Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রেকর্ড গড়া বাজেট আজ

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : রেকর্ড চার লাখ ৬৪ হাজার ৫শ ৭৩ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আজ বেলা সাড়ে ১২টায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এটি হবে বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট এবং অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ১২তম বাজেট। টাকার অঙ্কের রেকর্ডের পাশাপাশি এ বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে একাধারে দশবার বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অনন্য রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন।
শেষ মুহূর্তে বাজেট ছোট করছেন অর্থমন্ত্রী। গত ৩০ এপ্রিল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তের পর মূল বাজেট কিছুটা ছোট করেছেন অর্থমন্ত্রী। চার লাখ ৬৮ হাজার ২০৫ কোটি টাকা থেকে তিন হাজার ৬৩২ কোটি টাকা কমিয়ে সবশেষ বাজেটের আকার নির্ধারণ করেছেন চার লাখ ৬৪ হাজার ৫শ ৭৩ কোটি টাকা। সাধারণত প্রতি বছর বাজেটের আগে এপ্রিল মাসের মধ্যেই বাজেটের মূল আকার নির্ধারণ করে থাকে অর্থমন্ত্রণালয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারেও ৩০ এপ্রিল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নতুন বাজেটের আকার হবে চার লাখ ৬৮ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এর আগে চলতি অর্থবছরেও বাজেটের আকার পাঁচ লাখ টাকা করার বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্ত প্রায় কয়েক দফা আকার নির্ধারণের পর শেষ মুহূর্তে কাঁটছাট করলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখেই অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন।
মুহিত বলেছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এই বাজেট নতুন কোনো কর আরোপ করা হচ্ছে না। বরং করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব আসতে পারে। আর ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের খুশি করতে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাবও এবারের বাজেটে আসতে পারে বলে মুহিত জানিয়েছেন। বিশেষ করে কমছে ব্যাংকিংখাতের করপোরেট কর।
মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের তিন মেয়াদে সর্বোচ্চ ১২টি বাজেট দেওয়ার রেকর্ড ছুঁতে চলা মুহিত সব প্রস্তুতি শেষ করে অনেকটাই নির্ভার। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসছে। ভোটার টানার লক্ষ্য নিয়েই এবার জনতুষ্টির বাজেট নিয়ে আসছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের বছর। তাই কঠোর বাজেট দিচ্ছি না। ৮৪ বছর পেরিয়ে আসা মুহিতের হাতে গত নয় বছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, নতুন বাজেটে তা চার লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার মত হতে যাচ্ছে। সম্পদের সংস্থান করতে পারলে আরও বড় বাজেট দেওয়ার প্রত্যাশা ছিল অর্থমন্ত্রীর। তবে দেশকে মধ্যআয়ের দেশের কাতারে নিতে পারায় তার আত্মতৃপ্তির কমতি নেই। এবারের ১০৩ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম তিনি ঠিক করেছেন ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ।’ মুহিত বলেছেন, আমার এবারের বাজেটে নতুন করে কোনো কর আরোপ হবে না। আর এটা হবে জনগণের জন্য সুখবর। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবাসহ বিভিন্ন উপকারভোগীর সংখ্যা এবং ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব বাজেটে থাকছে বলে জানান তিনি। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, সরকারের এ মেয়াদে তার শেষ বাজেট হবে পাঁচ লাখ কোটি টাকার। তবে তাঁর সেই লক্ষ্য এবার পূরণ হচ্ছে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে টানা ১০ বার বাজেট পেশের সুযোগ আগে কোনও অর্থমন্ত্রীর হয়নি। সেক্ষেত্রে আবুল মাল আবদুল মুহিতই প্রথমবারের মতো এই রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, এটি যেমন একটি রেকর্ড, তেমনি সৌভাগ্যেরও বিষয়। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। এর আগে, সর্বোচ্চ ১২টি বাজেট পেশ করেন সাইফুর রহমান। তবে তিনি একটানা পাঁচটি বাজেট দিয়েছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ দুই অর্থবছরেও বাজেট পেশ করেছিলেন।
আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে নতুন বাজেট। এবার অল্প কিছু বিলাস পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বসানো হবে। ভ্যাটের স্তর নয় থেকে পাঁচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। এসব বিবেচনাতেই বাজেটের আকার কমানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা।
আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পে-স্কেল অনুযায়ী পাঁচ শতাংশেরও বেশি হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা থাকছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। খরচের এই চাহিদা মেটাতে অর্থমন্ত্রী তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে চান। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর থেকে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে নয় হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
বাড়তি খরচের চাহিদা মেটাতে অর্থমন্ত্রীকে বড় অংকের ঘাটতি রাখতে হচ্ছে নতুন অর্থবছরে। বাজেটে ঘাটতি থাকছে এক লাখ ১৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের-জিডিপি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য বাজেটে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা থাকছে। ওই অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ঋণ নেবেন ৬০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে।
এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে চার হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচিতে এক হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, অন্যান্য স্কিমে ৩২৭ কোটি টাকাসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডে মোট এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা খরচের হিসেব করা হয়েছে। বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের মূল বাজেটে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ নয় হাজার ১৪২ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে এক লাখ ৯৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও সে তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়েনি। দারিদ্র্য বিমোচন ও সম্পদের বৈষম্য কমার হারও হ্রাস পেয়েছে। অর্থমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছিল ৫ দমমিক ৫ শতাংশ, কিন্ত বেশ কয়েকমাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে নতুন অর্থবছরে তা ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামানোর ঘোষণা থাকছে।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে। রাজস্ব বাজেট থেকে এই অর্থ জোগান দেয়া হবে। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাদেশ এবং সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থমন্ত্রী জানান, সিগারেট ও মোবাইল কোম্পানির জন্য করপোরেট ট্যাক্স ৪৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। এছাড়া ব্যাংকসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সব কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্সের সর্বোচ্চ হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না।
বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট কর ২৫ শতাংশ। আর যে কোম্পানি তালিকাভুক্ত নয় সেগুলোকে দিতে হয় ৩৫ শতাংশ হারে। আর ব্যাংকের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ৪০ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয়Ñএমন ব্যাংককে ৪২ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এবার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার সাড়ে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। তবে অর্থমন্ত্রী আগামী কয়েক বছরে সার্বিকভাবে করপোরেট কর হার কমিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা দেবেন।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা থাকবে নতুন বাজেটে। বর্তমানে আয় অনুযায়ী শূন্য, ১০, ১৫, ২০, ২৫ ও ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। নিচের দিকের করদাতাদের ওপর চাপ কমাতে এবার পাঁচ কিংবা সাড়ে সাত শতাংশ হারের আরেকটি নতুন কর স্তর রাখা হতে পারে।
গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট ও এসবে বিজ্ঞাপনের ওপর প্রদেয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে ডিজিটাল মার্কেটিং খাত হিসেবে আয়কর নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে এনবিআর। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকছে বাজেটে।
অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক অবস্থানে, রাজনীতিতে নেই অস্থিরতা, সামনে নির্বাচন। সেই ভোটে আওয়ামী লীগকে টানা তৃতীয়বারের মত জয়ী দেখতে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা সাজিয়ে ফুরফুরে মেজাজেই আজ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। আগামীকাল শুক্রবার বিকেল আড়াইটায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন বাজেটের রেকর্ড গড়া এই মন্ত্রী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ