Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছিন্নমূলদের দিনাতিপাত এবং অনিশ্চিত আগামীকাল

প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক মো. শাহীন শাহ
মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সংগ্রাম করার জায়গাটা চলে যায় শূন্যের কোটায়। ভাসমান আর পরগাছা একই সূত্রে গাঁথা। সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে তারা চলে যায় অনেক দূরে। শেকড়ের সন্ধান করা তাদের হয়ে ওঠে না কখনো। তাদের জায়গা হয় শহরে, বন্দরে, নগরের পরিত্যক্ত জায়গায়। খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করতে হয় কুকুর-বিড়ালের সাথে। আর এই দৃশ্যটি অহরহ সবার চোখে পড়ে। দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও এড়ানো সম্ভব হয় না কারোই। এরা ছিন্নমূল এরা ভূমিহীন। এদের সমাজ নেই, সংস্কৃতি নেই। এরা ভাসমান, এরা পতিত, এরা হিন্দু না মুসলমান রাষ্ট্রযন্ত্রের তাতে আসে-যায় না। তারা সমাজের বোঝা-বিবেকের বোঝা। ওরা উচ্ছিষ্ট, নর্দমার কীটপতঙ্গের ন্যায় তাদের যাপিত জীবন। তাদের ঠিকানা হয় রেললাইনের দুই ধারে বস্তিঘরে। তাদেরকে ভিক্ষুক বলি, বলি টোকাই, এই দুইটি টাইটেল তাদের নামের আগে পরে সেঁটে দেওয়া হয়। অথচ তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের সমর্থন ছিল প্রত্যক্ষ। কামনা-বাসনা-স্বপ্ন দেখত প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধী মনোভাব ছিল এমন কোন ছিন্নমূল পর্যায়ের লোক আছে বলে গত ৪৫ বৎসরে কারো মুখ থেকে একটিবারও উচ্চারিত হয়নি। বরং এমন অনেক উদাহরণ আছে যা গা শিহরে না উঠে উপায় নেই। একজন ভিক্ষুক সারাদিন এ বাড়ী-ও বাড়ী, এ গাঁও থেকে ঐ গাঁয়ে ভিক্ষা করে সঞ্চিত অর্থ ও কড়ি পুঁটলিভরা চাল মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়ে এটা স্বীকার করে নেন। ছিন্নমূলদের কেন এত অবহেলা? কেন পুনর্বাসনে তাদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই? তারা কি অন্য গ্রহের মানুষ? তারা কি ত্রাণের ঢেউটিন? ফুটপাতে, অলিগলিতেম রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে প্রচ- রোদে, বৃষ্টিতে কেন তাদেরকে পড়ে থাকতে হবে? তাদেরকে অবহেলা করে উন্নত সমাজ বিনির্মাণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা এখন ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি মধ্যম আয়ের কিংবা উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দিকে তাকাই ঐসব দেশের রাষ্ট্রনায়করা সর্বপ্রথমে ছিন্নমূল বন্ধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সফল হয়েছে।
একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকেরই ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। আমি আমার বিবেকের তাগিদে ছিন্নমূলবাসীর জীবন ও দর্শন তাদের কামনা-বাসনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। তাদের কাছ থেকে এবং তাদের চলনে-বলনে, আচার-আচরণে বুঝতে সক্ষম হলাম যে, তাদের আগামীকাল বলতে কিছুই নেই। এটি তাদের নিকট অস্পষ্ট এবং ঝাপসা। অনিশ্চিত জীবন কতটা সুখকর তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না যে কারোই। আজকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ করে সম্মানী ভাতা দেয়া হচ্ছে। বয়স্কদের ভাতা দেয়া হচ্ছেÑএদের ক্ষেত্রে কেন সম্ভব হবে না? এরাতো সবাই ছিল স্বাধীনতাকামী, স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সহযোগিতা ছিল। এদেরকে কেন নিয়ে যাব ভিক্ষুক আর টোকাইর কাতারে এরা কেন হবে শিরোনামহীন যাযাবর। এদের কেন থাকবে না পরিচয় ও মর্যাদা। স্বাধীনতার স্বাদ তাদের নিকট নিশ্চয় তিক্ত। স্বাধীনতার পূর্বে কেউ কেউ জমি ও জোতদার ছিলেন, আজকে কেন ভিক্ষুক আর টোকাই। এদেরকে কেন দেখা যাবে বটতলায়, ডাস্টবিনের ধারে কুকুর-বিড়ালের সাথে রীতিমত উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য যুদ্ধ করতে। এই কি মানবপ্রেম। এই কি মানবের ভালোবাসা! মদুসূদন থেকে জীবনানন্দ পর্যন্ত সবাই আবেগের, ভালোবাসার, দেশপ্রেমের অমিয় ছন্দে সঞ্চালন করে গেছেন অবারিত সবুজের বুকে, সবার হৃদয়ে। তবুও ছিন্নমূলবাসী অপাঙ্ক্তেয় শরণার্থী প্রায় সব খারাপ বিশেষণে সংজ্ঞায়িত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এইগুলো মৌলিক অধিকার, বোধকরি এই চারটি অনুপস্থিত এইসব নাগরিকদের ক্ষেত্রে। আজকে মাথাপিছু গড় আয় এক লক্ষ টাকার উপরে। ছিন্নমূলবাসীদের নিয়েই এই হিসাব করা হয়েছে। বাস্তবে মাথাপিছু আয় ছিন্নমূলবাসীর শূন্য। কারণ ভিক্ষুকের এবং টোকাইর আয় জাতীয় আয়ে গণনা করা হয় না। বায়বীয় মধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে আওয়াজ তুলে সাময়িক সুখ পাওয়া যাবে কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী সুখ অনুভব নয়। আজকে তাদেরকে দিয়ে যদি শ্লোগান তুলতে বলা হয়- ‘জয় বাংলা’ কিংবা গাইতে বলা হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ তারা কি এই শ্লোগান কিংবা জাতীয় সঙ্গীতটি মন থেকে নিংড়িয়ে গাইতে পাড়বে? নিশ্চয়ই না, তাদের কণ্ঠ থেমে যাবে, কেঁপে উঠবে বুক এবং বিড়বিড় করে শব্দ আওড়াবে এই কি আমার স্বাধীনতা! এইকি আমার সোনার বাংলা! ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, স্বাভাবিক জীবনযাপন কেন অনিশ্চিত? আমাদের আগামীকালটা কেন ঝাপসা?
ছিন্নমূল যারা- তারাতো রাষ্ট্রের সীমানার বাইরের কেউ নন। তারা এদেশের সন্তান। তাদের পিতৃপরিচয় আছে, আছে ধর্মের পরিচয়। নদীভাঙনে হয়তো তাদের ঠিকানা চলে গেছে কিন্তু তাদের মানচিত্র মুছে যায়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখতে তো জাতীয় পতাকা হাতে ও মাথায় বেঁধে নাচে। তিন বলে দুই রান নিতে না পারাতেও তো কাঁদে, কষ্ট পায়, হতাশ হয়। আবার কেহ কেহ ভূমিখেকোর খপ্পরে পড়ে জমি, জোত, ভিটামাটি হারিয়ে ছিন্নমূলে নাম লেখায়। প্রথমটা হয়তো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হয়। দ্বিতীয়টা তো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সরকার মহাশয়দের একটু দায়িত্ব নিলেই চলে। তাহলে পরে ভিক্ষাবৃত্তি ও টোকাই বৃত্তি পেশাটা স্বমূলে উৎপাটন করা সম্ভব। পাইপলাইন থেকে সঞ্চালনের জায়গাটা বন্ধ করে দিতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করতে হবে না। বস্তিতে আগুনে পুড়ে অবুঝ শিশুসহ অসহায়দের চিতা যন্ত্রণায় মরতে হবে না। ছিন্নমূল সুরক্ষানীতি মর্মে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে ছিন্নমূলদের রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র অনেক দিবসই স্বীকৃতি দিয়ে চালু করেছে। এতে উপকৃত হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক জনগণ। ছিন্নমূলদের রক্ষার প্রয়োজনে ছিন্নমূল দিবস সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বসহকারে ব্যাপক প্রচার-প্রসারণায় এগিয়ে আসতে হবে। জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে অনেক সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে পারলে ছিন্নমূলদের দিয়ে তা কেন সম্ভব হবে না। দরকার একটি ভালো পরিকল্পিত উদ্যোগ।
অর্থমন্ত্রী মহোদয় আপনি এবার জাতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। সর্বস্তরের মানুষ আপনাকে ধন্য করেছে, হয়েছেন সম্মানীত। যদিও আমরা আমাদের নিকট অতীত এবং বর্তমানকে নিয়ে খুব বেশি তৃপ্ত নই। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউ সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরে আঘাত সবার মনকে আহত করেছে। একজন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হিসেবে যথেষ্ট সুখ্যাতি আপনার রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে এশিয়ার বৃহৎ সেতু পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। রাষ্ট্রের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রত্যাশা রইল ছিন্নমূলদের জন্য পুনর্বাসনমূলক জাতীয় বাজেটে নির্দিষ্ট হারে বরাদ্দ দিবেন।
শীতের রাতে মধ্য প্রহরে দানবীরেরা কম্বল এবং অন্যান্য শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। ফুটপাতে, স্টেশনের ফ্লাটফর্মে ঘুমন্ত শীতার্ত ছিন্নমূল মানুষেদের। এটা ঠিক প্রক্রিয়া নয়। এতে করে দানের ক্ষেত্র তৈরি হয় কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। হাজারকে না দিয়ে দশজনকে সেই পরিমাণ অর্থ দিলে এরা স্বাবলম্বী হবে নিশ্চিতভাবে। কেউ কেউ প্রচার-প্রসারের আশায় নিজের আবাসগৃহ থেকে লুঙ্গি-শাড়ী বিতরণ করেন দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষদের। একটি লুঙ্গি কিংবা শাড়ীর জন্য পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। দানবীরদের কিছুই হয় না। একটি লুঙ্গি কিংবা শাড়ীর মূল্য যত এই গরীবদের জীবনেই মূল্যও যেন ততই। দানের ক্ষেত্র সৃষ্টি না করে সবাই মিলেমিশে ফান্ড তৈরি করে দরিদ্র কিংবা ছিন্নমূলদের দারিদ্র্য লাঘবের প্রয়াসই উত্তম পন্থা।
সর্বশেষে বিশিষ্ট কবি (প্রয়াত) আব্দুল ওহাব এর বুচি আমার বুচি কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি :
হয়তবা জন্ম আমার দক্ষিণ এশিয়ায়-বাংলাদেশে
মা আমার ফুটপাতে শীতার্ত রাতে
ছিন্ন কাপড়ের টুকরোয় টেনে নেয় বুকে
কুয়াশার কফিনে মোড়া দারিদ্র্যের হতশ্বাসে
কেঁপে ওঠে রাতের আকাশ, রাতের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে
হাইওয়েতে ছুটে চলে রিলিফের ট্রাক
আমারও চোখে জাগে সন্ত্রস্ত সংশয়
এইকি আমার সেই প্রার্থীত পৃথ্বি হে প্রভূ!
ষ লেখক : আহ্বায়ক, সাহিত্য কল্যাণ পরিষদ এবং উপদেষ্টা, আলোক বর্তিকা সংঘ, কুমিল্লা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছিন্নমূলদের দিনাতিপাত এবং অনিশ্চিত আগামীকাল
আরও পড়ুন