দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
৫। হযরত খিযির (আ) এর উদাহরণ:
সূরা কাহাফে হযরত মূসা (আ) ও হযরত খিযির (আ) এর একসঙ্গে সফর করার বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। সফরের মাঝখানে হযরত খিযির (আ) একটি নৌকায় ছিদ্র করে দিলেন। জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তরে বললেন-
“আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে;” (কাহাফ : ৭৯)
আরেকটু অগ্রসর হয়ে দু’টি এতিম শিশুর গৃহের পার্শস্থিত ভগ্নপ্রায় দেওয়াল পুনঃ নতুনভাবে নির্মাণ করে দিলেন। জিজ্ঞাসা করায় তিনি জবাব দিলেন- “কাজেই আপনার রব তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে,তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং তারা তাদের ধনভান্ডার উদ্ধার করুক।” (সূরা-কাহাফ : ৮২)
যদিও হযরত খিযির (আ) উক্ত দু’টি কাজই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ীই করেছিলেন ; কিন্তু তাতে আদবের চ’ড়ান্ত রূপ লক্ষ করুন! যে-কাজটি বাহ্যিকভাবে মন্দরূপে প্রতিভাত হচ্ছিল তথা নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া-সেটাকে তিনি “আমি ইচ্ছা করলাম,তাকে ত্রুটিযুক্ত করার”-বাক্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রকাশ করলেন। আর যে-কাজটি ভালো হিসাবে প্রতিভাত হয় তথা ‘দেওয়াল নির্মাণ করে দেওয়া’-সেটিকে ‘আপনার রব ইচ্ছা করেছেন’-বাক্যে,আল্লাহর প্রতি সম্পৃক্ত করলেন!
৬। হযরত ইউনুস (আ) এর উদাহরণ
হযরত ইউনুস (আ) এর প্রতি যখন আল্লাহর পক্ষ হতে পরীক্ষা এল এবং তিনি মাছের পেটে বন্দী হলেন তখন তিনি সীমাহীন কাকুতি-মিনতিসহ মাওলার দরবারে স্বীয় ফরিয়াদ পেশ করলেন নিম্নোক্ত বাক্যে-
“আপনি ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই ; আপনি কতইনা পবিত্র ও মহান, নিশ্চয় আমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ্।” (আম্বিয়া:৮৭)
পবিত্র কুরআনের আয়াত সাক্ষ্য দিচ্ছে, যদি হযরত ইউনুস (আ) উক্তরূপে আদবের সঙ্গে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা না করতেন তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁকে মাছের পেটেই অবস্থান করতে হতো। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন-
“অতঃপর তিনি যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন,তাহলে তাঁকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত খাকতে হতো, তার(মাছের) পেটে।” (সূরা-আস্সাফ্ফাত : ১৪৩-১৪৪)
এ থেকে এটিও বোঝা যাচ্ছে যে, সৃষ্টিজগতের প্রভুর দরবারে কাকুতি-মিনতি ও আদবের সঙ্গে যে-প্রার্থনাই করা হোক তা তিনি অবশ্যই কবূল করবেন। বর্তমানেও অধিকাংশ আল্লাহওয়ালাগণ বিপদগ্রস্ত জনগণকে এই পবিত্র আয়াতের ওযীফা-খতম বলে দিয়ে থাকেন। বিপদ-মসিবত দূরীকরণার্থে আয়াতটি একটি মহৌষধের নামান্তর।
৭। হযরত ঈসা (আ) এর উদাহরণ
আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন খ্রিস্টানদের জিজ্ঞাসা করবেন, তোমরা ঈসা-কে এবং তার মা’কে আমার সঙ্গে কেন শরীক করলে? তারা মিথ্যা ভাষণের মাধ্যমে বলতে শুরু করবে, তাঁরাই আমাদের তা করতে বলেছিলেন। সে কারণে আল্লাহ তা‘আলা হযরত ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করবেন- “আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর?” (সূরা-আল-মায়েদা : ১১৬)
বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট যে, যখন আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করবেন,“আপনি কি বলেছেন”? তা হলে সেক্ষেত্রে সাধারণভাবেই তার একমাত্র জবাব হচ্ছে,“আমি বলিনি”। কিন্তু এমন উত্তর শাহী দরবারের আদব-শিষ্টাচার পরিপন্থী। তাই হযরত ঈসা (আ) নেতিবাচক ধারার পরিবর্তে ইতিবাচক ধারা অবলম্বন করে বিনয়ের সঙ্গে - “আপনিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা,আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে আপনি তো তা জানতেন। আমার অন্তরের কথা তো আপনি জানেন,কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না;নিশ্চয় আপনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো জানেন”। (আল-মায়েদা : ১১৬)- এভাবে উত্তর দিলেন।
যখন খ্রিস্টানদের মিথ্যা বলা প্রমাণিত হয়ে যাবে তখন হযরত ঈসা (আ) স্বীয় পাপী উম্মতের ক্ষমার জন্য এভাবে প্রার্থনা করবেন না যে, “আপনি তাদের শাস্তি দেবেন না”। কেননা এমনটি শাহী দরবারের আদব-বিনয় পরিপন্থী। তাই তিনি নিজ আবেদন এভাবে পেশ করলেন-
“আপনি যদি তাদরকে শাস্তি দেন তা হলে তারা তো আপনারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তাহলে আপনি তো পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়”। (আল-মায়েদা : ১১৮)
৮। হযরত মুহাম্মদ (স) এর উদাহরণ
মহানবী (স) যখন মি’রাজ এর প্রাক্কালে শাহী দরবারের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন তখন তিনি এতো বেশী পরিমাণ, চুড়ান্ত আদব, ভাবগম্ভীর,গুরুগম্ভীর অবস্থানে ছিলেন যার সাক্ষ্য খোদ মহান আল্লাহ নিজেই প্রদান করেছেন-
আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (র) আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে লিখছেন-
“অর্থাৎ চক্ষু যা দেখেছে ধীরস্থিরভাবে, নিশ্চিতভাবে দেখেছে। আদবের দরুন চোখ এদিক-সেদিক, ডানে-বামে, বক্রচোখে তাকায়নি আর সুনির্দিষ্ট স্থানও অতিক্রম করেননি। কেবল ওই সব বস্তুতেই নিজেকে সীমীত রেখেছেন যা যা তাঁকে দেখানো উদ্দেশ্য ছিল। রাজা-বাদশাহদের দরবারে যা কিছু দেখানোর উদ্দোগ নেওয়া হয় তা না দেখা এবং যা কিছু দেখানোর নয় সেদিকে উকিঁ দেয়া-উভয়টিই বে-আদবী, দোষণীয়। মহানবী (স) উভয়টি থেকে পবিত্র ছিলেন।”
হযরত সুলতান মাহমূদ গজনবী (র) একজন খাটি ওলীও ছিলেন এবং সমকালীন বাদশাহও ছিলেন। তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ওজীর আয়ায একদা দরবারে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তাঁর খেয়াল পড়লো , তাড়াহুড়োর কারণে জামার কলারের একটি বোতাম খোলা রয়ে গেছে। এটা যেহেতু রাজ-দরবারের আদব –পরিপন্থী ব্যাপার ছিল তাই তাৎক্ষণিক বোতাম ঠিক করার জন্য তাঁর হাত ওপরে উঠে গেল। ঠিক ওই সময়টাতেই সুলতান মাহমূদ গজনবীর দৃষ্টি আয়াজের প্রতি নিবদ্ধ হলে, তিনি বললেন: আয়ায! রাজ দরবারের এটা বুঝি শিষ্টাচার? আয়ায চুপচাপ নীরব-নিস্তব্ধ, নিজেকে অস্তিত্বহীন অবস্থায় আদবের সঙ্গে ঠায় দাড়িয়ে রইলো। এটা হল একজন সৃষ্ট বাদশার দরবারের আদব রক্ষার অবস্থা! সে হিসাবে আহকামুল-হাকেমীন, রাজাধিরাজ মহান স্রষ্টার সু-উচ্চ দরবারের আদব-শিষ্টাচারের দাবীও এমনটাই ছিল যে, প্রিয়নবী (স)-এরও ওইভাবেই উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল যার চিত্র খোদ সৃষ্টি জগতের মালিক-
“না তো দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছে, না তা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে”-
বাক্যে প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়ার তো প্রশ্নই উঠে
না ; প্রেমময়ের দর্শনের মুহূর্তে চোখের পলকেও এক মুহূর্তের জন্যও কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটেনি। অন্তরের মনোনিবেশও সেদিকেই নিবদ্ধ ছিল। না তো দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছে, না তা লক্ষ্যচু্ত্য হয়েছে। সুবহানাল্লাহ্!
ইমাম কুশাইরী (র) উক্ত আয়াতটিকে-
সর্বোৎকৃষ্ট আদবের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জ্ঞান করে ,“আদব অধ্যায়”টি শুরু করেছেন আয়াতটি উদ্ধৃত করার মাধ্যমে।
৯। পূর্বসুরী পূণ্যবানদের ঘটনা দ্বারা উদাহরণ
১। হযরত বিশরে হাফী (র) যৌবনের প্রারম্ভে পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। অসচেতন ও
লক্ষ্যহীন জীবনযাত্রা চলছিল। আর্থিক অবস্থাও দুর্বল ছিল। অধিকাংশ সময় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কেটে যেত। একদা নেশার তাড়নায় কোন প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলেন। গলিপথে চলন্ত অবস্থায় সামনে একটি পড়ে থাকা কাগজের ওপর দৃষ্টি পড়লো। তাকিয়ে দেখলেন তাতে আল্লাহ তা‘লার নাম লেখা ছিল। অগ্রসর হতে গিয়ে পা থমকে গেল এবং কাগজটি তুলে নিলেন। আদবের কথা বিবেচনা করে তা পরিস্কার করলেন এবং একটা উঁচুস্থানে তা উঠিয়ে রাখলেন। যেন আল্লাহর নামটি কারও পায়ের নিচে না পড়ে। তিনি যখন নিজ কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলেন তখন একজন কামিল ওলীআল্লাহ তাঁর সাক্ষাতের উদ্যেশ্যে তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হলেন এবং বলতে শুরু করলেন,“আল্লাহ তা‘লা ইলহামের মাধ্যমে আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, বিশরে হাফীকে গিয়ে বলে দাও, তুমি যেভাবে আমার নামকে সম্মান প্রদর্শন করেছ, সেভাবে আমিও তোমাকে দুনিয়ায় সম্মান দান করবো”। বাক্যটি তাঁর অন্তরে বজ্রপাতের অনুরুপ আঘাত হানলো। তিনি তাওবা-ক্ষমা চেয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এবং আধ্যাতিœক জগতে পৃথিবীর বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠতম একজন ওলী হযে গেলেন।‘ আল্লাহ’ শব্দের প্রতি আদব প্রদর্শনের দ্বারা তিনি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে উপনীত হলেন!
২। হযরত উমর ফারূক (রা) এর নাতি হযরত সালেম (র) একদা মক্কার হারাম শরীফে উপস্থিত হয়েছিলেন। ‘মাতাফ’-এ তৎকালীন বাদশাহ হিশাম ইবন আবদুল মালিক এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। বাদশাহ হিশাম সালাম দিয়ে আবেদন করলেন,“ হযরত! যদি কোন প্রয়োজন থাকে তাহলে আদেশ করুন! যেন আমি আপনার একটু সেবার সুযোগ পাই।” তিনি জবাবে বললেন,“হিশাম! বায়তুল্লাহ শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে কোন প্রয়োজনের কথা বলতে লজ্জা অনুভুত হচ্ছে! আল্লাহ তা‘লার প্রতি আদব-শিষ্টাচারের দাবী হচ্ছে, এখানে কেবল তাঁরই কাছে হাত পাতা চাই”। বাদশাহ হিশাম লা-জবাব হয়ে চুপ করে গেলেন। ঘটনাক্রমে তিনি যখন হারাম শরীফ থেকে বের হয়ে বাইরে গেলেন ঠিক একই সময়ে হিশামও বের হয়ে তাঁর সামনে মুখোমুখী হয়ে গেলেন। হিশাম তাঁকে সামনে পেয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,“হযরত! এখন বলুন,আমি আপনার কি সেবা করতে পারি?”তিনি বললেন:“হিশাম! ঠিক আছে তুমি বল, আমি তোমার কাছে কি চাইতে পারি? দীন-ধর্ম বিষয়ক কিছু? নাকি জাগতিক কিছু? হিশামের জানা ছিল,ধর্মীয় বিষয়ে তো তিনি তখনকার সম-সাময়িক সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিগণিত। তাই ধর্ম বিষয়ে কিছু না বলে, বললেন : হযরত! আপনি আমার কাছে জাগতিক কোন সেবার কথা পেশ করুণ! তিনি তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন : “আরে! জাগতিক কোন কিছু তো আমি কখনো আমার প্রভু ও মালিকের কাছেও চাইনি! সুতরাং তোমার কাছে আমি দুনিয়াদারী কিছু চাইতে যাব কেন?” এটা শুনেই হিশামের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল! সত্যি কথা হচ্ছে, যেসব মনীষীর আল্লাহ রাব্বুল-আলামীন এর দরবারে প্রার্থনা-আরাধনার আদব জানা আছে, শেখা হয়েছে, তাঁরা দুনিয়াপ্রেমিক কারো কাছে কখনো কোন কিছুর জন্য হাত বাড়ান না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।