স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
মুসলিম বিশ্বের বর্তমানে চলছে দুরবস্থা। সর্বত্র তারা পরাজিত ও অপমানিত। তবু হুঁশ নেই। টনক নড়ছে না। জিন্দা লাশের অবস্থা। মুসলমানদের অপমান করার সঙ্গে সঙ্গে কুরআন, নবী (সা:) ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রæপ চলছে। কারণসমূহ কমই আমরা খুঁজে দেখি, অথচ কারণ না জানলে প্রতিকার কিভাবে হবে।
আমরা এখন প্রধান কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। এগুলো হলো-
(১) যোগ্যতার অভাব, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা তথা গবেষণার প্রতি অবহেলা, প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা, শিক্ষার হার হতাশামূলক।
(২) বুদ্ধিবৃত্তিক (ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়ার) দৈন্যতা। ফলে দেখা যায়, পাশ্চাত্য জগত, এমনকি এশিয়ার কিছু উন্নত দেশের মতোও মুসলিম বিশ্বে উঁচুস্তরের বই-পুস্তক বের হয় না। যাও হয় জনগণ তেমন কিনেও না, পড়েও না। এক লেখকের পাঁচশ’ কপি বই বের করলে, মনে করা হয় যে যথেষ্ট হয়েছে। পাশ্চাত্যে ফালতু বইও মিলিয়ন কপি চলে। অথচ মধ্যযুগে মুসলমানদের লেখা বইয়ের জন্য ইউরোপ হুমড়ি খেয়ে পড়ত। মুসলমান বিদ্বানগণ ছিলেন ইউরোপের শিক্ষক।
গত তিনশ’ বছর ধরেই মুসলমানগণ পেছনের কাতারে। কবি নজরুল পর্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছেন-
‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাঁহার জীবনে মৃত্যু-জ্ঞান।
যাঁর মুখে শুনি তৌহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।’
মুসলমানদের অযোগ্যতার কারণে অন্য জাতিগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে মারণাস্ত্র তৈরি করে অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে।
(৩) লেজুুড়বৃত্তির নীতি পালন করছে মুসলমান রাষ্ট্রগুলো। তাই তাদের নেই ইজ্জতের আসন।
(৪) মুসলমানদের অনেকেই ইসলামি আদর্শ থেকে সরে গেছে। তাই এসেছে লেজুড়বৃত্তি।
(৫) মুসলিম উম্মাহতে নেই আর ঐক্য।
(৬) নেতৃত্বের ব্যর্থতা আর এক কারণ। অনেকে নেতারই নেই যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা। কিছু নেতাকে হত্যা করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যাদের অন্যতম সউদী আরবের বাদশাহ ফয়সাল।
(৭) অমুসলমানদের যেমন বিশাল বিশাল রাষ্ট্র্র রয়েছে, মুসলমানদের নেই। বিশাল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইন্ডিয়া প্রভৃতির নিকট মুসলমান রাষ্ট্রগুলো ছোট। এদিকে তুরস্ক, সুদান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, এমনকি সউদী আরবকে পর্যন্ত টুকরা টুকরা করার নীল-নকশা করা হচ্ছে।
(৮) সিয়া-সুন্নি বিরোধকে আরো উসকে দিয়ে শত্রæরা ফাঁয়দা হাসিল করছে।
(৯) গণতন্ত্রহীনতা এর এক কারণ। বেশিরভাগ সরকারের উপর জনগণের আস্থা ও একাত্মতা নেই।
(১০) অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থপরতা ও শত্রুতা মুসলিম বিশ্বের জন্য হুমকি। তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোয়েন্দা টেকনিক ব্যবহার করছে, মালয়েশিয়রা পর্যন্ত মেধাবী ফিলিস্তিনিকে হত্যা করল ইসরাইলি গোয়েন্দারা।
(১১) মুসলিম নেতৃবৃন্দের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয় সম্পর্কে অপ্রতুল ধারণা ও জ্ঞান। পলাশী যুদ্ধের আগে-পরে এই অবস্থা ছিল।
(১২) ইসরাইলসহ কিছু রাষ্ট্রের ‘এগ্রেসিভ (আক্রমণাত্মক) ও প্রতিরক্ষা নীতি মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে মাথা তুলতেই দিচ্ছে না।
(১৩) হালে সউদী, মিসর, আমিরাত, প্রভৃতি রাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইসরাইল কর্তৃক বাগে আনা।
(১৪) পাশ্চত্য কর্তৃক ইসরাইলের মাধ্যমে সন্ত্রাস রফতানি করে এখন মুসলমানদেরই সন্ত্রাসী বলা।
(১৫) মুসলিম বিশ্বের গণমাধ্যমের দুর্বল অবস্থা। অন্যদিকে বিপক্ষের গণমাধ্যম সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানাতে ওস্তাদ।
(১৬) অন-ইসলামি আদর্শ, যেমন- কম্যুনিজম, উগ্রজাতীয়তাবাদ ইত্যাদির প্রভাব-প্রতিপত্তি।
(১৭) খ্রিস্টান-মিশনারীদের প্রচার ও ষড়যন্ত্র। ভ্যাটিকান ও তার বিশ্বব্যাপী কর্মচারী নেটওয়ার্ক, যা পররাষ্ট্রীয় কাঠামোতে হোক বা গির্জার আড়ালে হোক, একটা বড় বাঁধা ইসলামের প্রসারে। মুসলমানদের কেন্দ্র নেই, যা কামালপাশা আগেই খতম করেছেন। এই কার্যক্রম শুধু তুরস্ক নয়, সমগ্র উম্মাহকে দুর্বল করে দিয়েছে, অথচ একসময় ইউরোপ পর্যন্ত আরব ও তুর্কি খেলাফতের অধীন ছিল।
(১৮) পাশ্চাত্যের ক্রুসেডিয় মনোভাব এখনো রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে পাঠ করতে পারেন জার্মান নও-মুসলিম ও সাবেক জার্মানি রাষ্ট্রদূত মুরাদ উইলফ্রেজ হফম্যানের বই ‘ইসলাম ২০০০’।
বর্তমান যুগে মুসলমানদের দুরবস্থার আরো কারণ খুঁঁজে বের করা যেতে পারে। পরিস্থিতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
বড় সমস্যাগুলো :
সবচেয়ে বড় সমস্যা এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গারাও মুসলমান আর যেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে সেই বাংলাদেশও মুসলমান প্রধান। মুসলমান রাষ্ট্রগুলো যদি পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত রাষ্ট্রগুলোর মতো শক্তিশালী হতো, তাহলে মিয়ানমার সোজা পথে আসত। কিন্তু বাস্তবতা হলো দুটি পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত রাষ্ট্র তাদের পক্ষে। এমনকি তথ্যে প্রকাশ, উত্তর কোরিয়ার সাহায্যে মিয়ানমার পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
সমূহবিপদ বাংলাদেশের সামনে। এদিকে আসামের বাঙলাভাষী দেড় কোটি মুসলমানকে বিতাড়ন করা হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সউদী আরব, মিসর ও আমিরাত এখন সরাসরি ইসরাইলের দালালে পরিণত হয়েছে। সেখানকার একনায়ক নেতাদের গদিই মুখ্য দেশ-জাতি-ধর্মের চেয়ে। শেষ জামানায় ইহুদিরা নাকি মক্কা-মদীনা ছাড়া সমগ্র আরব ভ‚মিই দখলে নেবে। তারই কি এই আলামত?
ফিলিস্তিনের সমূহবিপদ এখন। কারণ ইসরাইল নয়, একটা মুসলিম দেশ সউদী আরব এর কারণ। সউদী আরব ফিলিস্তিনিদের বলছে ইসরাইলের নিকট নতজানু হতে।
সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মুসলিমবিরোধী প্রেসিডেন্ট গদিতে। তিনি ইসরাইল ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তিনি সর্বত্র ইসলামি টেররিস্ট দেখেন। তাঁর চোখে খ্রিস্টান, হিন্দু টেররিস্ট চোখে পড়ে না। ট্রাম্পের হঠাৎ করে নেয়া যে কোনো কঠিন পদক্ষেপ মুসলিম বিশ্বের সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। ট্রাম্পের শিরায় জার্মান রক্ত।
এদিকে ট্রাম্প সউদী আরব ও ইসরাইল ইরান ধ্বংসের অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগুচ্ছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, কেন পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো ইরানকে হুমকি দিচ্ছে? ইসরাইলের সুস্পষ্ট রেফারেন্সে মধ্যপ্রাচ্যের সব পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য, এই অঞ্চলে ইসরাইলকে একমাত্র পারমাণবিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। (তথ্য রয়টার্স)। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মাইক পম্পেও প্রথম দফাতেই যান ইসরাইল, সউদী আরব ও জর্ডান। প্রত্যেক জায়গায় তিনি ইরানকে তীব্র ভাষায় দোষারোপ করে বলেছেন, বিশ্বে সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হলো ইরান। তিনি এ দাবিও করেন, ইরানকে কখনোই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেয়া হবে না।
ইসরাইল ও ট্রাম্প গংয়ের এই নীতির তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান তীব্র সমালোচনা করেন। তবে এরদোগানকেই যে আবার দ্বিতীয়বার হত্যার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র চালাবে না তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা আগেই বলেছি, ইসরাইল তথা পাশ্চাত্য এখন গোয়েন্দা সন্ত্রাস ব্যবহার করে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে। এই কৌশল আমরা পলাশীর যুদ্ধের আগে ও পরেও দেখেছি।
পাশ্চাত্য মুসলমানদের ভেতর অনৈক্য সৃষ্টি করে সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান প্রভৃতি মুসলিম দেশে দোজখের অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আর হতভাগা মুসলমানরা পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র অনুধাবনেই ব্যর্থ। কি ব্যর্থ নেতৃত্ব চলছে এইসব দেশে। উত্তর কোরিয়াকে শিক্ষা দিতে লিবিয়া মডেল প্রয়োগ করা হবে, বলেন মার্কিন কট্টরপন্থ’ী নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোল্টন। এই বোল্টনই আফগানিস্তানের অন্যতম খুনি। লিবিয়া মডেলের উদাহরণ টানাই হলো মুসলমানদের কাটা ঘায়ে লবণের ছিঁটা দেয়া। এটা মুসলমানদের সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘মাইন্ডসেট’ আর কি।
এদিকে চীনেও অশান্তি। মুসলমানেরা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টিতে ইচ্ছুক। কিন্তু সে স্থানীয় মুসলমানদের উপর নির্যাতন করছে। তাদের রোজা পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। আর রোহিঙ্গাদের প্রতি চীন রাশিয়ার অনৈতিক অবস্থান হতাশাব্যঞ্জক।
সামগ্রিক পরিস্থিতি অবলোকন করে বলতে হয়, যদি মুসলমানেরা নিজেদের অনৈক্য ভুলে এক না হয়, তাহলে নবী (সা:) শেষ যুগের হতভাগা মুসলমানদের সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তাই অপেক্ষা করছে। ওআইসিকে এখনই শক্তিশালী না করলে আরো বড় বিপদ রয়েছে। যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমন্বিত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি অবলম্বন করতে পারে, ওআইসি কেন পারবে না। অথচ আল্লাহ ও রাসূল (সা:) মুসলমানদের সিঁসাঢালা প্রাচীর-সম ঐক্যের উপদেশ দিয়েছেন।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।