Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আজ বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী

জাতীয় শোক দিবস : রক্তঝরা অশ্রুভেজা ১৫ আগস্ট

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

আকাশের সকল কালো মেঘ আজ মনের কোনে জমাট বাধা... কোন আনন্দ-সুখ শান্ত রাখতে পারছে না মনকে... বারে বারে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে... মনে পড়ে জাতির পিতা শেখ মুজিব তোমায়। আজকের এই দিনে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে তুমি। আজ সেই শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৭৫ সালের এই দিনে রাষ্ট্র হারায় তার স্থপতিকে। জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে আর আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রেষ্ট নেতাকে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় গুণ, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আর আমার দোষ, তাদের আমি বেশি ভালোবাসি।’ দেশ আর মানুষের প্রতি যার ছিল এই অগাধ ভালোবাসা; যার হাতে জ্বলেছে বাঙালি জাতির দুয়ারে উদ্দীপনার আলো; তাকেই নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে নিষ্ঠুর ঘাতকরা। অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে দেয় গোটা বাংলাদেশ। ভোরের আলো ফোটার আগেই ধানমÐি ৩২ নাম্বারে রচিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়।
পঁচাত্তরের এই দিনে শুধু তিনিই নন, স্ত্রী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল ও সহোদরসহ আত্মীয়-পরিজন নির্মম হত্যাকাÐের শিকার হন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ঘটনার সঙ্গে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতের এই বর্বর হত্যাকাÐই তুলনীয় হতে পারে। যেখানে নারী-শিশুসহ নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আস্থাহীন দেশীয় কিছু রাজনীতিকের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে শহীদ হন সেই কালরাতে। তবে প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৫ আগস্টের নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞে আরও নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃস্বত্ত¡া স্ত্রী আরজু মনি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে এসব শহীদকে। সেদিন যা ঘটেছিল: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতিপ্রত্যুষে ধানমÐির ৩২ নাম্বারের বাসভবনে কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালায় ঘাতক দল। সে নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। লুঙ্গিতে জড়ানো শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ। এভাবেই নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরপরই স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। অপপ্রয়াস চালানো হয় বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাস মুছে ফেলারও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে বারবার কাটাছেঁড়া করা হয় সংবিধানকে। যাতে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ সংবিধানে উপেক্ষিত হয়।
শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অপসারণ, হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিও চালু হয়। গণতন্ত্রকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। চালু হয় সামরিক একনায়কতন্ত্র। সেই সাথে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনি মোশতাক, ফারুক, রশিদচক্রকে হত্যাকাÐের দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইন করে খুনিদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করা হয়। রুদ্ধ করে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ।
কিন্তু এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে-বিদেশে বঙ্গববন্ধু হত্যার বিচারের জোর দাবি ওঠে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের বিচারের পথ উন্মুক্ত করে। বিচারে নিম্ন আদালত ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদÐ প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতের এ রায় হাইকোর্টও বহাল রাখেন। কিন্তু ২০০১ সালের পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ না দেয়াসহ নানা কারণে বিচারের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে রায় কার্যকরে বিলম্ব হতে থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালতের পর্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি ৫ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। তবে এখনো দÐপ্রাপ্ত ৫ খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে।
এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সারাদেশে সাধারণ ছুটি থাকবে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোতে অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা।
কর্মসূচি: এদিন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মধ্যে সকাল সাড়ে ৬টায় প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমÐির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন দলটির শীর্ষসহ সব পর্যায়ের নেতারা। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল হবে। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হবে সকাল ১০টায়। বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মহিলা আওয়ামী লীগের মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে বাদ আসর। আর আগামীকাল বিকাল ৪টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দলটির উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম: স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রামে ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। দিবসের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। নগরীর স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দোয়া, মিলাদ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে তিনদিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। আজ তৃতীয় দিনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা ও সিটি কর্পোরেশনের পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি রয়েছে। এছাড়া সকালে সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ফোরকানিয়া মাদরাসা ছাড়াও স্কুল ও কলেজে আলোচনা সভা, মিলাদ ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। নগর ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং কর্পোরেশনের সকল ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের ব্যবস্থাপনায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ক্লাবের পিএইচপি ভিআইপি লাউঞ্জে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে সকাল ৮টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন। এরপর দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা এবং বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ। ###



 

Show all comments
  • জাহিদ ১৫ আগস্ট, ২০১৮, ৪:১৩ এএম says : 0
    বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি
    Total Reply(0) Reply
  • পাবেল ১৫ আগস্ট, ২০১৮, ৪:১৪ এএম says : 0
    আমরা আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্য যারা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফ ১৫ আগস্ট, ২০১৮, ৯:২৯ এএম says : 0
    এক জন বঙ্গ বন্ধু জন্মেছিলো বাংলায় আল্লাহর রহমতের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার জন্যে, বঙ্গ বন্ধুরা কখনও কখনও কোন জাতির সৌভাগ্য ক্রমে জন্ম ন্যয়। ওনার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গবন্ধু

৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ