বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ
বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেহাল দশায় রূপ নিয়েছে, অতীতে এমন অবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে তার কিছু নমুনা আমরা দেখলাম। ইউপি নির্বাচনের চারটি পর্ব এখনো বাকি আছে। আমরা ভেবেছিলাম তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনটা জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে। কিন্তু সরকার তৃণমূল পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনটাকে রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে রাখতে পারেনি বলেই এত হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সরকারি দলের লোকজন ব্যালটবাক্স ছিনতাই করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দলীয় ব্যানারে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা বর্তমান শাসক দলের আমলে স্বচক্ষে আমরা দেখলাম। ইউপি নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকে লাশ পড়তে থাকে। এই দৃশ্য দেখেও নির্বাচন কমিশন এবং শাসক দল বলেছে- এরকম ভালো নির্বাচন বিএনপির আমলে হয়নি। আমরাই পুনরায় গণতন্ত্রের উদাহরণ সৃষ্টি করলাম। শাসক দল এও বলেছেÑ এই নির্বাচন শতকরা ৯৯ দশমিক শূন্য ৭ ভাগ অর্থাৎ শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে! সম্প্রতি টকশো মধ্যরাতে শাসক দলের সমর্থক একজন ব্যক্তি একই কথা বলেছেন। ভাবলাম, ছোট একটি দেশে স্থানীয় একটি নির্বাচনে এতগুলো প্রাণ চলে গেল, আহত হলো কয়েক শতাধিক, তারপরও এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অভিহিত করার অর্থ হলোÑজাতি তো বেকুব, তাদেরকে এরচেয়ে বেশি ছবক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে কখনো গণতন্ত্র কাঠামো শক্তিশালী ছিল না। এখন একেবারে পঙ্গু বানিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোট না থাকলেও এদেশে গণতন্ত্র পাস করে।
কিন্তু এ জাতি যে বোকা নয়। তা ব্রিটিশ টের পেয়েছে। পাকিস্তান সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছে। সামরিক সরকার এরশাদও তা অনুধাবন করতে পেরেছে। ’৭৪ সালের একদলীয় বাকশাল সরকারও তা টের পেয়েছে। গণতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য এদেশের মানুষ নিজের বুকের রক্ত রাজপথে বহুবার ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেছেÑআমরা অধিকার সচেতন জাতি। ’৫২, ’৫৪, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০-এর গণআন্দোলনে সেটাই প্রমাণ করেছে বীর বাঙালি জাতি। সঠিক সময়ে গণতন্ত্র তার স্ব-অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে জাতি পুনরায় জেগে উঠবে। এ কথা ইতিহাসের পাতা উল্টালেও আমরা জানতে পারব। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের কাছে বিষয়টি তামাশা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কঠিন আন্দোলন যখন মসনদের দরজায় কড়া নারবে, তখন বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল হয়। অনেকেই বলে থাকেনÑদেশে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু সত্যিকার ভোট নেই। আছে জালভোট। জাল ও সিল মেরে ভোট দিয়ে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যায় না, যেটা আমরা ব্যাপকভাবে দেখেছি স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে।
কবি জীবনান্দ দাশও বলে গিয়েছিলেন, এত হিংসা দিয়ে গণতন্ত্র চলে না। আল্লাহ তার পবিত্র কিতাব আল কোরআনে বলেছেন, আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের খুব কঠিনভাবে পাকড়াও করি। আমরা সেটা দেখেও শিখি না বলেই বারবার একই ভোগান্তিতে পতিত হই এবং দেশকেও নরকের পথে নিয়ে যাই। গণতন্ত্রকে তার পথে হাঁটতে না দিলে এবং বাধা প্রয়োগ করলে, প্রকৃতির মতো সেও বিদ্রোহ ঘোষণা করে সব কিছুই ল-ভ- করে দেয়। আমাদের নিকট অতীতে এ ট্র্যাজেডি আমরা স্বচক্ষে অবলোকন করেছি। নূর হোসেন, দেলোয়ার, ময়েজউদ্দিন এদের রক্ত বৃথা যায়নি। এখন যারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে হতাহত হচ্ছেন তাদের রক্তও বৃথা যাবে না। ইতিহাস কিন্তু এ কথাই বলে। গণতন্ত্রের পাঠশালায় এখন যারা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন তারাও বলছেন, গণতন্ত্রের নামে দেশে কী শেখানো হচ্ছে। এত দেখছি মানুষ খুন করার গণতন্ত্র। সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশে মানুষ কেন খুন হবে। পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষায় এরকম গণহারে লাশ পড়তে আমরা দেখি না। মায়ানমার এবং ভারতের সম্প্রতি নির্বাচনেও এত সহিংস ঘটনা এবং খুনাখুনির তা-ব আমরা দেখিনি। এসব দেশের নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি স্বাধীন। সেখানে সরকার তার কথায় চলে। আমাদের দেশে এরকম অবস্থা না থাকার কারণে গণতন্ত্র বারবারই হোঁচট খাচ্ছে। সোজা হয়ে মেরুদ- উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের ৭ বছরের শাসনামলে কয়েক হাজার মানুষ খুন হয়েছে। এদের কয়জনে সরকারের আনুকূল্য পেয়েছে। সরকারি দল হলে তাদের জন্য দরদ উপচে পড়বে। আর বিরোধী দল হলে সে ক্ষেত্রে মামলা করারও সুযোগ থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি সাইবার স্পেশালিস্ট তানভীর ৭ দিন নিখোঁজ থাকার পর বাড়ি ফিরলেও কথা বলছে না। তার পরিবার হতাশাগ্রস্ত। তাদের কাছে গিয়ে একটু সান্তনার বাণী শোনানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তাহলে কি মানুষের মধ্যে শ্রেণী ভাগ আছে। খুনকেও বিভক্ত বঞ্চনার মধ্যে রেখে আমরা বড় ধরনের অনৈতিক কাজটিই করছি। একটি দেশের সকল মানুষের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। একজন প্রধানমন্ত্রী সে তো ১৬ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী। তার অন্তরদৃষ্টি সবার জন্য সমান হবে। এটাই রাষ্ট্রীয়নীতি দর্শন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের সংবিধানেও এ কথাই বলা আছে। খুনের ব্যাখ্যা আজ যেভাবে দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন মানুষ খুন হবে, গুম হবেÑবিচার পাবে না, মামলা করতে, এমনকি থানায় জিডি করতেও তাকে বাধা দেয়া হবেÑ ’৭১-এর চেতনার দেশে তো এমন হওয়ার কথা নয়। একজন নারী রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হবেÑ এসব ব্যাপারে সরকারের শক্ত কোনো ভূমিকা থাকবে না, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখলাম। মঠবাড়িয়ায় (পিরোজপুর) মাতম, ক্ষোভ, জনতার মিছিলে পুলিশের গুলির ঘটনায় ছিল বাড়াবাড়ি। নির্বাচন নিয়ে এমন সহিংসতা আমার ৬০ বছর বয়সে আর কখনো দেখিনি। এই উক্তিটি ছিল মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র রফিউদ্দিন আহমেদের। মাটির ঘর, দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। সেই ঘরের সামনে মাটি চাপড়ে মাতম করছেন জীর্ণশীর্ণ গৃহবধূ সীমা আক্তার। বারবার বলছেন, ‘আপনারা মোর স্বামীরে আইন্না দ্যান। মুই ওহন দুইডা মাছুম পোলারে লইয়া কেমনে বাঁচুম।’ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে দুই শিশু সন্তান সিফাত ও রিফাত। মঠবাড়িয়ায় বিজিবির গুলিতে নিহত দিনমজুর বেলাল মোল্লার বাড়ির সবাই কাঁদছে। কাঁদছেন এলাকার মানুষজন।
সব সময়ই পেট্রোল বোমায় নিহত মানুষগুলোর জন্য দায়ী খালেদা জিয়াÑ এ কথা কয়েক শতবার বলেছেন সরকারের উচ্চমহলের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা। এই হত্যাকা-কে আমরাও ঘৃণা করি। কিন্তু এর পাশাপাশি সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত মানুষের সংখ্যা বিগত ৭ বছরে কত হবেÑ সেই হিসাবটাও সরকারকে করতে হবে। তাদের বাঁচার অধিকারকে কেড়ে নিয়ে একেবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে শাসক দল যে অন্যায় করেছে, শুধু ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তরিত করার জন্য সেটাও চরম অমানবিক এবং ক্ষমার অযোগ্য বলে গোটা দেশবাসী মনে করে। খুন যেই করুক না কেন সেটা কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। নাগরিকের বাঁচার অধিকারের ওপর যারা হস্তক্ষেপ করবে, সে যত বড় উচ্চপদে বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোক না কেন, সভ্য জাতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে চাইলে সব ধরনের খুন ও গুমের বিচার তৎক্ষণিকভাবে করা একান্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। মেকি কান্না দিয়ে মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রকাশ করাও ধোঁকাবাজি এবং তামাশার সমতুল্য বলে জনগণ মনে করে। জনগণের ভালোবাসার নামে যে মেকি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে তা জাতির সাথে প্রতারণার শামিল। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছোট বই একজন লেখক আমাকে উপহার দিল। লেখকের বয়স ৩২ এর বেশি হবে না। তার বাচনভঙ্গি দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। এ দেশে ভালো মানুষ এখনো আছে। বইটি পড়ে লেখকের কাছে নিজে গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম এবং বললামÑতোমার এই বইটিতে আমি প্রকৃত শেখ মুজিবকে খুঁজে পেলাম। এ জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ছেলেটি বলল, আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। সে বলল, আংকেল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বদানকারী কতিপয় মানুষ বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে না রাখার চক্রান্তে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারা যেভাবে বাড়াবাড়ি করছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর ইমেজের ধস নামিয়ে দিয়েছে। জাতীয় নেতাদের সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান শাসক দল সেটা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনলাম। ভাবলাম, ৩০ ঊর্ধ্ব যুবকরাই পারে এদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করতে। আমরা বুড়োরা শেষ বয়সে এসেও জমিজমা ও অর্থ সম্পদের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ছেলে সন্তানরা বাবা-মার কাছ থেকেই শেখে। আজ সমাজে যে নৈতিক ধস নেমেছে এ জন্য আমাদের মতো অভিভাবকরাই বেশি দায়ী। আমার সন্তান যদি দেখে স্বল্প বেতনের চাকরি করে কীভাবে আমি এত বড় আলিশান বাড়ি নির্মাণ করলাম, কীভাবে পাজেরো গাড়ি কিনলাম। ছেলেটি তখন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগে। এক সময়ে বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। অবশেষে অন্ধকার পথে পা বাড়ায়। যুব সমাজের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাটা একশ্রেণীর বাবা-মা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এসব ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে যেমন কোনো আইন করা হয়নি, তেমনি সমাজের কর্তারাও নীরব। বর্তমান সমাজে যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তা পিতৃতুল্য ব্যক্তিদের কারণেই ঘটেছে।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।