পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম ও আসলাম পারভেজ : মারাত্মক দূষণে বিপর্যয় ঘটেছে হালদায়। এশিয়ায় মিঠাপানির বড় জাতের মাছের জোয়ার-ভাটা নির্ভর একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীটি বিষিয়ে উঠেছে। কাঁদছে হালদা। মরছে মা-মাছ। ঝাঁকে ঝাঁকে মারা পড়ছে হরেক প্রজাতির মাছের সঙ্গে জীববৈচিত্র্য এবং তাদের খাদ্য শৃঙ্খল। ‘মাছের ব্যাংক’ হিসেবে খ্যাত হালদায় এবং খালে-বিলে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, আইড়, বাগদা চিংড়িসহ বিচিত্র প্রজাতির মা-মাছ বেঘোরে মরে ভাসতে দেখা গেছে। নদী খাল বিলের তীরে বাতাসে ভেসে আসছে দুর্গন্ধ। ¯্রােতের টানে ভাটির দিকে ভেসে যাচ্ছে প্রচুর মরা অথবা আধমরা মাছ। জাল ফেলতেই নদীর তলদেশ থেকেও মৃত মাছের দলা উঠে আসছে। এতে করে আগামী মৌসুমে (এপ্রিল-মে) নদীর বুকে দলে দলে মা-মাছের ডিম ছাড়া নিয়ে ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছে। এবারের মৌসুমে দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে হালদায় মা-মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রহ করা হয় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। ডিম থেকে ফোটানো রেণু ও পোনা থেকে সমগ্র দেশে হাজার কোটি টাকা মূল্যের মৎস্য উৎপাদিত হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, হালদা নদী ও এর সাথে যুক্ত কয়েকটি খালের পাড় ঘেঁষে যথেচ্ছভাবে গড়ে ওঠা ডজন সংখ্যক কল-কারখানা, ট্যানারির জমিয়ে রাখা হয় বিষাক্ত রাসায়নিক, পয়োবর্জ্য, পোড়া তেলসহ যাবতীয় বর্জ্য ও আবর্জনা। সেসব বিষাক্ত বর্জ্য চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হালদায় পাহাড়ি ঢলে বন্যার সময় পানিতে একযোগে ছেড়ে দেয়া হয়। সুযোগ বুঝে কারখানা মালিকরা কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এহেন কাÐ ঘটায়। বানের পানিতে সেই বিষাক্ত বর্জ্যরাশি হালদার ভাটির অংশে এবং এর সাথে যুক্ত খাল-ছরাগুলোতে, বিলে বিলে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই ঘটে দূষণে মারাত্মক বিপর্যয়। হাটহাজারীর নন্দীর হাট থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার ব্যাপী অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ছোট-মাঝারি শিল্প, কল-কারখানা, ট্যানারিগুলো দূষণের জন্য সরাসরি দায়ী। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ মরা খাল হিসেবে পরিচিত স্থানীয় একটি খাল ছিল দীর্ঘদিন বর্জ্যে ভর্তি। আবার বামনখালী খালটি আগেই ভরাট ও বন্ধ করে দেয়ায় বর্জ্য জমা হয় বিলে। ঢল-বানের পানিতে তা আরও ছড়িয়ে পড়ে।
হালদা নদী ও এর সাথে যুক্ত খাল-ছরাগুলোকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে আছে এক ডজনেরও বেশি শিল্প-কারখানা, ট্যানারি, প্ল্যান্ট প্রভৃতি দূষণ সৃষ্টিকারী উৎস। এরমধ্যে কোন কোনটির পেছনে রয়েছে প্রতাপশালী মহল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা জেনেও না জানার ভান করছে এবং দায় এড়িয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প, কল-কারখানার মধ্যে রয়েছেÑ হাটহাজারীর নন্দিরহাটের পশ্চিমে স্থাপিত এশিয়ার পেপার মিলস, যার বিষাক্ত বর্জ্য মরা ছরা দিয়ে হালদায় গিয়ে পড়ছে। সরকারি খাতের একশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্টের (জ্বালানি তেলচালিত) ১১ মাইল নামক স্থানে রয়েছে, যার বর্জ্য মিঠাছড়া দিয়ে পড়ছে হালদায়। এফটিএম এনার্জি লিমিটেড নামের টায়ার কারখানা গড়ে উঠেছে নন্দিরহাটের পশ্চিমে। যার বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে মরা খাল হয়ে হালদায়। ১১ মাইল নামক স্থানে স্থাপিত প্লাস্টিক কারখানার বর্জ্য-আবর্জনা মরা ছরা হয়ে হালদায় পড়ছে। হাটহাজারী কলেজ গেইট সংলগ্ন তার কারখানার বর্জ্য নর্দমা দিয়ে সরাসরি হালদায় যাচ্ছে।
ফরহাদাবাদের উদালিয়া চা বাগানের রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বিষসহ যাবতীয় বর্জ্য একুতি ছরা দিয়ে মন্দাকিনি খাল হয়ে যাচ্ছে হালদায়। নজুমিয়া হাটে কেবি ফ্যান কারখানার বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে মদুনাঘাট সংলগ্ন হালদায়। মাদার্শায় জসিম উদ্দিনের চারতলা বিশিষ্ট বিশালাকায় পোল্ট্রি ফার্মের যাবতীয় বর্জ্য মাদার্শা খাল হয়ে গিয়ে পড়ছে হালদা নদীতে। ইছাপুর বাজারের তুলা কারখানার বর্জ্য নালা দিয়ে যাচ্ছে হালদায়। নন্দিরহাটের পশ্চিমে পার্ম ফ্যাশন নামক গার্মেন্টসের ওয়াশিং প্লান্টসহ কারখানার যাবতীয় বর্জ্য মরা ছরা দিয়ে হালদায় মিশছে। ১১ মাইল নামক স্থানে ফুজেজ নামক গার্মেন্টসের একই ধরনের বর্জ্য-আবর্জনা একুতি ছরা দিয়ে হালদায় পতিত হচ্ছে। তাছাড়া আমান বাজার থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত যথেচ্ছভাবে দীর্ঘদিন গড়ে উঠেছে ট্যানারিসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা। এর বর্জ্য খন্দকিয়া খাল এবং বিআরটিসি খাল হয়ে গিয়ে পড়ছে হালদা নদীতে। তাছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ চট্টগ্রাম শহরতলী ও হাটহাজারী-রাউজান এলাকার পয়োবর্জ্য প্রতিনিয়ত হালদাকে বিষিয়ে তুলছে।
হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া গতকাল (শনিবার) দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আমাদের ৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম গত দুই দিনে হালদা নদীর ১০টি পয়েন্ট থেকে দূষিত পানির নমুনা সংগ্রহ করেছি। তাদের সঙ্গে পরে যোগ দেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞগণও। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, মাছসহ প্রাণি ও জীববৈচিত্র্য বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকা অপরিহার্য হালদার পানিতে তা এখন আর অবশিষ্ট নেই। প্রতিলিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। ইতোপূর্বে হালদায় ৫-এর উপরে অক্সিজেনের উপস্থিতি ছিল। অথচ হালদায় আজিমের ঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত এখন তা নেমে গেছে গড়ে ২ মিলিগ্রামে। হালদার সাথে যুক্ত খাল-ছরায় তা এক মিলিগ্রামে পাওয়া গেছে। আর মারাত্মক ক্ষতিকর এমোনিয়া গড়ে একশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
হালদা ও এর খালগুলোর পানি প্রায় অক্সিজেন-শূণ্য হয়ে পড়ার কারণেই মাছ বা যেকোন জলজ প্রাণী বাঁচার ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিরূপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন জাতের মাছ মারা গেছে। এরমধ্যে ১৫ কেজি ওজনের মৃত মৃগেল মা-মাছও পাওয়া গেছে। তাছাড়া মৃত বড় মা-কাতলা মাছ ভেসে যেতে দেখা গেছে। বাগদা চিংড়ি প্রায় নির্বংশ হয়ে গেছে। মরা আইড় মাছও উদ্ধার করা হয়। হালদা নদীতে এবং এর সাথে যুক্ত খন্দকিয়া, কাটালী ও মাদারী এই তিনটি খালে বর্জ্যরে কালো পানিতে মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখা গেছে বেশি হারে।
এদিকে হালদায় দূষণে মাছ মরে যাওয়া এবং দূষণের উৎসগুলো কঠোর হাতে বন্ধ করাসহ দূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের দাবিতে গতকাল হালদা তীরবর্তী মদুনাঘাটে সর্বস্তরের মানুষের মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের নদী হালদাকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ জানান, হালদাকে ভয়াবহ দূষণের কবল থেকে রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ বা সংস্থাকে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। প্রথমত দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে রোধ বা নিয়ন্ত্রণ এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।