বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুনির আহমদ
সিনেমা-নাটক, নাচ-গান এবং নানা ধরনের ক্রীড়ামোদ ও খেলাধুলায় ভারতকে বলা যায় অত্র অঞ্চলের আধুনিক সংস্কৃতির তীর্থভূমি। শুধু দক্ষিণ
এশিয়ায় নয়, আধুনিক ভোগবাদি সাংস্কৃতিক জগতে ভারতীয়দের প্রভাব ও সদর্প পদচারণা এখন বিশ্বময়। অথচ সংস্কৃতির ঊর্বর ভূমি এই ভারতেরই প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকার (১৫ এপ্রিল) অনলাইন সংস্করণের প্রথম ও শেষ পাতাসহ কোথাও কলকাতার বাঙালিদের পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনে কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ, বা তিন স্তরের নিরাপত্তায় বর্ষবরণে কোরাস গানের আসর বা কোনো যাত্রাপালা আয়োজনের ছবি বা নিউজ পরিবেশনা খুঁজে পাইনি। বিনোদন ও ক্রীড়ার নির্দিষ্ট পাতাগুলো বাদ দিলে সারা পত্রিকা জুড়েই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংবাদে ভরপুর নিউজ ও সংবাদ প্রতিবেদন দেখা গেছে যথারীতি। অন্যদিকে “বৈশাখী প্রথম সকালে আবেগে মাতলো ঢাকা” শিরোনামে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদনে মানুষের জমায়েতে বেলুন বিক্রেতা, রমনা বটমূল ও পান্তা-ইলিশের ছবি প্রকাশ করলেও, ছিল না মনুবাদ সংস্কৃতির ধারক ঢাকায় অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো ছবি।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের বালুরঘাটে বসবাস করা ফেসবুক বন্ধু ব্যাংকার রঞ্জিত দে’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনুবাদ ভারতেও আগ্রাসী সংস্কৃতি হিসেবেই বিবেচিত। অধিকাংশ ভারতীয় মনুবাদ পছন্দ করেন না। এই কারণেও হতে পারে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা মনুবাদের ধারক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি প্রকাশ থেকে বিরত থেকেছে।
বাংলা নববর্ষ বরণে পশ্চিম বাংলায় কী কী আয়োজন হয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে রঞ্জিত দে বলেন, ‘দুই একটা অনুষ্ঠান হয় ছোট পরিসরে। যা কমই চোখে পড়ে। মূলত পশ্চিম বাংলায় বর্ষবরণ বলতে সারা বছরের বকেয়া আদায়ের অনুষ্ঠান বা হালখাতার আয়োজনকে বুঝায়। বর্ষবরণ নিয়ে ঢাকার মতো মাতামাতি কলকাতায় দেখা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা-সাক্ষাতে বা ফোন মেসেজে শুভেচ্ছা দিতে দেখা যায়। এতটুকুই।’
আগ্রাসী মনুবাদ সংস্কৃতির ধারক কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সমর্থক আমাদের প্রথম আলো পত্রিকাও ‘কলকাতায় নানা আয়োজনে বর্ষবরণ’ শিরোনামে এক অনলাইন সংবাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত একটি ব্যানারের সামনে দুইজন শিশুর নাচের ছবি, পিঠা বিক্রির একটা স্টলের ছবি এবং কলকাতায় বর্ষবরণ শিরোনামে আরেকটা প্রতিবেদনে জনা বিশেক নারীর একটা ব্যানার নিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণের একই মানুষগুলোর সামনে পিছনের কয়েকটা ছবি ছাড়া কলকাতার মূলধারার বাঙালিদের বর্ষবরণের জনসমাগমের কোন ছবি পায়নি। প্রথম আলো পত্রিকার কলকাতার বর্ষবরণ নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়লে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন কর্তৃক ঘরোয়া পরিসরে বর্ষবরণের আয়োজন ছাড়া পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে এ নিয়ে অতিউৎসাহ ছিল না কোথাও।
অন্যদিকে আজকের (১৫ এপ্রিলের) বাংলাদেশি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দিকে একবার তাকান। দেখবেন বাঘ-ভল্লুক, হাতি-ঘোড়া, কুমির-কচ্ছপ, শকুন-পেঁচার ইয়া বড় বড় আবক্ষ মূর্তির পাশাপাশি দেব-দেবীর বিশাল বিশাল মুখাবয়ব নিয়ে ঢাকার রাজপথে একশ্রেণীর মানুষের মঙ্গল কামনার শোভাযাত্রা, তিন স্তরের কঠোর নিরাপত্তায় রমনা বটমূলে কোরাস গাওয়া এবং বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশসহ নানা পদের ভূরিভোজের সচিত্র রঙবেরঙের প্রতিবেদনই আজকের বাংলাদেশি মিডিয়ার প্রধান খবর। পত্রিকাগুলো, টিভিগুলো কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ও রমনা বটমূলের কোরাস গাওয়ার নানা এঙ্গেল থেকে তোলা ছবি এমনভাবে প্রচার ও প্রকাশ করেছে যে, যা দেখলে মনে হবে আগ্রাসী মনুবাদ সংস্কৃতির ধারক মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন এদেশের সাংস্কৃতিক উৎসবের সার্বজনীন এক সমাজ চিত্র। উৎসবমুখর জীবজন্তুর আবক্ষ মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা, নাচ-গান, পান্তা-ইলিশ ও একশ্রেণীর নারী-পুরুষের আনন্দ-উল্লাসের চিত্র ও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সংবাদ পরিবেশনা দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশের সর্বত্রই যেন মূর্তি সংস্কৃতির জয়জয়কার। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের খবর পরিবেশনা দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমান এখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে জীবজন্তুর কাছে মঙ্গল ও সুখশান্তি কামনা করছে (নাউজুবিল্লাহ), এমন একটা চিত্র ফুটিয়ে তুলতে আমাদের মিডিয়ার চেষ্টার যেন কমতি ছিল না। বাংলাদেশের মানুষের যেন সুখ-আনন্দের শেষ নেই। এর বাইরে অবিশ্বাস্য গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার বারবার প্রচারিত হওয়া একই রকম সংবাদ ও স্তুতিমূলক নিউজ অন্যান্য দিনের মতো ১৫ এপ্রিলেও ছিল পত্রিকা জুড়ে। এর বাইরে জনস্বার্থ ও জনসমস্যা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রতিবেদন খুঁজে পেতে কষ্ট হয় বাংলাদেশের মিডিয়ায়। আমাদের মিডিয়ার চোখে বাংলাদেশ উন্নতি ও সুখ-সমৃদ্ধি পৃথিবীর এক নম্বর কোনো দেশ। টেলিভিশন ও পত্রিকায় সংবাদ প্রতিবেদন ও রিপোর্ট উপস্থাপনার ধরন দেখলে মনে হবে, ৮ ভাগ অমুসলিমের বিপরীতে এই দেশ যেন ৯২ ভাগ সংখ্যালঘুর দেশ!
ভারতীয় মিডিয়া তাদের দেশ, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস, নীতি-আদর্শ ও জনস্বার্থে সোচ্চার কথা বলে। কিন্তু আমাদের মিডিয়া! দেখবেন, প্রতিদিনই অবিশ্বাস্য গতিতে দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে চলার একই রকম নিউজ এবং মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ বিত্তশালীর উল্লাস
নৃত্য ও ভোগবাদিতার খবরে ভরপুর। বাকি ৯০ ভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টকর দিনগুজরানের বা সমস্যাগুলো তুলে ধরার কোনই চেষ্টাই দেখা যায় না আমাদের মিডিয়ায়। মিডিয়াগুলো একবারও এই প্রশ্ন তুলতে রাজি হয় না যে, পশুপাখি ও দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কত ভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কত ভাগের সাথে ঘোরতর সাংঘর্ষিক। মিডিয়াগুলো এটাও আলোচনায় তুলতে চায় না যে, পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি কবে থেকে শুরু এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে পান্তা-ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণের আর্থিক সক্ষমতা বাংলাদেশের কয়ভাগ মানুষের আছে।
আমার যা উপলব্ধি, আমাদের দেশের গণমাধ্যম মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ ক্ষমতাশালী ও ধনী মানুষকে আরো বেশি ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী করার জন্য একদিকে যেমন ৯০ ভাগ আমজনতার স্বার্থকে চরমভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে দিনের পর দিন, তেমনি শোষণ ও ভোগবাদিতাকে বাধাহীন করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে শুধু ঢালাও অপপ্রচারই করে যাচ্ছে না, বরং ৯২ ভাগ মানুষকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সে কারণেই বলা যায়, আমজনতা দেশ ও জাতির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো সচেতন না হলে, এই দেশ ও জাতির অধোগতি রুখবার নয়!
মহান আল্লাহ এই জাতি ও দেশের সহায় হোন। আমীন।
য় লেখক : হেফাজত আমীরের প্রেসসচিব এবং নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম
সঁহরৎসসর০৯@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।