দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দাস-দাসীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। তারা তোমাদেরই ভাই। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খেতে দেবে, তোমরা যা পরবে, তাদেরকেই তা পরতে দেবে। তাদের পর কোন প্রকার নির্যাতন চালাবে না, তাদের মনে আঘাত দিবে না।’ শুধু তাই নয়, মহানবী (সা.) স্বীয় দাস যায়েদকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের প্রতিপাল্য হিসেবে গ্রহণ করে দাসদেরকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। জাতিসংঘের ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং-এর ৪নং অনুচ্ছেদে এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ড়ভ পরারষ ধহফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ জরমযঃং (ওঈঈচজ)-এর ৮নং অনুচ্ছেদেও দাসত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বংশ কৌলিন্য ও বর্ণবাদ বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোন অনারব ব্যক্তির ওপর কোন আরববাসীর এবং কোন কৃষ্ণাঙ্গের উপর কোন স্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র মাপকাঠি হল তাকওয়া।’ উক্ত বক্তব্যে মহানবী (সা.) বংশ কৌলিন্য বর্ণবাদ প্রথাকে স্থান দেননি।
১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর ঞযব উবপষধৎধঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষবসরহধঃরড়হ ড়ভ ধষষ ভড়ৎসং ড়ভ জধপরধষ উরংপৎরসরহধঃরড়হ-এর অনুচ্ছেদ-এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য হল মানব মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ এবং তা টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈযধৎঃবৎ ঃযব ঁহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং-এর পরিপন্থী এবং জাতিসমূহের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের পথে বাধা স্বরূপ। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে মানবাধিকার : বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং- এর উত্তরাধিকার লালন করছে। বিশ শতকের প্রথম থেকেই মানব সভ্যতা অত্যন্ত অসহায়ভাবে দুটো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। মানবাধিকারের ললাটে কালিমা লেপন করে এতে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশু বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। অতঃপর ভার্সাই চুক্তি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংস্তূপের উপর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একনায়কত্ব ও ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়াবহতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সৃষ্টিকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বসমাজের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়। ফলে নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রতি আন্তর্জাতিক চেতনা সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকো শহরে জাতিসংঘের সনদ প্রণয়নকালে এর স্থপতিগণ মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও মানুষের মর্যাদার প্রতি তাদের আস্থা ব্যক্ত করেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় ৩০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত যে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় তার ৩ থেকে ২১ পর্যন্ত অনুচ্ছেদসমূহে ১৯টি নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার স্থান পেয়েছে এবং এর ২২ থেকে ২৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদসমূহে ৬টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। মানবাধিকারের এই সর্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হওয়ার পর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধানে উক্ত ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মানবাধিকারসমূহ মর্যাদা সহকারে স্থান পেয়েছে। জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জন্য মানবাধিকারের এই সনদ অনুসরণ বাধ্যতামূলক করেনি। কিন্তু এটি অনুমোদন লাভ করার পর সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এতে স্বেচ্ছামূলক করেনি। কিন্তু এটি অনুমোদন লাভ করার পর সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এতে স্বেচ্ছামূলক স্বাক্ষর প্রদানপূর্বক নিজ নিজ দেশে তা বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। কোন দেশ এই সনদ কতটুকু অনুসরণ করছে তা পর্যবেক্ষণও এ সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রদানের জন্য জাতিসংঘ একটি স্থায়ী মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কমিশনের শাখা রয়েছে যার মাধ্যমে জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার বিষয়ক যাবতীয় রিপোর্ট অবহিত হয়।
মাবনাধিকার সংরক্ষণের এক মহান উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বর্তমানে বিশ্বের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ এর মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় বলে মনে করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালী ও চীনকে ‘ভেটো’ প্রয়োগের নিরংকুশ ক্ষমতা প্রদান করে নিজেই মানবাধিকার লংঘনের নজির স্থাপন করেছে।
পৃথিবীর পরাশক্তিসমূহ বিশেষত আমেরিকা ও ব্রিটেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার করুণ শিকারে পরিণত করেছে। অথচ এরাই জাতিসংঘ ও মানবাধিকার কমিশন নিয়ন্ত্রণ করে। আর পুতুলসম জাতিসংঘেরও এমন কোন সংস্থা বা মেকানিজম নেই যা দেশে দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে কিংবা আইন দ্বারা তা মানতে বাধ্য করতে পারে। ফলে জাতিসংঘের ছাত্রছায়ায়, কোন কোন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষত আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি দুর্বল দেশসমূহে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার সনদকে পদতলে পিষ্ট করে আফগাস্তিান ও ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনীর নগ্ন আগ্রাসন, গণহত্যা, স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা হরণ, সিরিয়া, ইরান ও সৌদি আরবের প্রতি মার্কিন হুমকি, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্ব বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসান ও দমন-পীড়ন, আলবেনিয়ায় গণহত্যা, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীর মিন্দানাওয়ে মুসলিম নিধন, মিয়ানমারে মুসলিমদের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও কোন কোন দেশে ঘন ঘন সামরিক শাসন জারি, আমেরিকায় মুসলিম ও নিগ্রোদের প্রতি বৈরী আচরণ, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে নাগরিক অধিকার হরণ, দেশে দেশে বোমাতংক এবং সামাজিক নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতি আজ জাতিসংঘের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও আজ বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। ফলে মনে হয়, গুটিকয়েক রাষ্ট্রকে ভেটো প্রয়োগ ক্ষমতা প্রদান করে জাতিসংঘ এসব রাষ্ট্রকে তার সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ হতে ফায়দা লোটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে এই ব্যবস্থা বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, আদর্শিক অসচেতনতা, সামাজিক পশ্চাদপদতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রসরতা প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের মাঝে ঐক্য ও সংহতির অভাব আজ সুস্পষ্ট। ফলে তারা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ হতে পুরোপুরি ফায়দা উঠাতে পারছে না। এমতাবস্থায় উপরোক্ত দুর্বলতাসমূহ কাটিয়ে উঠে মুসলিম উম্মাহ যদি কেবল মহান আল্লাহ প্রদত্ত এবং মহানবী (সা.) প্রদর্শিত শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে এবং মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনার জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্রের মডেলে মানবাধিকারের শিক্ষা ও নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগে গ্রহণ করে তা হলে বিশ্ববাসীকে মানবাধিকারের গ্যারান্টি দিতে সক্ষম হবে।
সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার এই উদারণ রাসূল (সা.)-এর জীবনের শুরু থেকেই আজীবন নানাভাবে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তিনি গোটা আরব জাহানের নেতা হয়ে উঠলেন তখন তিনি কি সমাজজীবনে, কি পারিবারিক জীবনে, কি রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিক জীবনে, কি বিশ্ব নাগরিক হিসাবে- সর্বক্ষেত্রে মানুষের মূল্য-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের যে সর্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল, অভূতপূর্ব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-দর্শনের কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মুহাম্মদ (সা.) মানুষের জীবনের অধিকার ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করা এবং মানুষকে হত্যা করা। মহানবী (সা.) আলো বলেছেনÑ ‘কোন জিম্মিকে (মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিককে) হত্যাকারী জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুগন্ধ অনেক দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! নিশ্চয় তোমাদের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত পবিত্র’। মহানবী (সা.) আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং আত্মহত্যাকারী তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেয়ার শাস্তি হিসাবে আত্মহত্যার অনুরূপ পন্থায় দোযখে শাস্তি ভোগ করবে বলে হুঁশিয়ার বার্তা দিয়েছেন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।