা প্রেসিডেন্ট বাশারের আলাবি গোত্র সিরিয়ার জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ)। ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ আল-কায়েদা ও আইএসের যোদ্ধা ইউনিটগুলো এ যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে । তবে কৌশল ও নেতৃত্বের প্রশ্নে ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারিতে তারা বিভক্ত হয়ে যায়। এর পাঁচ মাস পর আই এস ‘খিলাফত’ ঘোষণা করে। তারা মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে যোদ্ধা সংগ্রহ করতে সহিংসতার পর্নোগ্রাফি হিসেবে শিরñেদ ও গণহত্যার ভিডিও ব্যবহার করে। বাকিটা হল এক ভয়ংকর ইতিহাস : সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, ১ কোটি ৭০ লাখ লোক গৃহহীন, সিরিয়া ও ইরাকের বিরাট ভূখÐ আইএসের খিলাফতের নিয়ন্ত্রণে ও যুদ্ধের বহুমুখী বিস্তার যাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইরান সমর্থিত শিয়া হেজবুল্লাহ ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে রাশিয়া।
সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগীরা যদি ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে কি এসব ঘটনাবলী ঘটত? নিশ্চিতই তার সেনাবাহিনী অক্ষত থাকত এবং তার এত শীর্ষ সেনা অফিসার আইএসের পক্ষে যোগ দিতেন না এবং জিহাদিরা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিশেষজ্ঞ পেত না। সাদ্দাম ইরাকের গোষ্ঠিগত উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে শক্তি ব্যবহার করতেন। তাই বিশ^াসযোগ্য ভাবে এ কথা বলা যায় যে মার্কিন আগ্রাসন না হলে আরব বিশ^ শান্ত থাকত, তবে ইরাক, সিরিয়া, মিসর ও লিবিয়ায় স্বৈরশাসনের থাবার নিচে জনগণের দিন কাটত।
কয়েক বছর ধরে সাদ্দাম সিরিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডকে গোপন সমর্থন দিতেন। তারা তার নীতি সমর্থন করতে বলে কি তিনি তা করতেন? আসলে তা নয়। সাদ্দাম এটা করতেন এ কারণে যে ব্রাদারহুড বাথপন্থী আন্দোলনে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্ব›দ্বী আসাদের বিরোধী ছিল। ব্রাদারহুড কর্র্মীরা যদি তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের চেষ্টা করত তাহলে তিনি দ্রæত তাদের দমন করতেন।
সাদ্দাম কোনো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না এবং তিনি বৃহত্তর বিশ^কে বোঝার মত ব্যক্তিও ছিলেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা বিশেষভাবে ভীতিগ্রস্ত ছিলেন এবং দেশটিকে তার প্রধান পীড়নকারী হিসেবে গণ্য করতেন। সাদ্দাম হোসেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। তারা ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সমর্থন করেছে, আবার তার বিরুদ্ধে উপসাগর যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধ করেছে। এ সব অসঙ্গতিই সম্ভবত সাদ্দাম হোসেনকে অনেকগুলো ভুল পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে ঠেলে দিতে কাজ করে এবং চূড়ান্তভাবে ২০০১ সালে জর্জ ডবিøউ বুশ ক্ষমতায় আসার পর তার প্রশাসনের প্রণীত ‘অবশ্যই অপসারণ’ তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আমি বলছি না যে তা সাদ্দামকে দায়মুক্ত করার জন্য। সাদ্দাম নিজে থেকেই ভুল করতেন। যখন তা কূটনৈতিক বা সামরিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াত তখন তিনি বড় রকম কিছু করতেন।
প্রাচীন গ্রীকরা বুঝেছিল যে দেবতারা যখন আপনাকে শাস্তি দিতে চান তখন তারা আপনার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা পূরণ করেন। ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সম্ভাব্য পরিণতির কথা না ভেবেই যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনকে খাটো করা ও তারে ধ্বংসের জন্য কাজ করে। সাদ্দাম হোসেন বিশ^টাকে কিভাবে দেখতেন এবং কিভাবে ইরাকের রাজনীতির ধিকিধিকি জ¦লা আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতেন সে ব্যাপারে আমাদের ভালো জানা ছিল না। এ অজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীতে ইরাক দখলকালে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়া করে ফেরে। বস্তুত বোঝার অভাব হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে এক গুরুতর ত্রæটির প্রতিফলন যা প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই আমাদেরকে জর্জরিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত তার প্রতি কোনো হুমকির ক্ষেত্রে আলোচনা এবং রাজনীতির সুবিধার মূল্যায়ন না করেই অন্ধের মত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তা সে কম্যুনিজমই হোক আর আরব শক্তমানবই হোক। বিদেশী নেতা বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদীদের জুতার মধ্যে নিজেদের রাখতে আমাদের নেতারা অক্ষম।
২০০৯ সালে ওবামা প্রশাসনের প্রথম বছরে ওয়াশিংটনে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি ‘লেসনস ইন ডিজাস্টার’ নামে একটি বই পড়তে শুরু করি। এটি ছিল ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসন বিষয়ক ম্যাকজর্জ বান্ডির পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা একটি চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন আফগানিস্তানে বিপুল সংখ্যক মার্কিন সৈন্য প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তখনি বইটি প্রকাশিত হয় বলে তার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ বইটি পড়ার প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল এ জন্য যে গ্রাজুয়েট স্কুলে বান্ডি আমার অধ্যাপক ছিলেন । তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন আমি যার গভীর অনুরাগী ছিলাম। তিনি কোনো ভয়-ভীতিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মানুষ ছিলেন না। একদা প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও জনসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও মার্কিন সামরিক ব্যবস্থার কট্টর সমর্থক ছিলেন বান্ডি। তিনি চল্লিশ বছর ধরে মার্কিন জোলো নীতির তীব্র সমালোচক ছিলেন যা আমাদেরকে ভিয়েতনামে জড়িত করেছিল। আমি বান্ডির নিরাপস সততায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে সিআইএ’র সদর দফতরে একজন সিনিয়র এনালিস্ট হিসেবে আমার তেরো বছরের জীবন এবং ইরাকে আমার আট দফা সফরের দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে আমার দৃষ্টিতে সেই একই বিবর্তন দেখতে পাই। আমি অবাক হই যে আমি আমার আগের চিন্তা কত সংশোধন করেছি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই যে ইরাকে যুদ্ধের পথ বেছে নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু ভুল করেছে যখন আমরা দেশটির রাজনৈতিক ও গেষ্ঠিগত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খুব কমই জানতাম।
সাদ্দাম হোসেন ইরাকে ক্ষমতার শীর্ষে উন্নীত হয়েছিলেন শুধু ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে, চালাকি ও প্রতারণার মত হীন পন্থা অবলম্বন করে নয়। কিছু দিক দিয়ে তিনি অজ্ঞ ছিলেন, তিনি তারুণ্যে দারিদ্রগ্রস্ত ছিলেন এবং তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বেশী এগোয়নি। তিনি তার নিজের লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছিলেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যাতে ৭ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। তাদের মধ্যে এক লাখ ছিল বেসামরিক লোক। বিবেকের কোনো দংশন ছাড়াই তিনি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেন যে কারণে ‘বাগদাদের কসাই’ আখ্যা তার প্রাপ্য। তবে বাইরে তাকে যেমন দেখা যেত তিনি তার চেয়ে জটিল লোক ছিলেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এ লোকটি কে ছিলেন এবং কি তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল তা আমরা জানি।
আমরা টুকরো টুকরো ঘটনা নিয়ে ইতিহাস নির্মাণ করতে পারি, কিন্তু আমরা কখনো নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে আমরা একটি পূর্ণ ও সুসঙ্গত কাহিনীর একত্র সন্নিবেশ করেছি। ঘটনা স্মরণ করা ও তা পুনঃবর্ণনা করা একটি যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যারা ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে কিছু লোক তাদের গল্প বলতে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক রেকর্ড পরিপূর্ণ হওয়া এখনো অনেক দেরী। সাদ্দাম হোসেন ব্যক্তিগত ভাবে কেমন লোক ছিলেন এবং ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর আটক হওয়ার পরবর্তী কয়েকমাস তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন তা লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত। যেহেতু ঐ সময় আমি তার সাথে ছিলাম এবং আমি তাকে কয়েক বছর ধরে বিশ্লেষণ করেছি, তাই আমি এ শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করব। এই জটিল ব্যক্তিকে ঘিরে যে মিথ রচিত হয়েছে আমি তার সে আবরণ ছিন্ন করতে ঐতিহাসিকদের সাহায্য করার আশা রাখি।
লোকে আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে সাদ্দাম হোসেন কেমন ছিলেন? তিনি কি পাগল ছিলেন? সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়কালে আমি তাকে সুস্থ মস্তিষ্কই দেখেছি। আমার যুক্তি যে সাদ্দাম ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য কি রকম দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তা কখনো ভাবেনি। আমরা উপসাগর যুদ্ধের পর ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে লাখ লাখ শিয়া ও উত্তরাঞ্চলেও সমসংখ্যক মানুষ হত্যার ভয়ংকর কাহিনী শুনেছি। ইরাকিদের বিরদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র হামলা, ইরাক-ইরান যুদ্ধে মানুষের প্রাণহানির জন্য তিনি দায়ী। কিন্তু আমরা কখনো এ সব রক্তক্ষয়ী কাজের সাথে ঐ অঞ্চলে তার বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার সমন্বয় করিনি। শুধু তার মৃত্যুর পরই আমরা তা বুঝতে পারি।
সাদ্দাম হোসেনের সাথে বহুবার বৈঠকের পর আমি যখন ইরাক থেকে ফিরে আসি আমরা সহকর্মী অনেক বিশ্লেষক জানতে চেয়েছিলেন যে আমার টিম তার কাছ থেকে কি জানতে পেরেছে। সন্দেহবাদীদের কেউ কেউ মনে করেছিলেন আমাদের পুরো সময়টি অপচয় করা হয়েছে। তবে সত্য কথা হচ্ছে যে আমরা সাদ্দাম কিভাবে শাসন করেছিলেন ও কেন তিনি কিছু কাজ করেছিলেন সে ব্যাপারে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। আমরা সে সব কারণ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম যে সব কারণ ইরাকে আগ্রাসন চালাতে ও সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা আমাদের উচিত হয়েছে কিনা তা কখনো কেউ জিজ্ঞেস করেনি ও তার জবাবও মেলেনি। হোয়াইট হাউসের নিিত নির্ধারকগণ ও সিআইএ ৮ম তলার নেতৃত্ব শুনতে চাননি যে সাদ্দাম হোসেনের পিছনে লাগার অনেকগুলো কারণের ভিত্তিই ছিল মিথ্যা। আমি সিআইএর অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এ সব কাহিনীর কিছু লেখার জন্য বারবার চেষ্টা করি, কিন্তু এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই যে সেটাকে আমার ভন্ডামি বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং আরো ছিল ‘আমরা এমন কিছু করিনি ’ জাতীয় মনোভাব।
ইরাক আগ্রাসনের সময় রিচার্ড হ্যাস ছিলেন পররাষ্ট্র দফতরে নীতি পরিকল্পনার পরিচালক এবং পরবর্তীতে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সভাপতি হন। তিনি সাংবাদিক জর্জ প্যাকারকে বলেন যে তিনি কখনোই জানতেন না যে যুক্তরাষ্ট্র কেন যুদ্ধে গেল এবং তিনি এ সিদ্ধান্তকে এই মাত্র নেয়া বলে বর্ণনা করেন। তিনি তার যুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতিকথা ‘ ওয়ার অব নেসেসিটি, ওয়ার অব চয়েস’ গ্রন্থে যুদ্ধের তিনটি পৃথক পর্যায়ের কথা বর্ণনা করেছেন : প্রথমত, নীতি বিতর্ক যা সাধারণত যুদ্ধের আগে হয়ে থাকে; দ্বিতীয়ত, খোদ প্রকৃত যুদ্ধ এবং তৃতীয়ত, যুদ্ধ থেকে কি অর্জিত হবে এবং তার অর্থই বা কি তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিষয়ে বিতর্ক।
সবশেষে ছিলেন সাদ্দাম হোসেন নিজে। তিনি বিশে^র এমন একটি অংশে মার্কিন স্বার্থের জন্য সুস্পষ্ট হুমকি ছিলেন যা আমাদের সরকারের কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একটি গর্বিত ও অত্যন্ত উন্নত একটি সমাজ পেয়েছিলেন তিনি এবং অপশাসনের মাধ্যমে তা বিনষ্ট করেন। তার শাসনের শেষ দিকে তিনি তার স্থান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। তিনি ইতিহাসের অনুরাগী ছিলেন কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা নেয়ার মত মেধা তার ছিল না। পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ক্রমবর্ধমানভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট তাহা ইয়াসিন রামাদান, বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ইজ্জত ইব্রাহিম আল দুরি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারেক আজিজের মত কট্টরপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছিল। রামাদান ও তার সহযোগীরা বারবার ইরাকের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ভাঙার সুযোগ নষ্ট করেন। সাদ্দাম হোসেন বন্দী অবস্থায় প্রায়ই নিজেকে ইরাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করতেন , তবে দ্বিতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে লেখক বলতেন।
*সিআইএ-র বিশ্লেষক জন নিক্সনের সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘ডিব্রিফিং দি প্রেসিডেন্ট : দি ইন্টারোগেশন অব সাদ্দাম হোসেন’ এর ভ‚মিকা অংশের অনুবাদ।

 



 

Show all comments
  • MD Kuddus Mondol ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১১:৩৯ এএম says : 0
    সাদ্দাম একটাই, দুইটা নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Abu Sayed Shahin ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১১:৩৯ এএম says : 1
    এখন বোঝলে কোন লাভ নেই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল আজহা

৯ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন