Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিবহন সেক্টরে চরম নৈরাজ্যে

অলিউর রহমান ফিরোজ | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের কারণে অকালে ঝড়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ-তরুণী। পরিবারের আশা-আকাঙ্খা মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে পরিবহনের চালক নামের বিবেক বিবর্জিত মানুষগুলো। তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে সড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। কিন্তু তাতে করে রাষ্ট্রের যেন কোনো প্রকার মাথা ব্যথা নেই। জবাবদিহিতার বালাই নেই। যে যেভাবে পারছে মানুষকে জিম্মীদশায় পরিণত করে ছাড়ছে। গজারিয়ায় পায়েলকে বাসের সুপারভাইজার থেকে শুরু করে হেলপার এবং চালক যেভাবে নৃশংসভাবে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে তা সভ্য সমাজে চিন্তা করা যায় না। তাদের পশুর সাথে তুলনা করলেও পশু সমাজের দুর্নাম করা হবে। পশুর আচরণে এতোটা পররিবর্তন লক্ষ করা যায় না। তারা বিনা কারণে অন্য কোনো প্রাণিকে এভাবে হত্যা করে না। তাকে যদি আহত অবস্থাতেও ফেলে যেতো তাহলেও সে হয়তো বেঁচে যেতো। এদিকে আরো ভয়ানকভাবে কুর্মিটোলা ফ্লাইওভারের ঢালে দুই বাসের রেষারেষিতে জাবালে নূর গাড়ির চালক গাড়ির জন্য অপেক্ষারত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর যেভাবে বাসটি উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করলো সে নিষ্ঠুরতার কোনো নজির মিলে না। এর আগে রাজীবের ঘটনাটি দেশের মানুষ এখনোও ভুলে যায়নি। বাবা-মা হারা রাজীবের আরো দুটি ভাই ছিল, যারা রাজীবের ভবিষ্যত পথের দিকে চেয়েছিল। আজ রাজীবের সেই এতিম ভাই দুটি আরো এতিম হয়ে গেছে। সেই ঘটনা যদি যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, তাদের মনে সামান্য রেখাপাত করতে পারতো তাহলে কুর্মিটোলার ফ্লাইওভারের ঘটনা ঘটতে পারতো না। বেসরকারি ফার্মে কর্মরত রূপার কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। সামান্য সুযোগ পেয়ে মেয়েটির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাসের হেলপার, চালক এবং সুপারভাইজার। তাদের লালসার নির্বিচার শিকার হয়েছিল রূপা। তারা নিষ্ঠুরভাবে রূপাকে হত্যা করে বনের নির্জন জায়গায় ফেলে যায়। বনের কোনো পশু, হিংস্র জানোয়ার রূপার শরীরে একফোটাও নখের আচড় বসায়নি। সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আরেক পোশাক কারখানার নারীকে চলন্ত বাসে জোরপূর্বক হায়েনারা লালসা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নারী তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল। গণপরিবহনে যদি একজন পায়েলকে হত্যার শিকার হতে হয়। চলন্ত গাড়িতে যদি রূপার ইজ্জত লুট হয়ার পর মৃত্যু ঘটে, তাহলে এর দায়ভার কে নিবে? রাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে না আসে তাহলে হায়েনাদের কবল থেকে আমাদের মা-বোনদের, ছেলে-মেয়েদেও জীবন ও ইজ্জত রক্ষা কীভাবে হবে? কুর্মিটোলায় বাসচাপার ঘটনাটি শুনে নৌপরিবহন মন্ত্রী বলেছেন, ভারতে বাসচাপায় মানুষ মরলেও তো এরকম হৈচৈ হয় না। আমাদের দেশে কেন এরকম হয়? তার এ বক্তব্যে দেশের মানুষের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ায়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে একজন মন্ত্রী এক ছোট বাচ্চা মারা যায়ার ঘটনায় বলেছিল আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে। তখন সে বক্তব্যে দেশের মানুষের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। মূলত বাসের চালক হিসেবে যারা ষ্টিয়ারিংয়ে বসেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অত্যন্ত কম। তার ওপর রয়েছে পেশাগত অদক্ষতা। সেখানে অধিকাংশ চালকেরই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। একজন প্রশিক্ষিত চালক যখন লাইসেন্স নিতে যান তখন তাকে গাড়ি চালানোর বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। গাড়ি চালানোর জন্য অনেক নিয়ম-কানুন জানতে হয়। কিন্তু একজন হেলপার যখন গাড়ি চালকের আসনে বসে, তখন তার ভেতরে কোনো অভিজ্ঞতার ছোঁয়া থাকে না। গাড়ি নিয়ে সড়কে বের হলেই বেপরোয়া ভাব তার মধ্যে তৈরি হয়। তাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা মানুষের অহরহ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। অনেকে আবার রাস্তার পাশে বসা দোকানের ওপর গাড়ি উঠিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। মহাসড়কের পাশে রাতে পরিবার নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা পরিবারের ওপর গাড়ি চালিয়ে পুরো পরিবারটির হত্যা করার মতো ঘটনা আমাদের দেশে আছে। তারা অনেক সময় গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলে কথা বলে, যা নিষিদ্ধ। কিন্তু কে মানছে আইন! অনেক সড়ক আছে যেখানে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গতিরোধক যন্ত্র বসিয়ে গতি মাপা হচ্ছে। তারপরও তাদের গতি, কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না, মানুষ মারা রোধ করা যাচ্ছে না। পঙ্গু হাসপাতালগুলোতে গেলে বুঝা যায়, সড়কে আহত মানুষের করুণ আহাজারী। কুর্মিটোলার দুর্ঘটনার আবদুল করিম এবং দিয়া খানমের লাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এক সময় আমরা ভুলে যাবো আসবে অন্য ঘটনা। তারপর হয়তো সে ঘটনাও আমরা ভুলেই যাবো। এভাবেই কি পরিবহনের নৈরাজ্যে চলতে থাকবে? আমরা কি এর কোন গতিরোধ করতে পারবো না?
সমস্যা রয়েছে দেশের পরিবহন সংক্রান্ত আইনে। একজন পথচারীকে চালক চাপা দিয়ে হত্যা করলে তার জন্য রয়েছে সামান্য জেল-জরিমানা। আইনের দুর্বলতা সংশোধন করা না গেলে চালকদের দৌরাত্ম্য রোধ সম্ভব নয়। আবার কোনো চালককে যদি গ্রেফতার করা হয় তার জন্য দেশের পরিবহনের নেতারা ধর্মঘট ডেকে পুরো দেশ অচল করে দেয়। তাদের আগে আইনের জালে ধরতে হবে। কোনো গাড়ির মালিক যখন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়, তার অবশ্যয় ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হতে, এটা নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। সরকারের পক্ষ থেকেও ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত পরিবহন সেক্টরকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে সরকারকে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিতে হবে। শিক্ষিত চালকদেরই ধীরে ধীরে গাড়ির চালকের আসনে বসাতে হবে। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের জন্য কান্না। এখন প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। তাতে করে কারো জীবন চিরতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার পঙ্গুত্ব বরণ করে অন্যের কাঁধের বোঝা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এখন আবার দুর্ঘটনা নতুন মাত্রা পেয়েছে সেটা হলো, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা। তাদের কোনো নিয়মনীতর মধ্যে আনা যাচ্ছে না। মোটর সাইকেল চালকরা অনেক সময় রাস্তায় জ্যাম থাকলে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতেও গাড়ি উঠিয়ে দেয়। এতে পথচারীরা ফুটপাত ধরে হাঁটতে পারে না। বেপরোয়া ও অনিয়মের মধ্যে গাড়ি চালাতে যেয়ে অযথা হর্ন বাজানোরও প্রবণতা লক্ষনীয়। এতে করে মারাত্মকভাবে শব্দ দূষণ ঘটছে। শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছে অসুস্থ ও হার্টের রোগীরা। যে সড়কে যতোটুকু গতি রয়েছে, গাড়ি চালাতে তা অবশ্যই মানতে হবে। নইলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা যে কোনো সময়ে ঘটবে। এখানে একটি কথা বলতে হয়, মোটর সাইকেল চালানোর জন্য কিছু নির্দিষ্ট সড়ক রয়েছে। রয়েছে গাড়ির কিছু নিয়ম-কানুন। মোটর সাইকেল নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করা আজরাইলের হাতে জান সোপর্দ করারই শামিল। কারণ, মহাসড়কে বেশি গতির যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করলে সহজেই দুর্ঘটনা ঘটে। বড় গাড়ির লুকিং গ্লাসে অনেক সময় ছোট মোটর সাইকেল ধরা পড়ে না। নিয়ম না মেনে ওভারটেক করাও বিপদজনক। মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। তাছাড়া দুর্ঘটনায় হতাহতের বেশি কারণ হলো-নিয়ম মেনে কেউ গাড়ি চালায় না। মাথায় হেলমেট পরার কথা থাকলেও পরে না অধিকাংশ মোটর সাইকেল চালক। তাই কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটলেই মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়। বড় গাড়ি থেকে প্রাইভেটকারের চালকদেরও সিটবেল্ট বাঁধার নিয়ম রয়েছে। যতো ধরনের খামখেয়ালীপনা আছে তা যেন গাড়ি চালকদের মধ্যে বিরাজমান। প্রশিক্ষিত একজন ড্রাইভারের যেমন থাকে গাড়ি চালানোর নিয়ম কানুন জানা, তেমনি থাকে কখন কীভাবে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দেখা যায় অধিকাংশ চালকেরই কোন ধরনের প্রশিক্ষণ নেই, লাইসেন্স নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে ফোনে কথা বলাও গাড়ি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মহাসড়কে যত্রতত্র রোড ডিভাইডার বসানোর ফলেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিবহন


আরও
আরও পড়ুন