দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রকৃত মু’মিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও সর্বাত্মকভাবে তাঁর আনুগত্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি এ ধারা অব্যাহত রাখে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: (হে নবী) ইয়াক্বীন (মৃতু) আসা পর্যন্ত আল্লাহর বন্দেগীতে অব্যাহত থাকুন। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশেষ বিশেষ কিছু সময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করে দান করেছেন, যাতে করে সে সময়গুলোতে একটু অতিরিক্ত নেক আমল করে আমাদের ছওয়াবের পরিমাণকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারি। নেকী অর্জনের এমনি ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম হচ্ছে রামাদ্বানুল মোবারক। এ গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমটি পদার্পণ করছে আমাদের দারপ্রান্তে। মহা সম্মানিত এ মেহমানকে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রিয় নবী (সাঃ) প্রায় দু’মাস পূর্ব থেকে এ মেহমানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিতেন। রজব মাস এলেই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকতেন: “হে আল্লাহ আমাদেরকে রজব ও শাবানের মধ্যে বরকত দান করুন, আর রামাদ্বান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।”-(তাবারানী)
জীবনে আরেকটি রামাদ্বান পাওয়া কতই না সৌভাগ্যের ব্যাপার। গত বছর অনেকে রামাদ্বানের আমাদের আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে রমাদ্বান রেখেছিলাম। আজ আমাদের মাঝে অনেকেই নেই। আগামী রমাদ্বান আমাদের পাওয়ার সুভাগ্য হবে কি? এটা আল্লাহই ভালো জানেন। আর যদি আল্লাহপাকের একান্ত দয়ায় পেয়ে যাই, তাহলে তার জন্য আমরা কি প্রস্তুতি গ্রহণ করছি? প্রিয় নবী (সাঃ) একবার শাবানের শেষ প্রান্তে এসে বিশেষভাবে সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রামাদ্বানের গুরুত্ব, ফযীলত ও আমল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন :
“হে জনতা! একটি পবিত্র মাস তোমাদের দ্বারপ্রান্তে সমাগত। এমন মাস যাতে রয়েছে লাইলাতুল ক্বাদর। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসটির দিনে রোযা রাখাকে আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন। আর রাতের বেলায় ইবাদত বন্দেগী করাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। কেউ এ মাসে যে কোন ভাল কাজ করলে তার সওয়াব হবে অন্য মাসের ফরযের সমান।আর একটি ফরয আঞ্জাম দিলে তার সওয়াব হবে অন্য মাসের ৭০টি ফরযের সওয়াব। এটি হচ্ছে সবরের মাস। আর সবরের পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত। এটি সমবেদনার মাস। এ মাসে রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। কেউ এ মাসে রোযাদারকে ইফতার করালে তা তার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়া ও জাহান্নাম থেকে তার গর্দান মুক্ত হওয়ার কারণ হয়েযাবে। এবং রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব হবে, তবে এতে রোযাদারের তার নিজের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাদের সবার যে রোযাদারকে ইফতার করানোর সক্ষমতা নেই। তিনি বললেন, এমন বিপুল সওয়াব সে ব্যক্তিকেও দান করা হবে, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে দুধ, খেজুর এমনকি শুধু পানি দিয়ে হলেও ইফতার আপ্যায়ন করাবে। যে ব্যক্তি তৃষ্ণার্ত রোযাদারকে ইফতারের সময় পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাওযে (কাওছার) থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর কোনদিন তৃষ্ণার্ত হবেনা। কেউ যদি এ মাসে তার ক্রীতদাস (এমনকি কর্মচারী/চাকর)-এর কাজ কমিয়ে দেয় আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেবেন। এ মাসের প্রথম হচ্ছে রহমত। মধ্যখানে রয়েছে মাগফিরাত। আর শেষ দিকে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এ মাসটিতে তোমরা ৪টি কাজে বেশি বেশি অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট হও। প্রথম দুটোর মাধ্যমে তোমাদের প্রভু সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। আর শেষ দুটো না করে তোমাদের কোন উপায় নেই। যে দু’অভ্যাস দিয়ে তোমাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে তা হচ্ছে ১. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহের সাক্ষ্য দেয়া আর ২. আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করতে থাকা। আর যে দুটো না করে তোমাদের কোন উপায় নেই তা হচ্ছে ৩. আল্লাহর কাছে জান্নাতের আবেদন করতে থাকা এবং ৪. জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইতে থাকা। (সাহাবী সালমানের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন বায়হাকী ও ইবনে খোযাইমা)
এমন মহান একটি মাস আমাদের দ্বারে সমাগত। এ মাসের অফুরন্ত ফায়দা নেয়ার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দুনিয়াবী ব্যস্ততা যতদূর পারা যায় কিছু কমিয়ে দিতে হবে। নবী কারীম (সাঃ) রামাদ্বান এলে প্রাত্যহিক সাংসারিক ও দুনিয়াবী ঝামেলা কমিয়ে দিতেন, যাতে বেশি বেশি করে ইবাদত করার সুযোগ পাওয়া যায়। সলফে সালেহীনও তা-ই করেছেন। ইমাম যুহরী (রঃ) বলেছেন, “রামাদ্বান আসা মানেই হলো বেশি বেশি তেলাওয়াতে কুরআন ও অন্যকে খাওয়ানোর প্রচেষ্টা।” অনেকেই মসজিদে বসে থাকতেন আর বলতেন, রোজাকে পাহারা দেই, বাইরে গিয়ে কারো গীবত চর্চায় ব্যস্ত হওয়া থেকে। রোযা আসলে আমরাও কিছুটা প্রস্তুতি নেই। তবে, আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। আমাদের অনেকেই দেখা যায়, রোযার প্রারম্ভে খাদ্য সম্ভারের সমাহারে ঘর ভর্তি করে নেয়া। এমনকি দোকানপাট পর্যন্ত খালি হয়ে যায়। সারা দিনের অভুক্ত থাকার বদলা নেয়ার জন্য ইফতারে রাতের বেলায় এবং সেহরীতে দ্বিগুণ তিনগুণ উদরস্থ করার মানসিকতা। রামাদ্বান এসেছে খাওয়া কমাতে, অথচ আমাদের কেনাকাটা দেখলে মনে হয় রামাদ্বান যেন এসেছে খাবার বাড়িয়ে দিতে। আর এ সুযোগে আমাদের দেশে তো ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গরীবের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করে দেয়। রামাদ্বান আসে মু’মিনকে ঘুমকমিয়ে সদা তৎপর হতে সাহায্য করতে। অথচ অনেকেই দিনের অর্ধবেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে অলসভাবে কাটিয়ে দেন। মূল্যবান সময়গুলো যদি ঘুমেই কেটে যায়, তাহলে কি পাবো রামাদ্বানের নেয়ামত থেকে। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।