দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
হাদীসে কুদসীতে এসেছে- “হে আমার প্রিয়নবী! যদি আপনি না হতেন তাহলে আমি এ বিশ্ব জগতকে সৃষ্টিই করতাম না।” অর্থাৎ যদি বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (স) এ ধরাধামে আসার না হত তাহলে এসব জিন ও মানুষ, সূর্য ও চন্দ্র, গাছ ও পাথর, জল ও স্থল, ফুলের সৌরভ, চড়ূই পাখিদের আনাগোনা, সবুজের সমারোহ,আকাশ-পাতাল, উঁচু-নিচু, সৌভাগ্য-দূর্ভাগ্য, ভুমির আদ্রতা, সূর্যের প্রখরতা, নদীর স্রোত, আকাশের নক্ষত্র, শরৎ ও বসন্ত, মরুভুমি ও উটপাখি, তরুলতা ও জড় পদার্থ, সোনা-রূপা ও খনিজ সম্পদ, বনের হিংস্রপানি, বাতাশে উড়ে-বেড়ানো পাখি, মোটকথা বিশ্ব জগতের কোন বস্তুর নাম-চিহ্ণও অস্তিত্বে আসতো না।
বিশ্ব-চরাচরের অহঙ্কার, শ্রেষ্ঠজনদের শীর্ষ-মনীষী,সর্ব-জগতের প্রভুর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন নবী মুহাম্মদ (স) সেই সমূহ গুণাবলীর আধার : ১। যাঁর খাতিরে এ বিশ্বচরাচর অস্তিত্ব পেয়েছে। ২। যাঁর বরকতে মানবতা বিবেক-সম্বিত প্রাপ্ত হয়েছে। ৩। যাঁর গলায় ‘যদি আপনি না হতেন’-এর হার পরিধান করানো হয়েছে। ৪। যাঁকে- “আর আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চমর্যাদা দান করেছি”-এর মুকুট পরিধান করানো হয়েছে। ৫। যাঁর সম্মানীত নামের দ্বারা বেহেশতী বৃক্ষসমূহের প্রতিটি পাতা-পল্লব রূপ-সৌন্দর্য প্রাপ্ত হয়েছে। ৬। যাঁর নামের বরকতে হযরত আদম (আ) এর তাওবা কবূল হয়েছে। ৭। যাঁর বরকতে হযরত ইবরাহীম (আ) নেতৃত্বের উপাধী প্রাপ্ত হয়েছেন। ৮। যাঁর কালিমা হযরত সুলায়মান (আ) এর আংটির ওপর খচিত ছিল। ৯। যাঁর রূপ-সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব হযরত ইউসুফ (আ) প্রাপ্ত হয়েছেন। ১০। যাঁর ধৈর্য-সবরের নমুনা হযরত আইয়ূব (আ) প্রাপ্ত হয়েছেন। ১১। যাঁর প্রাপ্ত নৈকট্যের এক মুহূর্ত হযরত মূসা (আ) এর মাওলার সঙ্গে বাক্যালাপের আকারে ভাগ্যে জুটেছে। ১২। যাঁর সম্মান-মর্যাদার একাংশ হযরত হারুন (আ) মন্ত্রিত্বপ্রাপ্তির আকারে প্রাপ্ত হয়েছেন। ১৩। যাঁর শানে রচিত না‘ত এর একটি পঙক্তি হযরত দাউদ (আ) এর সুরের উৎস হয়েছে। ১৪। যাঁর পুতঃপবিত্রতার ঘ্রাণ নবীগণের ‘নিষ্পাপ’ হওয়ার পথ আলোকিত করেছে।
১৫। যাঁর বিজ্ঞ দর্শনসুলভ জ্ঞানভান্ডারের একটি লাইন হযরত লোকমান (আ) এর ভাগ্যে জুটেছে। ১৬। যাঁর সুউচ্চ মান-মর্যাদার একটি ঝলক হযরত ঈসা (আ) এর ভাগ্যে জুটেছে। ১৭। যাঁর পুণ্যবান অস্তিত্ব হযরত ইবরাহীম খলীল (আ) এর দু‘আ ও হযরত ঈসা মসীহ (আ) এর অলৌকিক জন্মের উৎস বটে। ১৮। যাঁর আগমণ সুত্রের বরকতে আবরাহার সৈন্যরা ‘কর্তিত’ শস্যে পরিণত হয়েছিল। ১৯। যাঁর শুভ জন্মের দ্বারা পারশ্যের উপাস্য অগ্নিকুন্ড নির্বাপিত হয়েছিল। ২০। যাঁর ফয়েয ও বরকতপূর্ণ মুখে দোলনায় শায়িতাবস্থায় শৈশবে ‘আল্লাহ আকবার’ বাক্য উচ্চারিত হয়েছে। ২১। যিনি নবী হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই ‘আল্-আমীন’ তথা সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত উপাধিতে ভ’ষিত হয়েছিলেন। ২২। যাঁর ‘ রাসূল’ হওয়ার সাক্ষ্য জড়পদার্থও প্রদান করেছে। ২৩। মি‘রাজ এর মত অলৌকিক সুমহান ঘটনা একমাত্র তাঁরই ভাগ্যে জুটেছে। ২৪। যাঁর পবিত্র দরবারের দ্বাররক্ষী সিদ্দীক আকবরের মত মনীষী হয়েছেন। ২৫। যাঁর ঈমানের ভান্ডার এর প্রভাবে ফারূকে আ‘যম (রা) ঈমান প্রাপ্ত হয়েছেন। ২৬। যাঁর লজ্জাশীলতার জ্যোতির প্রভাবে উসমান (রা) যিন্নুরাইন হয়েছেন। ২৭। যাঁর জ্ঞানসমুদ্রের ফোটাসমূহের দ্বারা আলী মুরতাযা (রা) ‘বাবুল-ইলম’ হয়েছেন। ২৮। যাঁর শহরকে বিশ্বজগতের মালিক ‘বালাদে-আমীন’ বলেছেন। ২৯। যাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবকে ‘কিতাবে-মুবীন’ বলেছেন। ৩০। যাঁর প্রতি মহান প্রভু ও তাঁর ফিরিশতারা দরূদ পাঠান। ৩১। যাঁর উম্মতকে মহান রব নিজেই ‘শ্রেষ্ঠ উম্মত’ নামে উল্লেখ করে থাকেন।
-সেই বিশিষ্ট রাসুলগণের মধ্যেও যিনি আরও বিশিষ্ট তাঁর প্রতি আদব-শিষ্টাচার রক্ষা করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
“নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে যথাযথ আদব- সম্মান কর ; ” (সূরা : আল-ফাত্হ : ৮-৯)
পবিত্র কুরআন হতে উদাহরণসমুহ:
উদাহরণ-০১: মহানবী (স) এর প্রতি আদব রক্ষা সর্ম্পকিত পবিত্র কুরআনে কয়েকটি উদাহরণ বিদ্যমান। যেমন- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল তাঁর সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না ; এ আশঙ্কায় যে, তোমাদের সকল আমল বিনষ্ট হযে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।” (আল-হুজুরাত : ২)
আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (র) উক্ত আয়াতের অধীনে লিখছেন : “অর্থাৎ মহানবী (স) এর মজলিসে হৈচৈ করবে না। যেমনটি নিজেরা আপসে পরস্পর নির্দিধায় রাগের স্বরে,ত্যাক্ত-বিরক্তির স্বরে ঝটপট করে থাক। মহানবী (স) এর ক্ষেত্রে তেমনটি আদব-পরিপন্থী আচরণের নামান্তর। তাঁর সঙ্গে সম্বোধনের প্রয়োজনে নম্রসরে, সম্মান-মর্যাদাসহ, আদব-ভদ্রতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেখুন, একটি ভদ্র পুত্র তার পিতার সঙ্গে, সুযোগ্য ছাত্র তার শিক্ষকের সঙ্গে , নিষ্ঠাপূর্ণ মুরীদ তার শায়খ-পীরের সঙ্গে এবং একজন সৈনিক তার অফিসারের সঙ্গে কিভাবে কথা বলে ? একজন নবীর মর্যাদা তো এসবের চেয়ে অনেক ঊর্ধে!
মহানবী (স) এর সঙ্গে বা তাঁর ব্যাপারে বাক্যালাপ কালীন পূর্ণরূপে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, আল্লাহ না করুক যদি তাঁর সঙ্গে বা শানে বে-আদবী হয়ে যায় এবং তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে যায় তাহলে একজন মুসলমানের আর কোন আশ্রয় থাকলো না। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সকল আমল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার এবং সারা জীবনের সব শ্রম-সাধনা ধংস হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।”
‘মুসনাদে বাযযার’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত আবূ বকর (রা) নিবেদন করলেন,“ হে আল্লাহর রাসূল (স) ! আল্লাহর শপথ! এখন তো আপনার সঙ্গে এভাবে কথা বলবো যেভাবে কেউ কানে-কানে কথা বলে থাকে”। ‘ দুররে মানছুর’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, উক্ত ঘটনার পর হযরত উমর (রা) অনেক নীচুস্বরে মহানবী (স) এর সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন। বুখারী শরীফে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আনসারদের উচ্চস্বরবিশিষ্ট খতীব হযরত সাবিত ইবন কায়েস (রা) যখন এ আয়াতটি শুনলেন তখন তিনি গৃহে নির্জনে অবস্থান করতে লাগলেন। সা‘আদ ইবন মায়া‘য (রা) একদা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি অবস্থা ? তিনি বলতে লাগলেন-
“অবস্থা ভালো না, যে তার আওয়ায মহানবী (স) এর আওয়াযের চেয়ে বড় করবে তার তো সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং সে জাহান্নামী হয়ে যাবে (আমিও তো তার একজন)”।
হযরত সা‘য়াদ ইবনে মায়‘ায (রা) এ অবস্থা যখন মহানবী (স)-এর কাছে পেশ করলেন তখন মহানবী (স) ইরশাদ করলেন, তোমরা তাকে গিয়ে বল,
“আপনি জাহান্নামী নন, আপনি অবশ্যই জান্নাতের অধিবাসী”। অর্থাৎ সৃষ্টিগতভাবে কেউ একটু উচ্চস্বরবিশিষ্ট হওয়াতে বাক্যালাপ কালীন আওয়ায একটু বড় হয়ে গেলে তা ক্ষমাযোগ্য। তারপরও যথাসাধ্য আওয়ায যেন বড় হয়ে না যায়, সচেষ্ট থাকবে। কারণ, এটাই হচ্ছে আদবের দাবী। মহানবী (স) এর প্রতি এ আদব প্রদর্শন যেভাবে তাঁর বরকতপূর্ণ জীবদ্দশার ক্ষেত্রে অবশ্য জরুরী ছিল একইভাবে তা তাঁর ইন্তেকাল পরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রেও অবশ্যই জরুরী বলে গন্য। আজও মসজিদে নববী (স) এর রওজা শরীফের দিকের দেওয়ালের গায়ে উক্ত আয়াতটি খোদাই করে লিখিত আকারে বিদ্যমান। যিয়ারতকারীদের জন্য জরুরী, পবিত্র রওজা শরীফে উপস্থিতির সময়, সালাত ও সালাম পাঠ কালীন নিজ নিজ আওয়ায নীচু রাখা চাই। জনৈক কবি বেশ সুন্দর বলেছেন-
“আকাশের নিচে পৃথিবীপৃষ্ঠে, মহান আরশের চেয়েও স্পশর্^কাতর বিষয় হচ্ছে এ আদব,
জুনাইদ ও বায়েজীদ আদব রক্ষার্থে নিজেকে বিলীন করে দিয়েই পেয়েছেন এ আসন।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।