বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দুনিয়াজুড়ে ইদানীং দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পানিশূন্য হয়ে, নগরী অচল। দাবানলে জ্বলছে বন জনপদ। ভ‚মিধসে দেবে যাচ্ছে সভ্যতা। ঝড়, টর্নেডো, সুনামি, ভ‚মিকম্প তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে উন্নত দেশ ও সমাজকে। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত বন্ধ হওয়ায় বাতিল ঘোষিত হচ্ছে কত নামি দামি নগর, মহানগর। মানব ইতিহাসের এমন কোন যুগ অতিবাহিত হয়নি যে যুগে আল্লাহর আজাব-অভিশাপ অবতীর্ণ হয়নি এবং নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালা-মুসিবতের কবলে পতিত হয়ে বিভিন্ন জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। তুফান, সামুদ্রিক প্লাবন, ভ‚মিকম্প, ভ‚মিধ্বস, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি আপদ-বিপদ সকল জাতির ওপর এবং সকল যুগেই এসেছিল। আল্লাহর এসব পরীক্ষা থেকে কোন জাতি নিস্তার লাভ করেনি। অতীতে অনেক জাতিকেই ধ্বংস প্রাপ্ত হতে হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন জাতির ধ্বংস বিবরণ উল্লেখ করেছেন। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানী ও জগতের বুকে অন্যায়-অবিচার এবং জুলুম নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করা। জাতীয় অধ:পতনের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেছেন; ‘(হে লোক সকল) তোমাদের ওপর বালা-মুসিবত যা কিছু নাজেল হয়ে থাকে তা তোমাদেরই কর্মফলের দরুন। আল্লাহ তোমাদের অনেকের পাপ মার্জনা করে থাকেন। (সূরা: শূরা) ‘বস্তুত নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।’ (সূরা: রা’দ)
সুতরাং প্রমাণিত হল যে, মানবতার উন্নতি অগ্রগতি এবং অধ:পতন ও সর্বনাশের মূলেও রয়েছে মানুষের কৃতকর্ম বা আমল। মানুষ সৎপথে থাকতে চাইলে আল্লাহ তাকে সেজন্য সাহায্য করেন এবং বিপথে পরিচালিত হতে চাইলে তাও তার এখতিয়ারভুক্ত।
রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেয়ামতের যে সকল পূর্ব লক্ষণের কথা বলেছেন, সেগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে মুসলিম সমাজের বর্তমান অবস্থা সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যেতে পারে। হজরত আবু হোরায়রা (রা:) কর্তৃক বর্ণিত, হুজুর (সা:) বলেছেন, ‘(১) যখন লোকে গনিমতের (যুদ্ধলব্ধ অর্থ) মালকে আল্লাহর দয়ার দান স্বরূপ নিজস্ব মাল বলে গণ্য করবে, (২) গচ্ছিত মালের খেয়ানত করতে থাকবে, (৩) জাকাত আদায় করাকে কর্জ পরিশোধ বলে মনে করবে, (৪) দীনের শিক্ষা বৈষয়িক উপকারের জন্য শিখবে, (৫) পুরুষগণ নিজেদের স্ত্রীগণের আদেশ (অন্যায়) মেনে চলবে, (৬) লোকে মাতার আদেশ অমান্য করে চলবে, (৭) বন্ধু-বান্ধবদের নৈকট্য লাভ ও তাদের সম্মান বেশি করতে থাকবে (মুরব্বিদের পরিবর্তে) (৮) পিতাকে দূর সম্পর্কীয় ব্যক্তি বলে মনে করবে, (৯) মসজিদসমূহে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও আত্মকলহ সৃষ্টি করা হবে, (১০) ফাসেক বা পাপাসক্ত এবং হীন ও নিকৃষ্ট ব্যক্তিগণ জাত ও সম্পদে নেতৃত্ব দান করবে, (১১) কোন মানুষের সম্মান কেবল তার ভয়ে এবং তার অন্যায়-অবিচার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য করা হবে, (১২) গায়িকার সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাদ্যযন্ত্রের প্রাচুর্য দেখা দেবে, (১৩) মদ্যপান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এবং (১৪) পরবর্তী লোকেরা তাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি অভিশাপ দিতে থাকবে (অর্থাৎ-তাদেরকে বোকা মনে করবে)। তখন তুমি অগ্নিবর্ণ, ঝড়-তুফানের, প্রচÐ ভ‚মিকম্পের জমিন বিধ্বস্তের, আসমান হতে পাথর বর্ষণের, আকার বিকৃতের এবং হাড় ভাঙানোর ন্যায় বহু অনল প্রবাহ লক্ষণের অপেক্ষা কর।’
হজরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, একদা হজরত নবী করীম (সা:) কিছু বর্ণনা করছিলেন, এমন সময় একজন মূর্খ লোক এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে?’ হুজুর (সা:) বললেন; ‘যখন লোক গচ্ছিত ধন আত্মসাৎ করবে।’ সে আবার জিজ্ঞাসা করল; ‘গচ্ছিত ধন আত্মসাৎ করার অর্থ কি?’ হুজুর (সা:) বললেন; ‘যখন অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে শাসনকার্য অর্পিত হবে, তখন তুমি কেয়ামতের প্রতীক্ষা করতে পার।’ অন্যত্র হুজুর (সা:) এরশাদ করেছেন; ‘ঐ সময় খুব দূরে নয়, যখন প্রকৃত ধর্মশিক্ষা উঠিয়ে নেয়া হবে। সেই সময় ফেতনা-ফাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অনিষ্ট ও বিশ^াসঘাতকতা ইত্যাদি প্রকাশ পাবে এবং রক্তপাত ও খুন-খারাবী অধিক হতে থাকবে।’ হজরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন; ‘যে জাতি খেয়ানতে লিপ্ত হয়ে পড়ে আল্লাহ তাদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করে দেন, যে জাতি ব্যভিচার (জেনা) আরম্ভ করে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে জাতি ওজন ও মাপে কম দেয় তাদের রেজেক, উপার্জন হ্রাস করে দেওয়া হয়। যে জাতি সত্যের বিরুদ্ধে রায় দান করে তাদের মধ্যে হত্যাকাÐ রক্তপাত বেড়ে যায় এবং যে জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাদেরকে শত্রæর অধীনস্থ করা হয়।’ (মোয়াত্তা মালেক)
হজরত উসমান (রা:) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন এক সময় আসবে যখন ইমাম বা শাসকগণ তোমদের রক্ষক হওয়ার পরিবর্তে কেবল তহসীলদার (কর আদায়কারী) হিসেবে গণ্য হবে। তখন হায়া-শরম, আমানতকারী এবং ওয়াদাকারী বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের কুকর্ম ও পাপ কার্যের ফলে নানা প্রকার আসমানী বালা-মুসিবত অবতীর্ণ হয়ে থাকে এবং কেয়ামতের পূর্বে সেগুলো অধিক পরিমাণে দেখা দেবে বলে নবী করিম (সা:) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।’ লোক যখন প্রকৃত মোমেন মুসলমান, পরহেজগার, আল্লাহর ফরমাবরদার, এবাদত-বন্দেগিরত, খোদাভীরু, সত্যবাদী, ধৈর্যশীল, দাতা, রোজাদার, কুসংস্কারমুক্ত এবং যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করে চলবে, তখন আল্লাহর মহিমা বর্ষিত হতে থাকবে এবং জগতে শান্তি বিরাজ করবে। আর তাদের মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলির অবর্তমানে যদি তারা কাফের, মোশারফ, ফাসেক, ফাজের, পাপী, ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী, ব্যভিচারী, মদ্যপায়ী, চোর, ডাকু, অত্যাচারী, অহংকারী, অভিশপ্ত, অজ্ঞ, ধোঁকাবাজ, বিদ্রোহী, মিথ্যাবাদী এবং হত্যাকারী প্রভৃতি রূপে জীবনযাপন করে তবে তাদের জন্য আল্লাহর করুণা ও মহিমার সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং জগতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি এবং জান-মালের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বাররে, ওয়াল বাহরে, বিমা কাছাবাত আইদিন নাসে’ অর্থাৎ- জলে-স্থলে ফ্যাসাদ ভরপুর হয়ে গেছে লোকের কৃতকর্মের ফলে। জাতীয় অধ:পতনে এর চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।