Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এই ঈদেও সক্রিয় অজ্ঞান পার্টি

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীসহ সারাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এই পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ক্রমেই নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে ভয়ংকর হয়ে উঠছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। চক্রের সব চেয়ে বড় টার্গেট থাকে রাজধানীসহ দেশের পশুরহাটগুলো। গত ১০ দিনে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অন্তত ৬০ জন লোক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালসহ এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ’। এ ছাড়া গত তিন বছরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজারের অধিক মানুষ। এর মধ্যে মারাও গেছেন অনেকে। এই সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে চক্রের অনেক সদস্য ধরা পড়েছে। ঢামেক হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস, লঞ্চ, রেলওয়েস্টেশন ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অচেতন ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই ঢামেক, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে তা খুবই বিপজ্জনক। এসব ওষুধের প্রতিক্রিয়া মানুষের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ ছাড়া ওষুধের প্রভাবে কারো কারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢামেক হাসপাতাল সূত্র বলছে, চলতি মাসের গত ১০ দিনের প্রতিদিনই ৭ থেকে ১০ জন মানুষ অজ্ঞান ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। দৈনিক হিসেবে রাজধানীর সব হাসপাতালে এ সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন হবে। তাদের বেশিরভাগই যাত্রীবাহী বাসসহ গণপরিবহনে অজ্ঞান পার্টির শিকার হন। এর মধ্যে অনেককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ঢামেক সূত্র আরও বলেন, গত ৩ বছরে অজ্ঞান ও মলম পার্টির কবলে পড়ে ঢামেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত তিন হাজার মানুষ। এ সময় সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে মারা গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রায় ২০ থেকে ২৫টি পয়েন্টে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের বেশির ভাগই মৌসুমি অজ্ঞান পার্টির সদস্য। র‌্যাব, পুলিশের বিভিন্ন সময়ের অভিযানে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। অনেকে মৌসুমী চক্রের সদস্য হওয়ায় তাদের চিহ্নিত ও আটক করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযোগ, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আইনের ফাঁক ফোঁকর গলে জামিনে বেড়িয়ে আবারও একই পেশায় জড়িয়ে পড়ে তারা। ঘটনা সূত্রে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, নারায়ণগঞ্জ, গাবতলী, মহাখালী, গাজীপুর, মিরপুর রুটের বাসগুলোতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে বেশি পড়েছেন। এ ছাড়া পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে চক্রের সদস্যরা সোচ্চার বলে সূত্র জানায়।
সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ফুটপাত, লঞ্চঘাট, রেল বা বাসস্টেশন, হাটবাজার ইত্যাদি জনবহুল জায়গায় হকার হিসেবে অবস্থান করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য যেমন ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, ক্রিমজাতীয় বিস্কুট, চকোলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি বিক্রি করে। আবার কখনো এরা যাত্রীবেশে লঞ্চ, বাস বা ট্রেনে উঠে সরাসরি কারও সঙ্গে সখ্য তৈরি করে অজ্ঞানকারী খাদ্যদ্রব্য খাইয়ে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে দুই ঈদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময়ে সবথেকে বেশি সক্রিয় এই চক্রের সদস্যরা। এ সময় তাদের বেশি আনাগোনা থাকে গুরুর হাটে। তারা হাটের বিক্রেতা, পাইকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সঙ্গে সখ্যতা করে তাদেরকে অজ্ঞান করে সর্বোস্য লুটে নেয়। প্রতিবছর গরুর হাটগুলোতে এমন ঘটনা চোখে পড়ে। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, খাবারের সঙ্গে মায়োলাম, নকট্রিন, ইটামিন, লেক্সোটেনিল, লুজিকাম ইত্যাদি চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। এছাড়া কোমল পানীয়র সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন এবং গণপরিবহনের সিটের কাছে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করার কাজটি করা হয়। ঈদ সামনে রেখে তারা এলাকা ভাগ করে ‘অপারেশন’ পরিচালনা করছে।
গত ৮ আগস্ট রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন ৬ জন। এর মধ্যে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছে মকছুদ (৬০), পুলিশ বক্সের সামনে ফরহাদ (৩৫) ও জিয়াউর রহমান জিয়া (৩৮), যাত্রাবাড়ীতে ছিদ্দিক আলী (৭৫) ও কামাল উদ্দিন (৪৫)। গাবতলীতে চামড়া ব্যবসায়ী আশরাফ (৪৮)। তাদের প্রত্যেকের মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা খোয়া গেছে।
একই সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করে। এর মধ্যে- ১ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হল- মো. মোস্তফা (৩৬), মো. জামাল (১৯), মো. মনির হোসেন (৩৫), মো. সেলিম (৪০), মিঠু (৩০), মো. সাঈদ হোসেন (৪০), মো. লিটন (১৯), মো. আলামিন (১৯), মো. আরিফ হোসেন (১৯) ও মো. ফরিদ হোসেন (২৭)। তাদের কাছ থেকে অজ্ঞান করার ২২টি ট্যাবলেট ও বিভিন্ন মডেলের সিমবিহীন ১৩টি চোরাই মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা গণপরিবহনে যাত্রীবেশে উঠে সাধারণ যাত্রীদের অজ্ঞান করার ওষুধ খাইয়ে সর্বোস্ব লুটে নেওয়ার কথা স্বীকার করে।
অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকের মৃত্যু হয় এবং অনেকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে- চলতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় বাসের ভেতরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে দুলাল মিয়া (৪৫) নামে এক বাবুর্চি মারা যান। ১৪ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় মারা যান সিএনজিাচলিত অটোরিকসা চালক এসকান হাওলাদার (৪০)। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট গুলিস্তান থেকে টঙ্গীগামী বিআরটিসি বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে মারা যান জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) কর্মকর্তা শামছুদ্দিন (৪৮)। এছাড়া ২০১৬ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সাবেক সদস্য শাহ আলম মোল্লা (৫৫) মারা যান। এছাড়া ২০১৮ ২ জুন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন একই পরিবারের ৯ জন। ২৬ মে বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে দেশে ফিরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে সর্বোস্ব খুইয়েছেন দুবাই প্রবাসী নাজিম উদ্দিন (৩০)। ৩ এপ্রিল গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে পাঁচ লাখ টাকা খোয়ান তিন গরু ব্যবসায়ী সামছুদ্দিন মোড়ল (৬৫), রাসেদুল ইসলাম (৪০) ও মনির হোসেন (৬৬)।
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করে। তবে ঈদের আগে নগদ অর্থের ছড়াছিড়ি বেশি থাকায় তাদের সোচ্চারতা বাড়ে। তিনি বলেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিজান অব্যাহত আছে। চলতি মাসেও চক্রের অনেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে দেশের পশুরহাটগুলোতে আইনি শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিসহ নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, কোরবানির ঈদে গরুর বেপারি ও ক্রেতাদের মধ্যে নগদ অর্থের লেনদেন বেশি থাকে। এ সময়ে অনেক নতুন লোক গ্রাম থেকে হাটগুলোতে আসে। অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা তাদের সঙ্গে সখ্য করে অর্থ ও মূলবান জিনিস নিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি বলেন, র‌্যাব নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। গরুর হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা ও বাড়ি ফেরত সাধারণ মানুষ অপরিচিত কারো সঙ্গে মেলা-মেশায় সতর্ক থাকলে চক্রের সদস্যরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ