Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রসিদ্ধ-অভিজাতের নামে কী খাচ্ছি?

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘চক চক করিলে সোনা হয় না’ বাংলা ব্যাকরণের এই ভাবসম্প্রসারণ স্কুল জীবনে পড়েননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুল জীবনে ওই ভাবসম্প্রসারণ যাপিত জীবনে কত বাস্তব এখন বোঝা যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকায় গড়ে উঠেছে নানান নামের চোখ ধাঁধাঁনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্র্যান্ডেড হাউজ, প্রসিদ্ধ কোম্পানী, বেকারী, বাহারী নামের আধুনিক দোকান, শপিং মল, মিষ্টি, খাদ্যের দোকান। নিত্যদিন টিভিতে বাহারী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বিশ্বমানের খাবার ও পণ্য’ দাবী করে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে; বিজ্ঞাপনের বাহার দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু বাহারী চকচকে নাম ও চাকচিক্য দেখিয়ে অধিকাংশ দোকানে যে নি¤œমানের খাবার, বেকারী সামগ্রী ও ভেজাল পণ্য বিক্রী করছে তা এখন হয়ে গেছে ওপেন সিক্রেট। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন, নোংরা পরিবেশে মানহীন, মানুষের খাবারের অনুপযোগী পণ্য তৈরি হচ্ছে; অন্যদিকে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নিত্যদিন টিভিতে চটকদার রংবেরংয়ের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। অভিজাত ‘দোকান-শপিং মল’ বেশির ভাগ পণ্য নি¤œমানের এবং বাসীপঁচা খাবারের পসরা ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে তা ধরা পড়েছে। খুলে গেছে তথাকথিত বিশ্বমানের অভিজাত পণ্য ও খাবার ব্রান্ডের ‘মুখোশ’।
বহুযুগ ধরে প্রিন্টেড মিডিয়ায় ছবিসহ খবর পড়তে দেশের মানুষ অভ্যস্ত। বিজ্ঞানের বদৌলতে কয়েক বছর ধরে ঢাকায় টিভি মিডিয়ার বিপ্লব ঘটায় এখন অনেক সচিত্র খবর দর্শকরা টিভিতে দেখছেন। ইদানিং বেসরকারি টিভিগুলোতে লাইভ (সরাসরি) খবর প্রচারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। লাইভ খবরে প্রায় প্রতিদিন দেখানো হচ্ছে মনকে মন সুসাধু মিষ্টি, মাছ-মাংসের তরকারি, গরু-খাসির গোশত, আস্ত মুরগি, সেমাই, রান্না করা তরকারি ড্রেনে ফেলে দেয়া হচ্ছে। নানা পদের মিষ্টি ও লোভনীয় খাবার ফেলে দেয়ার দৃশ্য দেখে জিভে পানি এসে যায়। আহা এই খাবারগুলো যদি পেতাম! রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই এ দৃশ্য টিভির খবরে দেখা যাচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতেও ভেজাল বিরোধী অভিযানের নিউজ ছাপা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো চড়া দামের লোভনীয় ধবধবে সাদা মিষ্টিগুলো ফেলে দেয়া হচ্ছে কেন? কারণ আর কিছুই নয় ‘ভেজাল’। চাকচিক্য ঠিক রেখে অধিক লাভের জন্য প্রসিদ্ধ নাম দিয়ে ভেজাল মিশ্রিত মিষ্টি বিক্রী করা হচ্ছে। এছাড়াও পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত বাসি খাবার নতুন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ওই সব খাদ্য মানুষের জন্য মূলত অখাদ্য। টিভি পর্দায় যেসব খাবার-মিষ্টি ড্রেনে ফেলে দেয়ার দৃশ্য দেখে জিভে পানি আসে; আসলে সেগুলো খাবার নামের ‘বিষ’। ফুটপাত ও ছোটখাটো দোকানে শুধু নয়; রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-বারীধারায় বাহারি নাম এবং মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চটকদার প্রচারণার নামীদামী হোটেল, রেস্তেঁরা, শপিং মলেও পচাঁ-নি¤œমানের খাবার বিক্রির চিত্র ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয় নামী দামী বিপণী বিতানের ভেজাল পণ্য কিনে ‘বিষ খেয়ে’ জীবনকে মানুষ ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দেশের নি¤œ শ্রমজীবী বস্তিবাসী থেকে শুরু করে অভিজাত পাড়ার এলিট শ্রেণী সবাই এখন ভেজাল খাবারের কবলে।
তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটেছে। শিক্ষিতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মানুষের আয়-উন্নতি ও যাপিত জীবনধারা। উপর তলার মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পেশাজীবী মানুষ ‘মান সম্পন্ন’ খাবারের প্রতি আগ্রহী। তারা দাম একটু বেশি দিয়ে হলেও মান সম্পন্ন খাবার ও পণ্য ক্রয় করতে চায়। এ সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী উন্নত দেশগুলোর মতোই বহুমুখি শপিং মল, চেইন শপ ইত্যাদি খুলেছেন। ওই সব মলে একসঙ্গে সব ধরণের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের ব্যস্ত জীবনে একই দোকানে সবগুলো পণ্য ক্রয় করার সুযোগ সুবিধার বটে। এক জায়গায় গাড়ী রেখে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে ঘরে ফিরছে মানুষ। মানুষের এই দুর্বলতা পুঁজি করে নামীদামী শপিং মল, চেইন শপ ও প্রসিদ্ধ দোকানগুলোয় পঁচা-বাসী-ভেজাল মিশ্রিত নি¤œমানের পণ্য বিক্রী করছে দেদারছে। ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমান আদালত সেগুলোই পাকড়াও করছে।
বিএসটিআই এবং ভোক্তা সংরক্ষণ আইন কেতাবে লেখা আছে। এগুলো ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন না করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের জন্য ভেজাল পণ্যে বিক্রির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আগে দু’চারটি পণ্যে ভেজাল মেশানো হতো বা প্রাণঘাতি ফরমালিন-র্কাবাইড মেশানো হতো। এখন প্রায় সব পণ্যেই ভেজাল মেশানো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মুখরোচক বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মিষ্টিসহ নানা বাহারী নামি-নামি বেকারিতে পণ্য স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজালমিশ্রিত ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরী নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এমনকি অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি প্রাণরক্ষাকারী ঔষুধেও ভেজাল মেশানো হয়। কয়েকদিন থেকে র‌্যাব, পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমান আদালত ঢাকার নামীদামি রেষ্টুরেন্ট, শপিং মল, মিষ্টির দোকানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান পঁচা-বাসী-মানহীন-নোংরা খাবার নষ্ট করেছে। পাশাপাশি অভিযুক্তদের কারো জরিমানা এবং কারো কারাদÐ দিয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালতের তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটদের সাহসিকতার তারিফ করতেই হয়।
‘এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ (হেলাল হাফিজ)। কবির এই কবিতার মতোই যৌবন বয়সে তরুণরা যুদ্ধে যেতে পারেন আবার দেশমার্তৃকায় সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। তরুণরা যে ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে দেশসেবা করতে পারেন তা ‘ভেজাল বিরোধী অভিযানে’ কয়েকজন তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাদের পর্বসুরী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ দৌলা কয়েক বছর আগে প্রভাবশালী অসৎ ব্যবসায়ীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভেজাল বিরোধী অভিযান চালিয়েছিলেন। সেই পথ অনুসরণ করে তরুণ ম্যাজেস্ট্রিটরা রমজান মাসে ভেজাল বিরোধী অভিযানে বিশ্বমানের পণ্যের দাবীদার দেশের নামিদামী প্রসিদ্ধ খাবার ‘কে এফ সি, আগোরা, মিনা বাজার, রস, ফখরুদ্দিনের বিরানী, কেএফসি রেস্টুরেন্ট, হাজী রেস্টুরেন্ট, বডি নাইন হাউজ, স্টিকস এন সুসি, চা টাইম, বাটলার চকলেট ক্যাফে, বনফুল, স্বপ্ন, লাবামমাসহ অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান-হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শপিং মলে অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাদ্য বিক্রি পাকড়াও করেছেন। কোথাও কোথাও অপরিস্কার জায়গায় খাবার তৈরির দৃশ্য দেখেছেন। ব্যবসায়িকভাবে প্রভাবশালী এবং উচুতলার ব্যাক্তিদের মালিকানার ব্র্যান্ডেড দোকানের পণ্য মানহীন এবং খাবারের অনুপযোগী ওইসব খাবার ভ্রাম্যমান আদালত ড্রেনে ফেলেছেন পাশাপাশি জরিমানা করেছেন। বিশ্বমানের প্রতিদ্ধ দোকান, নামী দামী শপিং মল, হোটেল, ব্র্যান্ডেড দোকান-বেকারীতে বাসিপঁচা খাবার বিক্রী করা হয়!
প্রশ্ন হচ্ছে, বিখ্যাত পণ্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি! একবারও কি কখনো ভেবে দেখেছি এতো নামিদামী খাদ্যপণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের সুস্বাধু খাদ্যের পরিবর্তে আমরা আসলেই কি খাচ্ছি। ফ্রেশ পণ্যের নামে আমরা দেহের ভেতর জন্ম দিচ্ছি নানান রকম রোগব্যাধি। র‌্যাব,পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনের অব্যাহত অভিযানেও থামছে না খাদ্যে ভেজাল ও বিষ মেশানোর প্রক্রিয়া। কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাসোহারায় এমন অপরাধ করে যাচ্ছে অসৎ ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কয়েকজন তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট যেভাবে ভেজালবিরোধী অভিযানে সাহসিকতা দেখাচ্ছেন; তাতে মনে হচ্ছে অভিযান অব্যাহত থাকলে ভেজাল পুরোপুরি বন্ধ না হলেও খাদ্যে ভেজালের পরিমান কমে আসবে। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, তরুণ-যুবকরা পারেন না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। আমাদের দেশের সরকারি চাকরিরত তরুণরা সেটা করে দেখাবেন সে প্রত্যাশা করছি।



 

Show all comments
  • আরজু ৬ জুন, ২০১৮, ২:৫০ এএম says : 0
    নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা দরকার
    Total Reply(0) Reply
  • ইমরান ৬ জুন, ২০১৮, ২:৫০ এএম says : 0
    খাদ্যে ভেজাল প্রদানকারীর ফাঁসির বিধান করা হোক
    Total Reply(0) Reply
  • রায়হান ৬ জুন, ২০১৮, ৩:২০ এএম says : 0
    ইয়াবা অভিযানের চেয়ে খাদ্যের ভেজাল ব্ন্ধ করা জরুরী। ১৭ কোটি মানুষের জীবন আজ বিপন্ন ভেজাল খাদ্যের কারণে।
    Total Reply(0) Reply
  • ZUBAER ৬ জুন, ২০১৮, ৬:১৮ এএম says : 0
    যদি মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকতো তাহলে মানুষ এই ধরনের অপরাধ করত না । তাই আসুন নিজেকে ও পরিবেশকে এই ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করি ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ