Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রাজনৈতিক কর্মী, অনানুষ্ঠানিক শক্তি ও রাষ্ট্রের দায়

প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রফেসর ড. মখদুম মাশরাফী
সমাজের অনানুষ্ঠানিক শক্তির ভেতর থেকে সরকারি আনুষ্ঠানিক শক্তির সারাৎসারকে উদ্ঘাটন করাই রাজনৈতিক দলের প্রক্রিয়া ও অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। পুরো রাজনৈতিক দল অস্তিত্ব ও প্রক্রিয়া হিসেবে বিরাজ করে এই মূল উদ্দেশ্যকে ঘিরে। সাধারণ্যে বিরাজিত একটি ধারণা এই যে, রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া। এই কথাটি রাজনীতি বিজ্ঞানের সব সিলেবাসেই এভাবেই গৃহীত ও আদৃত। অথচ যথার্থ অর্থে বিষয়টি আদৌ তা নয়। মূল বিষয়টি হচ্ছে গণঅনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার ভেতর থেকে সরকারি আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার উদ্ঘাটন, যা রাষ্ট্রের নীতি নিরুপন ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন, তাই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, সামাজিক অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার নির্যাস থেকে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক নীতি ক্ষমতার উদ্ঘাটন হচ্ছে রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হচ্ছে গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষমতা প্রক্রিয়াকরণ, ক্ষমতায় যাওয়া নয়।
রাজনৈতিক দলের প্রক্রিয়া সামগ্রিক সমাজ বিস্তৃত। সমাজের সব কৌণিকতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তাকে এগুতে হয়। এটি যুগপৎ একটি শিল্প ও সাধনা এবং একটি ধ্যান ও নিষ্ঠার বিষয়। এর জন্যে প্রয়োজন যেমন দূরদর্শিতা তেমনি গাঢ় সমাজ ঘনিষ্ঠতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। সমাজ ঘনিষ্ঠতা ও সমাজের অনুভূতিকে যথার্থভাবে অনুভব করার জন্য আর সামাজিক দায়বদ্ধতা রাজনীতিগত সেবা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং গণআলোকায়ন প্রক্রিয়াকে উত্তরোত্তর ত্বরান্বিত করার জন্য। গণআলোকায়নের ধারাকে উত্তরণমুখী না করতে পারলে সেটি সব সময় রাজনৈতিক দলের জন্যে একটি আত্মপ্রবঞ্চনার বিষয় হয়ে থাকে। তখন রাজনৈতিক দল নিছক উত্তেজনা ও সমাজ-বিপরীত ক্ষমতায়নের বিষয় হয়ে যায়। তখন কেবল সংঘাত উত্তরোত্তর সাংঘাতিক হয়ে উঠতে থাকে। তখন রাজনৈতিক সাংঘর্ষিকতা অবধারিত হয়। তখন রাজনীতি আর রাজনীতি থাকে না। ম্যানুয়্যাল বা ফিজিক্যাল হয়ে যায়। তখন রাজনীতি আমিত্বে আক্রান্ত হয়। সামাজিক ’আমরার’ বিষয়টি পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। রাজনীতির ভেতর থেকে বুদ্ধিবৃত্তি যত ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যেতে থাকে ততই রাজনীতি অপরাজনীতিতে পরিণত হতে থাকে। এই ধারার বিপরীতের জন্যে মূলত রাজনৈতিক দল। এই বিশাল সমাজ সামগ্রে বিচিত্র সামাজিক কৌণিকতাকে ছুঁয়ে ছুঁেয় যেতে হলে চাই বিশাল একটি রাজনৈতিক কর্মী গোষ্ঠী, যারা রাজনৈতিক দলে থেকে এবং রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করবে। এদের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক দলের কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হয়।
সমাজ ও রাজনীতির দুই সীমান্ত বরাবর চষে বেড়াতে হয়। দুটির ভেতরে ইতিবাচক সন্ধি সৃষ্টি করতে হয়। সামাজিক অনুভূতিকে রাজনৈতিক বাস্তবের সঙ্গে সমন্বিত করে প্রতি পলে ও পর্বে আলোকায়নকে নিশ্চিত করতে হয়। একই সঙ্গে নিজেদের কর্মানুবন্ধের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মীদের নিজেদের গ্রহণযোগ্য করার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপায় আছে। ইতিবাচক উপায় হচ্ছে- সমস্যা ও সঙ্কটের সমাধানকে চিহ্নিত করে গণউপলব্ধির ভেতরে উপস্থিত করা আর নেতিবাচক উপায় হচ্ছে- কোন শত্রু চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে গণচেতনাকে সংগঠিত করা। ইতিবাচক উপায়টি সৃষ্টি করে সমন্বয়বোধ ও উপলব্ধি আর নেতিবাচক উপায়টি সৃষ্টি করে উত্তেজনা ও আক্রমণাত্মকতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীল অগ্রগতির জন্যে ইতিবাচক উপায়টি কেবল প্রযোজ্য নেতিবাচকটি নয়। ইতিহাসগত ও সমাজ ঐতিহ্যগত কারণে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে নেতিবাচক উপায়টি সাধারণভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এর ফলে নৈরাজ্যকরতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে যার সুদূরপ্রসারী ফল অপরাজনীতি বা বিকৃত রাজনীতি। এই বিন্দুতে রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের ভেতরে থেকে সুনির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ পেলে তারা ইতিবাচক উপায়ের অনুকূলে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অভ্যেস হচ্ছে মানুষের দ্বিতীয় প্রকৃতি, এ সত্যের মতোই তারা ইতিবাচক উপায়প্রবণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ইতিবাচক উপায় প্রবণতার অভ্যাস গড়ে তোলে রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে। এতে করে তাদের একটি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ গড়ে ওঠে। আর এ দৃষ্টিকোণের সাথে তার কর্মানুবন্ধের সন্ধি ঘটে। নিছক আদর্শ এই সন্ধি ঘটাতে পারে না। বরং ওই প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে আদর্শের উচ্চারণ ও গুরুত্বায়ন বিকৃত ধারণা রাজনীতির অবসর সৃষ্টি করতে পারে যা উল্টো ফলের কার্যকারণ সৃষ্টি করতে পারে। ধারণা রাজনীতি সব সময় ভাসমানতা-সম্ভাব্য। এটি ভাববাদীতার দিকে গণচেতনাকে নিয়ে যেতে থাকে এবং শেষাবধি আবেগকে উত্তঙ্গ করে উত্তেজনাকর ভাসমানতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এতে সফলতা পায় ব্যক্তি উদ্দেশ্যগত বা গোষ্ঠী উদ্দেশ্যগত রাজনীতি আর ঠিক সেই অনুপাতে বিপর্যস্ত হয় গণ স্বার্থ ও গণ রাজনীতি তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতি। এতে করে আর একটি দুর্ঘটনা যা ঘটে তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল নিরুপক নৈর্ব্যক্তিকতা নির্মূল হয় বা হয়ে যেতে থাকে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ’আমরা’ সত্ত্বাটির সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিকতার একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। নৈর্ব্যক্তিকতা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতি হয় না।
যা হোক, ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সক্রিয়তার ও সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অন্তর্গত বা অভ্যন্তরগত সচলতা। যে কোন সংগঠনের অন্তর্গত সচলতা নির্ভরশীলতার পদসোপান ধারার গতিশীলতার ওপর। সংগঠনের শেকড় স্তর ও শৃঙ্গ স্তর উন্মুক্ত না থাকলে সে সংগঠনের অগ্রগতি বিকৃত অথবা বন্ধ্যায়িত হয়ে যায়। ফলে সংগঠন চরিতার্থ হয় না। ওই সংগঠন যুক্তিযুক্ত গন্তব্যে বা উদ্দেশ্যে পৌঁছুতে পারে না। কর্মীর কর্মানুবন্ধ সচলতা পায় পদসোপানের খোলা হাওয়ায়। পদসোপানের খোলা হাওয়া স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি করে। এ কথা সব সময় মনে রাখা দরকার সংগঠন বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কোনো ভাববাদীতার বিষয় নয়। এটি বস্তু ঘনিষ্ঠ আদর্শবাদের বিষয়। কর্মীদের জীবনের সাংগঠনিক উত্তরণমুখিতা নিশ্চিত না হলে তাদের উদ্দীপনা প্রাণ পায় না। তাই সংগঠনকে সর্বদা পরিবর্তমান থাকতে হয় প্রতিটি কর্মীর অবস্থানের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি স্বতত বিচিত্র মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতগত সমন্বয়ের ক্ষেত্রে।
প্রতিটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে নেতৃত্বের স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ পূরণের সুযোগ রাজনৈতিক দলের পদসোপান ধারায় না থাকলে তা কর্মীর মানসিকতাকে বিভ্রান্ত অথবা বিকৃত করে ফেলে। এ প্রক্রিয়ায় কর্মীর মনে আদর্শ ও ব্যক্তি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তাকে ব্যক্তি স্বার্থমুখী করে তুলতে থাকে যা শেষাবধি তার প্রসঙ্গে রাজনীতির বাণিজ্যিকরণের প্রবণতা অবধারিত করে। অন্যটি হচ্ছে আপোষ। অগতিশীল পদসোপান ধারার প্রেক্ষিতে কর্মীরা ক্রমশ আপোষমুখী হতে থাকে। একই সঙ্গে আত্মকেন্দ্রিক ও আপোষমুখী হতে থাকে। এতে করে একদিকে যেমন কমতে থাকে তার সামাজিক দায়বোধ, অন্যদিকে বেড়ে উঠতে থাকে আপোষধর্মী তোষণ চর্চা। এটি ক্রমশ পুরো পরিবেশে বিস্তৃতি পেতে থাকে। ফলে প্রতিযোগিতাধর্মী তোষণ চর্চা পুরো পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে। এ রকম পরিবেশে কর্মীরা আতাœবিশ্বাসহীন ও ব্যক্তিত্বহীন হয়ে যায়। স্বাধীনচেতা, সামাজিক দায়বদ্ধ ও আত্মবিশ্বাসীর কর্মীর বিকাশ বন্ধ্যায়িত হয়। মনে রাখা দরকার রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই রাজনৈতিক দলের প্রাণ ও ফলশ্রুতি এবং রাজনীতির গুণগত বিকাশের আপেক্ষিক নিরুপক। তাদের গড়ে তোলাই রাজনীতিকে গড়ে তোলা।
এরপর আসে রাজনৈতিক কর্মীদের পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়। আগেই বলেছি রাজনীতি নিছক আদর্শ বা বস্তু বিষয় নয়। এটি বস্তু প্রাসঙ্গিক আদর্শের বিষয়। সেই জন্য রাজনৈতিক কর্মানুবন্ধের জন্য পুরস্খারায়ণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি রাজনৈতিক শৃঙ্খলার জন্য জরুরি। কোন রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসে তার নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষীয়তায় আসে। তাদের নেতারা সরকার গঠন করে। মন্ত্রী প্রধান মন্ত্রী হন। এটি তাদের রাজনৈতিক প্রাপ্তির একাংশ। এটি এক অর্থে তাদের রাজনৈতিক বস্তু পুরস্কার। একইভাবে রাজনৈতিক কর্মীদের পুরস্কার প্রাপ্তি যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। কর্মীরা যেন অসহায় ও আক্রমনাত্মকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার উদ্বৃত্তা উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি না করে তার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর জন্য সুনির্দিষ্ট শিল্প প্রকল্প ও বাণিজ্য প্রকল্প রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ব্যবস্থিত হলে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে ওই রাজনৈতিক দলের কর্মীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবৈধ দখল নিয়ে প্রাণক্ষয়ী হয় না। একই সঙ্গে সমাজবিরোধী চাঁদাবাজির প্রক্রিয়াও নির্মূল হয়। কর্মীরা গঠনমূলক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে সক্রিয় থাকে। গণতন্ত্র গণবিরোধী প্রক্রিয়ার হাতে নিগৃহীত হয় না।
য় লেখক : প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনৈতিক কর্মী
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ