বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
দেশে চলছে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৬ ধাপে। এরই মধ্যে ২ ধাপ শেষ হয়েছে। এই ২ ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এই সহিংসতায় ৪২ জন প্রাণ হারিয়েছেন যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। তাছাড়া নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে নজিরবিহীনভাবে। সবচেয়ে দুঃখজনক হল প্রাণহানির ঘটনা, যা সবাইকে হতবাক করেছে। এসব প্রাণহানির বেশিরভাগ ঘটনাই সরকারদলীয় প্রার্থী ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে ঘটছে এবং সামনে আরও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রাজনীতিকরণের কারণে এমনটি ঘটছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, ব্যাপক হতাহতের ঘটনার কারণে রাজনীতির তৃণমূলে যে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে তা সহজেই দূর হবে না। এর রেশ রয়ে যাবে বহুদিন। ফলে ক্ষমতাসীন দলসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলই ভেতরে ভেতরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবার, সমাজ ও সামাজিক ভারসাম্যও। কারণ নির্বাচনটি দলীয় ভিত্তিতে হওয়ায়, একই পরিবারের মধ্যেও বিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে, হচ্ছে মারামারিও। তাছাড়া হচ্ছে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য ও টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি। এক কথায় বললে, দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কোনো সুফল তো বয়ে আনছেই না বরং এর কুফল ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।
তবে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ব্যাপক জয়জয়কারের ফলে তারা হয়তো প্রাথমিক আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন। কিন্তু আলটিমেটলি এই ব্যাপক জয় তাদের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো ফল বয়ে আনবে না। উল্টো ভবিষ্যতে তাদের এর মাশুল দিতে হতে পারে। কারণ সরকার বদল হলে, চেয়ারম্যানরাও দল বদলায়।
এই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরাও লড়ছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। কিন্তু শাসক দলের প্রার্থীদের দাপটের কারণে বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে দাঁড়াতেই পারছেন না। চতুর্মুখী প্রতিকূল অবস্থা তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই চতুর্মুখী প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনা সত্যিই তাদের জন্য কষ্টদায়ক। তারপরও তারা সংখ্যায় কম হলেও জয়ী হচ্ছেন, বিজয় ছিনিয়ে আনছেন। তবে শাসক দলের জোরজবরধস্তির কারণে, তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি হচ্ছে; তারা রাজনীতির একটা ফোকাসে থাকছেন, এটা তারা অন্য জায়গায় হয়তো কাজে লাগাতে পারবেন। মোট কথা হল বিএনপির প্রার্থী কম জয়ী হলেও- এই নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক প্রাপ্তি আছে। তবে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। ভোটারের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। এতে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা অবশ্যই আছে। মানুষের সাথে তারা পরিচিত হবেন, মানুষ নেতাদের কাছে পাবে; সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারবে, সর্বোপরি তাদের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উৎসাহ পাবে- পাবে ভরসা। তাতে নেতাকর্মীদের মাঝে দীর্ঘদিনের একটা ফারাক দূরীভূত হবে যা তৈরি হয়েছে বিএনপি অতীতে নির্বাচন বর্জন করায়।
নির্বাচনের আরও ৪ ধাপ বাকি রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা থেমে নেই। মনোনয়ন নিয়ে চলছে সহিংসতা। মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সামনের নির্বাচনগুলোয় আরও ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটার সমূহ আশংকা রয়েছে। তাতে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে নির্বাচনী ব্যবস্থা। উৎসবের পরিবর্তে ভোট নামক বিষয়টি হয়ে পড়তে পারে অপ্রাসঙ্গিক। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে। এমনটি হোক আমরা চাই না। আমরা নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা দেখতে চাই। নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত ক্ষমতা নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে সহিংসতা ও জালিয়াতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন কী সেটি করবেন? অতীতে আমরা দেখিনি। যার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাটিও আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করাও অবান্তর। কেননা সারাদেশে হাজার হাজার ভোট কেন্দ্রের প্রায় ৯ কোটি ভোটারের ভোট নিশ্চিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। আর দলীয় সরকারের অধীনে এসব প্রশাসনযন্ত্র কোনোভাবেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না।
স্থানীয় সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় এটি এখন অনিবার্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা এটিকে মৃত বলেও আখ্যায়িত করছেন যা রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। স্থানীয় সরকার যদি দুর্বল হয় তাহলে রাষ্ট্র কাঠামোও দুর্বল হয়ে যাবে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে। কাজেই আমরা চাই দলীয় বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসুক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। তাতে রাষ্ট্রে যেমন মঙ্গল, মঙ্গল হবে সবারও।
এবার আসা যাক রাজনীতিতে। আসলে রাজনীতিতে কোনো সুখবর নেই বরং বিরাজ করছে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। একটার পর একটা লোমহর্ষক হত্যাকা- ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে রাজনীতিতে। তাতে মানুষ শুধু শঙ্কিতই হচ্ছে না, রীতিমত হতবাকও হচ্ছে। আর হবেই বা না কেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সুরক্ষিত জায়গা থেকে যদি জনগণের আমানত চুরি হয়ে যায় তাহলে মানুষের আস্থাটা আর থাকে কোথায়? রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে কোনোভাবেই দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। রাজনৈতিক সঙ্কট দূর করতে হলে, সামনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারটি আগে ফয়সালা হতে হবে, কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বিরোধী জোট মেনে নেবে না, এটি এক প্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় প-িত জওহরলাল নেহেরুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল- ভারত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী? উত্তরে নেহেরু বলেছিলেন- বিশ্ব অর্থনীতি এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ইংল্যান্ড, এটা অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন হয়ে ভারতের অনুকূলে আসার সম্ভাবনা আছে; বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয়, প-িত নেহেরুর কথাই সত্য হতে যাচ্ছে। এত দূরের জিনিস দেখার কারণেই জওহরলাল নেহেরুকে প-িত বলা হতো। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্ন আজ রাজনীতিকদের কাছে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের কাছে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের কাছে আছে বলে মনে হয় না।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে দেশে নেমে আসবে বিপর্যয়। তখন বাইরের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে; এমনটি হোক আমরা তা চাই না। দেশকে রক্ষা করতে হবে বিপর্যয় থেকে। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অপরিহার্য। সেই সংলাপ শুরু করতে হবে এখনই। তার জন্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে হবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে। বিএনপি সংলাপের জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। দলটির প্রধান বারবার সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাহলে কি সরকার সংলাপ চায় না? সরকার দেশে অস্তিরতা চায়? চায় উগ্র রাজনীতি প্রসার? এমনটি হলে তা চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাসীন দলের জন্যই হবে বুমেরাং।
উত্তরাধিকার-লব্ধ বস্তু ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব। এ এমন এক বস্তু যা সাহস এবং স্থির সংকল্প নিয়ে চলার জন্য তৈরি করে নেয় এবং বৃহৎ ছবি অবলোকন করার সামর্থ্য দান করে। ন্যায় ও সত্যের পথ অনুসরণ করতে জনগণকে উৎসাহ প্রদান এবং পরিবর্তন আনয়নে অনুঘটক হওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে সত্যিকারের নেতৃত্ব। মানুষ যে বিদ্যমান অবস্থার একটা পরিবর্তন চায় তা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেই অনুমান করা যায়। কাজেই এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই, এখন নেতৃত্ব প্রকাশের সময়।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধণবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।