Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিকল্প কর্মসংস্থান, স্থায়ী অবকাঠামো, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, গবাদি প্রাণি রক্ষার ব্যবস্থাই বড় চ্যালেঞ্জ

হাওরের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের অভিজ্ঞতা বিনিময়

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৮, ১২:০২ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : হাওরবাসীর উন্নয়নে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, নিরাপদ স্যানিটেশন, গবাদি প্রাণির দুর্যোগকালীন আশ্রয়, খাদ্যসংকট মোকাবেলা, বর্ষাকালে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ধরে রাখাই উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। গতকাল বৃহস্পতিবার হাওর এলাকায় বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এই সভার আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।
২০১৭ সালে আকস্মিক বন্যা ও অতি বৃষ্টিতে হাওরবাসীর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি তাদের জীবনজীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৭-র অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইউকেএইড-এর অর্থায়নে ব্র্যাক সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা ও মিঠামইন এবং নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলায় ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড রিকভারি প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, হাওরবাসীর উন্নয়নে সরকারের নানান উদ্যোগ থাকলেও অনেক সমস্যার কাক্সিক্ষত সমাধান এখনও হয়নি। তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরতেই এই অভিজ্ঞতা বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ, বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মজিবুর রহমান এবং ডিএফআইডি বাংলাদেশ প্রধান (যুক্তরাজ্য সাহায্য সংস্থা) জেন এডমন্ডসন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন করেন ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. আকরামুল ইসলাম। আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, হাওর অঞ্চলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, গবেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।
এছাড়া ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পক্ষ থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের নতুন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে গৃহীত প্রকল্পের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ব্র্যাকের সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি এবং সেভ দি চিলড্রেন এর প্রতিনিধিবৃন্দ। অনুষ্ঠানে হাওর প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা বিষয়ক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মৃর্ত্যুঞ্জয় দাশ।
অনুষ্ঠানে মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওর এলাকায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বৃষ্টি না হয়ে এখন দেশে আগাম বৃষ্টি ও বন্যা হচ্ছে। আর এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে হাওর এলাকায়। তিনি বলেন, গতবছরের (২০১৭ সাল) মতো এইবার হাওর এলাকায় সেরকম পরিস্থিতি হয়নি। এইবার সেরকম কিছু না হলেও আমাদেরকে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে হাওরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে।
মো. মজিবুর রহমান বলেন, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের অবশ্যই হাওর এলাকার স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে- যাতে কোনভাবেই পানি বাঁধাগ্রস্ত না হয়। জলমহাল উন্মুক্তকরণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি এটা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, এর ফলে হাওর এলাকায় মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রজনন হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ ‘ইজারা’ প্রথার কারণে জলমহাল এখন একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে। জেন এডমন্ডসন হাওরের পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় কমিউনিটিকে আরও বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, হাওরের স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। ’৬০ ও ৭০ এর দশকে হাওর নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সে গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদেরকে স্থানীয় কমিউনিটিকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, এখন কৃষক ‘বিআর-২৮’ ধান উৎপাদনের দিকে বেশি ঝুঁকছে। কিন্তু এটা একেবারে গুরুত্বহীন। আমি মনে করি, হাওরের ধরণ অনুযায়ী নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কমিউনিটি পর্যায়ে সবুজ ঘাস উৎপাদনের বিকল্প উৎস হিসেবে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটি ছাড়া গোখাদ্যের জন্য ঘাস উৎপাদন ও এই প্রযুক্তিতে ঘাস চাষের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরি; কমিউনিটির সহায়তায় ‘আফাল’ (হাওরের ঢেউ) থেকে হাটিগুলোকে (ছোট ছোট গ্রাম) রক্ষার জন্য ৩১ টি হাটি মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া। এর ফলে আগামী ৫ বছর পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
আলোচনায় যেসব সুপারিশ উঠে আসে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের আয়বৃদ্ধিমূলক জীবিকা উন্নয়নের জন্য কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা, সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার, দীর্ঘমেয়াদী কৃষিজ পরিকল্পনা, আপৎকালে জলমহাল উন্মুক্তকরণ, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার আগাম সতর্কতার জন্য কারিগরি উন্নয়ন ঘটানো, উপযোগী বোরো ধানের জাত ও রোপণের সময়কাল নিরূপনে আরো বেশি গবেষণা করা, আশপাশের নদীগুলোর নাব্যতা আনুপাতিক হারে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া, দুর্যোগ শেষে কৃষকদেও জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা।
রিলিফ নয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চাই
ছাগলনাইয়া (ফেনী) উপজেলা সংবাদদাতা : পরশুরাম-ফুলগাজী ছাগলনাইয়া উপজেলা নিয়ে ফেনী-১ সংসদীয় এলাকা গঠিত। প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের বাস এ জনপদে। ফেনীর উত্তর-পুর্ব কোণে অবস্থিত এ এলাকার মানুষের প্রধান উপজীব্য পেশা কৃষি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন রাত পরিশ্রম করে এ অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকে তাদের জমির ফসল প্রতি বৎসর ঘরে তোলা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। কৃষকের দু’ফসলী শতশত হেক্টরের জমিগুলো পানির নীচে থাকে প্রায় ছয় মাস। ভারত হতে উৎস মুহুরী নদী প্রবাহিত হয়েছে এই তিন উপজেলার বুক চিরে।
বর্ষায় চির যৌবনা এ মুহুরী নদীর করাল গ্রাসে বানভাসী মানুষের ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সর্বনাশা বন্যায় সৃষ্ট নদীর ভাঙনে অবহেলিত এ জনপদের মানুষের প্রধানতম কৃষজ উৎপাদন ধান পানিতে তলিয়ে যায়। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীসহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণিসহ শত-শত মৎস্য ঘের বন্যার পানিতে ডুবে অসীম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। উপজেলার শত শত স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতে ভোগান্তি চরমে উঠে। সর্বনাশা মুহুরীর অকাল ও বর্ষাকালীন বন্যায় প্লাবিত অসংখ্য ব্রীজ, পুল, কালভার্টসহ সরকারি স্থাপনা ও অবকাঠামো ভেঙে পড়লে সরকার শত শত কোটি টাকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ অঞ্চলে ছোট বড় অসংখ্য বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতাকে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। উজান হতে নেমে আসা বন্যার পানিতে চরম ভুক্তভোগী মানুষ ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলাকেও দায়ী করতে ভুলেননি। অবহেলিত কৃষকরা মুহুরী নদী শাসন, অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন বন্ধসহ সিলোনীয়া, কহুয়া ও গথিয়া নদী ও খালের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুনঃখনন ও বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে নদীর দুপাড়ে পাকা রাস্তা নির্মাণ ও বৃক্ষ রোপন করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলে এর স্থায়ী সমাধানের দাবি জানায়। এ দিকে অসমর্থিত একটি সুত্র জানায়, মুহুরী নদীর বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকে আন্তরিকভাবে মুহুরী প্রকল্প পাশ করা হয়। জানা গেছে এ প্রকল্প সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। সরেজমিনে দেখা যায়,আশ্রয় শিবিরগুলোতে ঠাঁই নেয়া দরিদ্র-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন এবং সেবামুলক সংস্থা হতে রিলিফ বিতরণ করা হয়। এ রিলিফ বিতরণেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে বারবার। হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কিছু লোক উপকৃত হলেও কৃষক হয় অবহেলিত। বন্যা নিয়ন্ত্রনে মুহুরী নদীর বাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি। জানা গেছে, চলতি বৎসরের জুনমাসে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের পাশে জেলা, উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ নিয়ে আসলেও ক্ষুদার্থ মানুষ তা ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানায়। আগামী আমন মৌসুমের পুর্বেই কৃষকরা সমস্বরে প্রতিবাদ করে বলতে থাকে “আমরা রিলিফ চাইনা-ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ চাই।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ