স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সর্বাধিক অবদান রাখেন পীর-ওলামাগণ। এখানে ইসলাম প্রচার শুরু হয় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়েই। আরব বণিকরা ইসলামের খবর নিয়ে আসেন নৌপথে। তখন আরব বণিকরা বাণিজ্যের সুবাদে চীন-সুমাত্রা অঞ্চলে বাংলাদেশের স›দ্বীপ বন্দর হয়ে যাতায়াত করতেন। অনেক সাহাবী সে সব নৌবহরে আসতেন। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হুদাইবিয়ার সন্ধি হবার পর ইসলাম প্রচারকদের বিভিন্ন অঞ্চলে গমনের সূচনা হয়। এটা ব্যাপকতা লাভ করে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে বিদায় হজের খুতবায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘হে লোক সকল! তোমরা যারা এখানে উপস্থিত আছ এবং আমার খুতবা শুনছ তাঁরা আমার এই কথাগুলো যারা উপস্থিত নেই তাঁদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে। তিনি বলেন, আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহ। যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধর তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই খুতবার নব্বই দিনের মাথায় তাঁর রফিকুল আলা আল্লাহ জাল্লা শানুনুর দরবারে চলে যান। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে হযরত ওমর রাদিআল্লাহুতায়ালা আনহুর খিলাফতকালের মধ্যভাগে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ব্যাপকতা লাভ হয়। প্রথম দিকে কিছু সাহাবী এখানে ইসলাম প্রচার করে চীন-সুমাত্রা অঞ্চলে চলে যান। তাঁদের অনেকেরই মাজার চীনের ক্যান্টন নগরীতে এখনও আছে। যে মসজিদের পাশের গোরস্থানে ঐ মাজারগুলো সে মসজিদের নাম অ্যাম্বাসেডর মসজিদ এবং সেই গোরস্থানের নাম অ্যানচেস্টার গ্রেভইয়ার্ড। পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। উমাইয়া খিলাফতের সূচনাকাল থেকেই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে দলে দলে ইসলাম প্রচারকগণ আসতে থাকেন। তাঁরা ছিলেন আরবী, ফারসি, ও তুর্কি ভাষাভাষী। এখানে এসে তাঁরা এ অঞ্চলের মানুষের ভাষায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাদের ভাষার সংস্পর্শে এ দেশের মানুষের ভাষায় প্রভূত আরবী, ফারসি, তুর্কি ভাষার মহামিলন ঘটে। যার ফলে বাংলা ভাষা শক্তিশালী ভাষাতে পরিণত হয়। বাংলার সুলতানগণ বাংলা ভাষাকে অবহেলা থেকে উদ্ধার করে শাহী মসনদে অধিষ্ঠিত করেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাহাদতে বাংলা ভাষার ঘোর দুর্দিন নেমে আসে। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। তখন থেকেই স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য ফকির মজনু শাহ, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, সৈয়দ নেছার আলী, তিতুমীর প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের ধর্ম প্রচারে এ দেশে বহু খ্রিষ্টান মিশনারির উদ্ভব ঘটায়। সেসব মিশনারি ইসলাম ও ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা এ দেশে মুদ্রণযন্ত্রের আমদানি ঘটিয়ে তা দ্বারা সমস্ত পুস্তক-পুস্তিকা ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে। সেই সব পত্রপত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুসমাচার, পান্ডব ইত্যাদি। এই বান্ধব পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে ‘আসল কুরআন কোথায়’ শীর্ষক এক লেখা প্রকাশিত হলে যশোরের মুনশী মেহেরুল্লাহ ‘ইসলাম প্রচারক’ নামক এক মাসিক পত্রিকায় লেখেন ‘আসল কুরআন’ সর্বত্র। মুসলিম মননে সংবাদপত্র প্রকাশের আগ্রহ প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ফুরফুরা শরীফের আলা হযরত মাওলানা শাহ সুফী মুজাদ্দেদে জামান আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুসলিমদের মধ্যে পত্রপত্রিকা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চারিত করেন এবং বহু পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতাও করেন।
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তার সম্পাদক ছিলেন পাদ্রী মার্সম্যান সাহেব।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে এবং তার পরে বাংলার মুসলিম সমাজে যে কয়েকটি সাময়িকী আত্মপ্রকাশ করে তার অনেকটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ফুরফুরার পীর সাহেব। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ মাসিক ‘সুধাকর’ প্রকাশ করেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সী আবদুর রহীম সাহেব বের করেন ‘মিহির’। ‘মিহির’ পত্রিকা সুধাকরের প্রতিদ্ব›দ্বী রূপেই বের হয়। ফুরফুরার পীর সাহেব উভয়ের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তখন পত্রিকার নামকরণ হয়। ‘মিহির ও সুধকর’। হযরত পীর সাহেব এর প্রচার ও প্রকাশে সহায়তা করেন। এ সময় মুন্সী রেয়াজ উদ্দীন ইসলাম প্রচারক পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। মিহির ও সুধাকর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলে। তারপর মুন্সী আব্দুর রহীম সাহেবের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক মুসলিম হিতৈষী পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। কলকাতায় গ্রিয়ার পার্কে আঞ্জুমানে ওয়ায়েজিনের অধিবেশনে অনুরোধ করার ফলে তাঁর দানশীল ধনী মুরিদরা অর্থ সাহায্য করে প্রেস ও প্রেসের সরঞ্জাম খরিদ করে দিয়ে পত্রিকা বের করার সুযোগ করে দেন। ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ও কলকাতার তৎকালীন মুসলিম ব্যবসায়ী মোল্লা আতাউল হক সাহেব বিভিন্ন সময় মুসলিম হিতৈষী পত্রিকাটি পরিচালনার জন্য যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য প্রদান করতেন। আর ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব মাহফিলে মাহফিলে প্রচার করতেন এবং গ্রাহক সংগ্রহ করতেন। তার ফলে মুসলিম হিতৈষী গৌরবের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করে। সাপ্তাহিকটি কয়েক বছর পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের মুখপত্রের কর্তব্য পালন করে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ফুরফুরার পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে ‘দৈনিক আজাদ’ বের করেন। আজাদ পত্রিকা মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করে।
বাংলার মুসলিম সমাজের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা হচ্ছে মাসিক ‘নবনূর’ ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ এমদাদ আলী সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা পীর সাহেব কেবলা করেছেন। পীর সাহেব কেবলার একান্ত চেষ্টায় রাজশাহী টাউনের অধিবাসী তাঁর মুরিদ মীর্জা ইউসুফ আলী সুলতান বের করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এবং অল্পদিনের মধ্যেই পত্রকাটি দৈনিক পত্রিকায় উন্নীত হয় এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে পীর সাহেব কেবলার নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্জুমানে ওয়েজিনের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘আল ইসলাম’ পত্রিকা। অন্যান্য ধর্মীয় মাসিক পত্রের মধ্যে আবদুল হাকিমের সম্পাদনায় বের হয় ‘ইসলাম দর্শন’। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পীর সাহেব কেবলার নির্দেশে মওলানা রুহুল আমিনের সম্পাদনায় বের হয় শক্তিশালী সাপ্তাহিক ‘হানাফী’। বের হয় যশোরের খান বাহাদুর আহমদ আলী এনায়েতপুরীর সম্পাদনায় শরিয়তে ইসলাম প্রভৃতি কালজয়ী পত্রিকা। শরিয়তে ইসলামের সম্পাদক খান বাহাদুর আহমদ আলী এনায়েতপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি পীর সাহেব কেবলার খাস খলিফা ছিলেন। এই পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহের জন্য পীর সাহেব কেবলা যে বিবৃতি দান করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি সেই বিবৃতিতে বলেন, ‘শরিয়তে ইসলামের’ গ্রাহক থাকিবার জন্য আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করিতেছি। অধিকন্তু এর পর হতে প্রত্যেকে অন্তত দুইটি করে শরিয়তে ইসলামের নতুন গ্রাহক সংগ্রহ করে দেবেন। আমার মুরিদ ও মোতাকেদগণকে ‘শরিয়তে ইসলামের’ গ্রাহক হওয়ার জন্য বিশেষভাবে বলছি, খাছ করে আমার খলিফাাদিগকে আদেশ করছি যে, যেন তারা তাদের মুরিদ ও পীর ভাইগণকে ‘শরিয়তে ইসলাম’ পত্রিকার গ্রাহক শ্রেণীভুক্ত করে দেবেন। আশা করি বছরে মাত্র একটি টাকা আল্লাহর ওয়াস্তে ব্যয় করে শরিয়তে ইসলামের গ্রাহক হতে এবং ছওয়াব হাসিল করতে কেউই আপত্তি করবেন না। খোদাতায়ালা আপনাদিগকে এই নেক কাজে সাহায্য করার জন্য দোহাজানের খায়েশ বখশেশ করুন। আমি আরো আশা করি, প্রত্যেক মসজিদের মুসল্লিগণ একত্রে একটি টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে ‘শরিয়তে ইসলামের’ গ্রাহক হবেন এবং জুমা নামাজ বাদে ইমাম সাহেব কাগজ পড়ে মুসল্লিগণকে শুনিয়ে দেবেন, এতে খুব উপকার এবং টাকা দেয়ার সুবিধা হবে। -মোহাম্মদ আবু বকর (ফুরফুরা)
পীর সাহেব কেবলার ইন্তেকালের পর তাঁর গদ্দিনশীন সাহেবজাদা মওলানা শাহ সুফী আবু নছর মোহাম্মদ আবদুল হাই সিদ্দিকী নেদায়ে ইসলাম নামে একটি পত্রকা প্রকাশ করেন, যার প্রকাশনা অদ্যাবধি কলকাতা এবং ঢাকা থেকে অব্যাহত রয়েছে। তিনি মানবতা নামক একটি পত্রিকা বের করেন। মওলানা ভাসানী পাকিস্তান আমলে বের করেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা। ১৯৮৬ সালে ৪ জুন ঢাকা থেকে মওলানা আবদুল মান্নানের সম্পাদনায় বের হয় বাংলাদেশের আলেম সমাজের প্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইনকিলাব’। এখানে উল্লেখ যে, মাওলানা আবদুল মান্নানের আব্বা ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকীর খলিফা।
পাকিস্তান আমলে কয়েকজন ইসলাম দরদী আলেম প্রকাশ করেন কয়েকটি মাসিক পত্রিকা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মওলানা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের ‘আল বালাক’ পত্রিকা এবং মওলানা মহিউদ্দীন খানের মাসিক মদীনা পত্রিকা। এসব ছাড়াও শর্ষিনা থেকে বের হয়েছে তবলীগ পত্রিকা। এসব ছাড়াও শর্ষিনা থেকে বের হয়েছে পত্রিকা এবং দ্বারিয়াপুর শরীফ থেকে বের হয় ‘নবকাল’ পাক্ষিক পত্রিকা।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ মুফাছিরে কুরআন, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।