Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তনু হত্যার বিচার চায় মানুষ

প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুবিখ্যাত ‘নারী’ কবিতাটির কথা অনেকেরই জানা। এ কবিতার দু’টি পঙ্ক্তি এখানে স¥রণ করা যেতে পারে :
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
মহান কবির মহৎ বাণী। এ পঙ্ক্তি দু’টির মধ্যদিয়ে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নারীদের সামগ্রিক অবদানের নির্যাসটুকু কবি প্রকাশ করেছেন। তা, বিশ্বের সব মহান সৃষ্টি ও কল্যাণকর কাজের সঙ্গে যারা পুরুষের সাথে সমান ভূমিকা পালন করেন সেই তারা যে আগের সময়েও ভালো ছিলেন সে কথা যেমন অতীত ইতিহাস বলে না, তেমনি এ কালেও যে তারা ভালো আছেন সে কথাও বলা যায় না। একজন নারী যে কত অসহায়, কতটা দুর্বল, তার সম্ভ্রম কত ঠুনকো, তার জীবন যে কত মূল্যহীন, যুগে যুগে কালে কালে তার অসংখ্য নজির রয়েছে। সম্প্রতি তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের বরাতে সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে সে ঘৃণ্য ঘটনার বিবরণ। প্রায় সারা দেশই আজ ফুঁসে উঠেছে তার প্রতিবাদে। সবাই এ ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের গ্রেফতার ও বিচার চাইছে। বরাবর যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অর্থাৎ আরো অনেক ঘটনার মতো এ ঘটনাটিও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, তবে তা সফল হয়নি। সে অপচেষ্টা যে নিঃশেষিত হয়েছে তা বলা যায় না।
বাবা-মার কাছে সব সন্তানই সমান প্রিয়। তাই আরো দু’ সন্তান থাকার পরও একমাত্র কন্যা তনুর অকাল মৃত্যু বাবা-মাকে শোকে মুহ্যমান করেছে। তারা জানেন না কেন ‘ফুল ফুটিয়ে ভোর বেলাতে গান গেয়ে’ তাদের প্রিয় মেয়েটি ‘নীরব হল কোন নিষাদের বাণ খেয়ে।’ তারা তনু হত্যার বিচার চান। তাদের সাথে বিচার চান দেশের অগণিত শিক্ষার্থী ও বাবা-মাসহ সাধারণ মানুষ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন স্মরণকালের সর্বোচ্চ উন্নতি ও সাফল্যের বিপুল প্রচারণার জোয়ারে প্লাবিত তারই আরেকদিকে বয়ে চলেছে নির্মমতা ও নৃশংসতার ফোঁড় দেয় অপরাধের কালো জোয়ার যার শিকার হয়েছে তনু। তার আলোকিত জীবনে মৃত্যুর অন্ধকার নামিয়ে দিয়েছে মানুষ নামের পশুর দল। তার সম্ভাবনাময় জীবন আজ অতীতের বিষয়, পরিবারের কাছে সে এখন স্মৃতি। বাবা-মার জন্য শুধু আহাজারি অবশিষ্ট রেখে গেছে সে।
সোহাগী জাহান তনু ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ¯œাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী। নাট্যকর্মীও ছিল সে। তার বাবা ইয়ার হোসেন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একজন অফিস সহকারী। সেনানিবাসের মধ্যে বাসায় থাকেন তিনি। তনু তাদের বাসার ২শ’ গজের মধ্যে দু’জন সেনা সদস্যের বাসায় দু’টি টিউশনি করত। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যেত ও টিউশনি সেরে সাড়ে ৮টার মধ্যে ফিরে আসত। ২০ মার্চও যথারীতি বেরিয়ে যায় সে। কিন্তু সাড়ে ৮টার মধ্যে ফিরে না আসায় উদ্বিগ্ন মা তনুর ছোট ভাইকে নিয়ে তনুকে খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু তাকে পাননি। তনুর বাবা রাতে সোয়া ১০টায় অফিস থেকে এলে তাকে বিষয়টি জানালে তিনি সাথে সাথে খুঁজতে বের হন। প্রথমে তিনি তনুর একটি জুতা দেখতে পান। তারপর একটু দূরে মেয়ের লাশ আবিষ্কার করেন।
তারপর একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রথম দফা ময়না তদন্তের পর তনুর লাশ মুরাদপুর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যার মোটিভ উদ্ঘাটনে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও পুনঃ ময়নাতদন্তের জন্য আদালত কবর থেকে তার লাশ উত্তোলনের অনুমতি দেয়। জানা যায়, প্রথম সুরত হাল রিপোর্টে তার নাকের নিচে ও মাথার পিছনে আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ৩০ মার্চ তার লাশ উত্তোলনের পর এগুলো দেখা যায়। উত্তোলিত লাশ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে নিয়ে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করে রাতে গ্রামে একই কবরে তাকে আবার দাফন করা হয়। তখন বলা হয়, ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেতে ১০ দিন লাগবে। ইতোমধ্যে তনু হত্যা মামলাটি পুলিশ থেকে ডিবি ও সর্বশেষ ডিবির কাছ থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২৬ মার্চ বলেন, তনুর হত্যা ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাও তদন্ত করছে। এ ঘটনার অবশ্যই বিচার হবে। এ দিনেই এক অনুষ্ঠান শেষে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, র‌্যাব ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। র‌্যাব এ ধরনের অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদন্ত করেছে। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, কী কারণে ঘটনা ঘটেছে তার রহস্য উন্মোচন করছে। তনুর ব্যাপারেও তেমন কিছুই হবে। আশা করছি শিগগিরই খুনিরা গ্রেফতার হবে। উল্লেখ্য, নিহত তনুর স্বজনদের র‌্যাব-১১ জিজ্ঞাসাবাদ করে। এদিকে তনুর মা’র কাছ থেকে র‌্যাব কাগজে টিপসই নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে র‌্যাব তা অস্বীকার করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও ডিজিএফআইও এ ঘটনার তদন্ত করছে। আইএসপিআরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনী এ হত্যাকা-ের তদন্তে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে। কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রতিটি সৈনিক তনু হত্যায় ব্যথিত বলে বলা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বসাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তনুর বাবা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক ৩১ মার্চ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি তনুর মা-বাবার সাথেও সাক্ষাৎ করেন ও তনু হত্যার ন্যায় বিচারের আশ্বাস দেন।
এদিকে তনুর প্রথম ময়না তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এতে ময়না তদন্তকারী প্রথম ডাক্তার বলেছেন, যে তনুকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, তাছাড়া তার কারণ সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি। এ রিপোর্টের ব্যাপারে জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ফেসবুকে অসংখ্য ব্যক্তি অসন্তোষ প্রকাশসহ ক্রুদ্ধ মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন। এখন দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছেন তদন্তকারীরা। এ লেখা প্রকাশ হতে হতে হয়ত সে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। তা পাওয়া গেলে এবং তার কাপড়ের ডিএনএ পরীক্ষার ফল থেকে সম্ভাব্য হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা ও তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার কাজ সহজ হতে পারে। এখন তারই অপেক্ষা।
এদিকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের (তনু যার সদস্য ছিল) সভাপতি রাশেদুল ইসলাম জীবন জানান, আনন্দ ভ্রমণ শেষে ১৮ মার্চ রাতে তনু আমাদের সঙ্গে শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরেছিল। ২০ মার্চ রাতে সেনানিবাসের ভেতরে তনু খুন হয়েছে। এ সুরক্ষিত এলাকায় বাইরের কেউ যাওয়ার সুযোগ নেই। খুনি যেই হোক আমরা তার সাজা চাই। তনুর বাবা বলেছেন, তার মেয়ের কোনো শত্রু ছিল না এবং কে বা কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে তা তারা জানেন না। তবে সব কিছু মিলিয়ে সাধারণভাবে সন্দেহের তীর সেনানিবাস এলাকায় বসবাসকারীদের উপরেই গিয়ে পড়ে। তনুর দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা হয়ত জানা যেতে পারে। এদিকে তনুর লাশ সেনানিবাস এলাকায় পাওয়া যাওয়ায় হত্যাকারীরা ঘটনাস্থলের আশপাশেরই লোক হতে পারে বলে জোর ধারণা করছেন সিআইডির তদন্তকারীরা।
তনু হত্যার ঘটনাটি প্রথম থেকেই স্বাভাবিক গতি লাভ করতে পারেনি বলে দেখা গেছে। আর সে কারণেই সৃষ্টি হয় আন্দোলন। ইতোমধ্যে দেশের নানা স্থানে মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে। ২৫ এপ্রিল সারাদেশে অর্ধদিবস ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। এদিকে তনুর সাথে পরিচয় ছিল ও সেনানিবাসে তাদের প্রতিবেশী এক সেনা কর্মকর্তার ছেলেকে সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার বাইরে ৩ সেনাসদস্যসহ আরো ৫ জনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা। ১০ এপ্রিল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা ও প্রথম ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক শারমিন সুলতানাকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু কোনো সুফল মেলেনি। দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্ট ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মেলেনি।
যদি বলা হয় তনুর বেদনাদায়ক মৃত্যু বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীসহ সমাজের একটি বড় অংশকে প্রতিবাদ মুখর করে তুলেছে, তাহলে ভুল বলা হবে না। এভাবে তনুর মৃত্যু দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। তনুর হত্যাকারীরা এখন পর্যন্ত চিহ্নিত না হওয়া ও ধরা না পড়া দেশের আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়া ও নেপথ্যের রহস্যময় হস্তক্ষেপের কথাই যেন বলে। কিন্তু এটা বহু মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এর বিচার চায় মানুষ। সে জন্য আজ শিক্ষার্থী ও নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এরমধ্য দিয়ে দেশের সরকারের প্রতি, আইনের নিজস্ব গতিতে চলার প্রতি তাদের অনাস্থাই প্রতিভাসিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে দেশে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। ২৭ মার্চ, ’১৬ এক দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মহিলা পরিষদের তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, ২০১৫ সালে ৮০৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জন নারীকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে ধর্ষিত হন ৬৬৬ জন নারী। ৮৫ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাড. এলিনা খান বলেন, নারী নির্যাতনের মামলা বছরের পর বছর আদালতে পড়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া যায় না। এ কারণেই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাঁর এ বক্তব্য সরকারের নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের গালভরা বুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তনু ছিল একজন সম্ভাবনাময়ী তরুণী। এ পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার ছিল। সে অধিকারকে নির্মমভাবে দলিত-মথিত করেছে মানুষ নামের কতিপয় পশু। যে কোনো বিচারেই তা জঘন্য অন্যায়। এ অন্যায়ের সুষ্ঠু বিচার হওয়া প্রয়োজন। সে সাথে প্রয়োজন এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তা নিশ্চিত করা। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। ২০ মার্চ তনু হত্যার ঘটনার পর ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। এ ক্ষেত্রে শৈথিল্য এ ধরনের আরো মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেবে যা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত।
য় লেখক : সাংবাদিক
যথসধযসঁফনফ@ুধযড়ড়.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তনু হত্যার বিচার চায় মানুষ
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ