দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন জীব। জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি এ দুটো মানুষের বিশেষ গুণ। তার একদিকে রয়েছে জীবদেহ, অন্যদিকে বুদ্ধি, মন বা আত্মা। পঞ্চেন্দ্রিয় ও ষড়রিপুর দ্বারা দেহ পরিচালিত। অপরদিকে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা মন পরিচালিত। দৈহিক বৃত্তি দুনিয়ায় ক্ষণস্থায়ী সুখ আনন্দের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করে। মন, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা দৈহিক বৃত্তিকে সংহত, সংযত ও সংবদ্ধ করে আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখ বা পরমানন্দের দিকে মানুষকে আকর্ষণ করে। এ দুয়ের টানাপোড়েনে মানুষ প্রায়শঃ বিভ্রান্ত হয়। পার্থিব সুখ আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। একে পরিহার করে পরকালে অদেখা অনাগত সুখের জন্য অপেক্ষা করাকে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর বলে অনেকে মনে করেন। দেহ ও মনের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতগত বৈষম্য। দেহ চায় মনের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে। মন দেহের যাবতীয় অশুভ প্রবৃত্তিকে কঠোর হস্তে দমন করে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। সিয়াম বা রোজা দেহ থেকে দেহাতীত, ইন্দ্রিয় থেকে অতীন্দ্রিয়, আত্মা থেকে পরমাত্মায় উত্তরণের সহায়তা করে।
মনীষী ইমাম গাজালী (রাহ.) রোজাকে সাধারণ শ্রেণী, মাধ্যম শ্রেণী ও উচ্চ শ্রেণী এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। উদর ও কামরিপু অবদমন ও নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে সাধারণ শ্রেণীর রোজা। সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও জৈবিক আচরণ থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে এই শ্রেণীর রোজা। সারাদিন নিজেকে অভুক্ত রেখে জঠর দমন ও ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ এবং কামনা বাসনা পরিবর্জন হচ্ছে এই শ্রেণীর রোজার অন্তর্গত। জঠর ও কামবৃত্তির উপর চাপ সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতার গুণ বিকাশ লাভ করে। অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসেবে মুসলমান নিষ্ঠার সঙ্গে এই রোজা পালন করে থাকেন। বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই আমরা তা পালন করে থাকি। এখানে বুদ্ধির প্রয়োগ অত্যন্ত কম। রোজার গুঢ় অর্থ, অন্তর্নিহিত ভাব এবং তাৎপর্য ঠিক এই স্তরে সঠিকভাবে ধরা পড়ে না। মধ্যম শ্রেণীর রোজার পর্যায়ে এসে আমরা রোজার উন্নত ও পরিণত রূপ লক্ষ্য করি। এখানে রোজার গভীর অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের কাছে ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই শ্রেণীর রোজা কেবল উদর ও কামরিপু দমনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এই রোজা দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গকেও গোনাহ হতে রক্ষা করে। এটা পঞ্চেন্দ্রিয় ও ষড়রিপুর উচ্ছৃঙ্খল ও অসংযত আচরণকে সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রণ করে। এই শ্রেণীর সিয়ামে মানুষের চিন্তা-চেতনার একাগ্রতা নিবদ্ধ হয় কেবল মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য বা সান্নিধ্যে। দেহবৃত্তির পরিশোধন ও পরিমার্জনে এবং আত্মার উন্নতি ও বিকাশ সাধনে মানুষ যাতে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, এই শ্রেণীর রোজা এই তাৎপর্য বহন করে। প্রকৃত পক্ষে, এই শ্রেণীর রোজা সৎ-লোকদের রোজা। অধিকাংশ লোক তাদের সৎ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের দ্বারা রোজার এই শ্রেণীতে উন্নীত হতে পারে। এরপর আসে উচ্চশ্রেণীর রোজা। পার্থিব চিন্তা-ভাবনা থেকে অর্থাৎ অন্যসব বস্তু থেকে এ ধরনের রোজা মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে। এই প্রকার রোজা পরকালে আল্লাহ এবং আখেরাত ব্যতীত অন্য চিন্তা অন্তরে স্থান পায় না। এই পর্যায়ে মানুষের হীন প্রবৃত্তি, পঞ্চেন্দ্রিয়ের অসংযত আচরণ এবং ষড়রিপু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও পর্যুদস্ত হয় এবং আত্মা দেহিবৃত্তির উপর আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তার করে। অন্যান্য যাবতীয় বস্তু থেকে মনকে সরিয়ে এক আল্লাহর উপর জীবনকে উৎসর্গ করাই হল এই শ্রেণীর রোজার লক্ষ্য। ‘লা শারিক আল্লাহর’ উপর মনকে পূর্ণরূপে সঁপে দেয়াই হচ্ছে এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এক কথায়, এই শ্রেণীর রোজা হচ্ছে আত্মিক রোজা, যা নবী-রাসুল, সিদ্দিক এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দ্বারাই অনুশীলিত হয়ে থাকে।
আমাদের সাদামাটা জীবনে রমজান আসে এক বৈচিত্র্য নিয়ে। রমজান একটি ব্যতিক্রমধর্মী মাস। আমাদের চলিত ও স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম সৃষ্টিকারী মাস। এই মাসে সকালের প্রাতঃরাশ হয় সন্ধ্যের ইফতার, মধ্যাহ্নভোজন হয় শেষ রাতের আহার আর সন্ধ্যা-ভোজন থাকে অপরিবর্তনীয়। এমনিতেই সারাদিনব্যাপী যে ছিটেফোঁটে খাবার আমরা খাই, তা যায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হয়ে। সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির থেকে বিরত থাকার নাম রমজান। এর স্থায়িত্বকাল একমাস। এই শারীরিক ও মানসিক ত্যাগের অন্তর্নিহিত অর্থ খালি চোখে ধরা না পড়লেও জ্ঞানানুরাগীদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষ স্বভাবত ইন্দ্রিয়পরায়ণ। পার্থিব জগত ও জড়ীয় বিষয় মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। দেহ জড় ও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আত্মা মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। প্রকোষ্ঠের তেজোদীপ্ত আলো যেমন চতুর্দেয়ালের জন্য মুক্তভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে না, আত্মাও ঠিক তেমনি দেহাবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য তার পূর্ণ স্বাধীনতা কাজে লাগাতে পারে না। রমজানের উপবাস শরীরকে নিস্তেজ করে দেহকে পরিশোধিত করে আত্মার সুষ্ঠু বিকাশ সাধনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। কেবল উপোস বা অভুক্ত থাকার অর্থ রমজান নয়। এর অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। রমজান মানুষকে বাধা-বন্ধহীন অবাধ গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। রমজান মাসে মানু্ষরে সার্বিক আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ও চলাফেরা হবে খুবই সংযত। দেহের প্রতিটি অংশ হবে সুনিয়ন্ত্রিত, ব্যতিক্রম মোটেই কাম্য নয়। দৃষ্টি আনত, রসনা সংযত, হস্ত দানে প্রসারিত, পদদ্বয় সরল পথে গমন এবং কর্ণ সুশ্রবণে লিপ্ত। এক কথায় সমগ্র দেহ থাকবে আত্মা বা মননের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। একমাত্র রমজান মাসেই আত্মা দেহের প্রতি অণু-পরমাণুর উপর তার প্রভুত্ব বিস্তার করে। এক মাসব্যাপী নিষ্ঠার সঙ্গে এর অনুশীলনের অর্থ হচ্ছে পরবর্তীতে মানুষ যেন এ গুণগুলো তার নিজের মধ্যে আয়ত্ত করে নিতে পারে, যার ফলে সৎ হয়ে চলা তার স্বভাব-ধর্ম বা অভ্যাসে পরিণত হয়। রমজানের পরিশোধিত দেহের সঙ্গে বিশুদ্ধ আত্মার সমন্বয় ঘটে। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।