বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এম মাফতুন আহম্মেদ
পরাধীন ব্রিটিশ থেকে ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমল। দীর্ঘ এক পথ-পরিক্রমা। এ সময়ে রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য জগতে যারা ছিলেন পথিকৃৎ তারা দেশ বা জাতির স্বার্থে অভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন। যদিও ওই সময়কার নেতৃবৃন্দের আদর্শিক পথ বা চেতনা ছিল ভিন্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের জনগণের প্রশ্নে তারা ছিলেন অভিন্ন।
কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, কাঙাল হরিণাথ মজুমদার, বারীন্দ্র ঘোষ, মাওলানা আকরাম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, মাওলানা মুজিবর রহমান, আবুল মুনসুর আহম্মদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখরা ছিলেন এই উপমহাদেশে বাংলা সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল। এসব ব্যক্তি একাধারে দার্শনিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। তারা ছিলেন শতভাগ দেশপ্রেমিক। তারা দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে ব্রত ছিলেন। তারা অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। আমজনতার রাজত্ব কায়েমে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। অবশেষে জনগণের অধিকার বাস্তবায়ন করেছেন। এখন স্বাধীন দেশে নির্ভীক সম্পাদক বা সৎ সাংবাদিকের আকাল দেখা দিয়েছে, এ কথা বলি না। তবে সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়। যা কোনো আলোচনার পর্যায়ে আসে না।
এখন প্রশ্ন বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেবীরা কী পথ হারিয়েছেন? নানাজনের নানা মত। কেউ বলেন, ঠিক পথ হারাননি; গতি হারিয়েছেন। মূল শিকড় থেকে দূরে সরে গেছেন। অনেকে দাস সাংবাদিকতায় নাম লিখিয়েছেন। সস্তা কিছু প্রাপ্তির আশায় রাজনীতির রঙ্গালয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তবে সব যে একই পথের পথিক তা কিন্তু নয়। আসলে সংবাদপত্র অন্য দশটি ব্যবসার মতো কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। শুধুমাত্র মুনাফা লাভই তার উদ্দেশ্য নয়। এক সময় সংবাদপত্র কোনো রাজনৈতিক আদর্শের অনুরাগী হলেও গণমানুষের স্থান ছিল সবার আগে। গণমানুষের অধিকার আদায়ে প্রাধান্যতা ছিল বেশি। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্টরা দেশ-জাতির স্বপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতেন।
প্রতিটি সংবাদপত্রের স্বাধীন নীতিমালা থাকে। আদর্শ থাকে। সম্পাদকীয় রীতিনীতি থাকে। তবে সব রীতিনীতি এবং আদর্শের মর্মমূলে অবস্থান করে গণমানুষের অধিকারের কথা। জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা। সম্পাদক অন্য দশজনের মতো একজন মানুষ। তাই তার মানবীয় গুণাবলী রয়েছে। দায়িত্ববোধ রয়েছে। জাতির কাছে, দেশের কাছে একরাশ দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ কথা সত্য যে, রাজনীতির বাইরে এদেশে কিছুই ভাবা যায় না। তাই রাজনীতির বাইরে থেকে সাংবাদিকতা করা সহজ নয়। একজন সম্পাদক বা সাংবাদিক তিনি যে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের দর্শনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে¡ অবস্থান করতে পারেন। একজন রাজনীতিক আর সাংবাদিকের মধ্যে রয়েছে হরিহর আত্মা। একই আত্মার আত্মীয়। এক কথায় রাজনীতিক আর সাংবাদিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই বলে একজন রাজনীতিক সম্পাদক বা সাংবাদিক হলেই অন্য কোনো মত-পথের সংবাদ পরিবেশনে কী কোনো বাধা আছে? রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে একতরফা প্রতিবেদন বা সংবাদ লিখলে তা হবে অন্যায়।
বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। ইন্টারনেট নিমিষেই সবকিছু দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে। কিছু দিন আগে কয়েকটি সংবাদপত্রে একটি সম্পাদকীয় কলাম পাঠিয়েছিলাম। কলামটিতে অপ্রিয় হলেও অনেক তথ্যনির্ভর সত্য কথা তুলে ধরেছিলাম। দুর্ভাগ্য! নানা পত্রিকার নানা মত। যারা নিরপেক্ষ তাদের হয় নানা মছিবত। একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বরত বিনয়ের সাথে বললেন বর্তমান সময়টা ভালো না, একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লিখবেন। আর একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের ইনচার্জ বলেন, স্যারের (সম্পাদক) অনুমতি ছাড়া কোনো সম্পাদকীয় কলাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
উপরোক্ত কথাগুলো এ কারণে বললাম যে, কোনো একটি লেখা সরকার বা বিরোধী দলের পক্ষে যেতে পারে, নাও পারে। তবে লেখাটি তথ্যনির্ভর হতে হবে। গঠনমূলক ভূমিকা থাকতে হবে। দেশ-জাতির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডান-বামে না তাকিয়ে সত্য প্রকাশে নির্ভীক হতে বাধা কোথায়? যে লেখার কোনো গুরুত্ব নেই, দেশ-জাতির কোনো উপকারে আসে না অর্থাৎ অন্তঃসারশূন্য, বিজ্ঞাপন কানায় কানায় পরিপূর্ণ, মোসাহেবিতে অভ্যস্ত; সেসব চাটুকারি লেখায় পত্রিকার পাতা ভরে লাভ কী? সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। জনগণের অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় লিখতে বা প্রকাশে যদি এতই ভীতি কাজ করে তাহলে সংবাদপত্র প্রকাশের কী প্রয়োজনীতা আছে? কর্তৃপক্ষের উচিত এ ধরনের পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া। আর বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে পত্রিকা বের না করে অন্য কোনো ব্যবসা করলে দ্বিগুণ অর্থ রোজগার করা যায়। এখানে মেধা অপচয় করে সময়ক্ষেপণের কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না।
এদেশের সংবাদপত্রের যারা পথিকৃৎ ছিলেন তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। তারা কেমনভাবে সংবাদপত্র বের করতেন আর আমরা হাল জামানায় কেমনভাবে সংবাদপত্র প্রকাশ করছি। এক সময় বলা হতো, ভালো সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। বর্তমানে কথাটি একেবারে অচল। এখন সাংবাদিকদের বন্ধু বেশি। কারণ এ পেশায় এক সময় ঝুঁকি নিতে হতো। প্রতিযোগিতার মাঠে অবতীর্ণ হতে হতো। এখন সেই রামও নেই অযোধ্যও নেই। এখন সস্তা কথা বলে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত। অনেক পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বলে, সরকার অলিখিতভাবে খড়গ উঁচিয়ে রেখেছে। তাই সব সংবাদ প্রকাশ করা যায় না। তবে এটা সত্য যে, বর্তমানে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বিরাজমান। রাষ্ট্রের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বুঝতে পেরে অনেকে ঝামেলাহীন সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে ভালো সংবাদ অন্ধকারে থেকে যায়। কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য; তবে-সরকার তথ্যনির্ভর বা গঠনমূলক সংবাদ পরিবেশনে কী কোনো বাধা দিয়েছে? হয়রানি করার কী কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? আমরা দলবাজি, দাসবাজি সাংবাদিকতায় এত জড়িয়ে পড়েছি যে, পথ ভুলে অন্ধ গলিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। সাদাকে সাদা বলতে পারছি না। রাজনীতির চোরা গলিতে সংবাদপত্র ডুবে আছে। তাই এমন দলবাজি-দলদাসী মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে যে, তথ্যনির্ভর কোনো সংবাদ বা কলাম ছাপা সম্ভব নয়। তখন পত্রিকা অফিস থেকে বলা হয়, প্রকাশে অনেক ঝুঁকি আছে। ঝামেলা আছে। বাধা আছে। অথচ এসব সংবাদ বা কলামে থাকে ১৬ কোটি জনতার কথা। দেশের কথা। একটি জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনার নানা জ্ঞানগর্ভ কথা।
একটি ভালো মানের পত্রিকার কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে না। কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, সরকার বা বিদেশি রাষ্ট্র বা তাদের কোনো এজেন্টদের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র দেশ-জনগণের কাছে। কিন্তু আমাদের দেশে হিতে বিপরীত। এখানে অধিকাংশ সম্পাদক-সাংবাদিক ম্যানেজড মিডিয়ার সাথে জড়িত। তাই এদের এত জুজুর ভয়। কারণ পেশাধারী সম্পাদক-সাংবাদিক এখন কোথায়? আছে; আবার নেই বললে চলে। বাংলাদেশের প্রিন্টিং এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে যা কিছু আছে, তার সবটুকুর মালিক এখন কারা? মিডিয়ার মালিক বলতে সরকার প্রধান, কতিপয় মন্ত্রী, রাজনৈতিক দল, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বহুজাতিক কোম্পানি। জনগণ তাদের কাছে কোনো মুখ্য নয়। ব্যবসা বা স্বার্থ সিদ্ধিই তাদের একমাত্র মোক্ষম উদ্দেশ্য। ক’জন পেশাধারী সম্পাদক বা সাংবাদিক এই পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন। এক কথায় ব্যবসায়ীরা এই পেশাকে ঘিরে ফেলেছেন। তারা চ্যান্স সম্পাদক-সাংবাদিক সেজেছেন। উদ্দেশ্য সম্পাদক বা সাংবাদিকের তকমা গায়ে লাগিয়ে টু-পাইচ কামানো। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ‘অর্ধসত্য’ নামে রচিত এক গ্রন্থে লিখেছেন ‘মিডিয়ায় পাখি নেই, মশারাই খ্যাতির শিখরে’। এই মশাদের কাছে আদর্শ বড় কথা নয়, কিছু নগদ নারায়ণ হলে যথেষ্ট। তাই তারা মানসিকভাবে দুর্বল। আর এই দুর্বলতার কারণে সমাজ নানা জুজুর ভয়ে আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত।
এ কথা সত্য ‘ভক্তিতে মুক্তি’। তবে কোনো কাজে অতি ভক্তি ভালো লক্ষণ নয়। অতি ভক্তির নামে কুটিল রাজনীতির কাছে গণমাধ্যমের পরাজয় মানে জনগণের পরাজয়। জনগণের পরাজয় মানে রাষ্ট্রের পরাজয়। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে কোনো অজুহাত নয়। একপেশে, দলবাজি সাংবাদিকতা নয়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নয়, গণমানুষের মনের কথা পত্রিকার পাতায় পাতায় তুলে ধরতে হবে। যতই অলিখিত সরকারি কালাকানুন থাকুক না কেন গণমানুষের কথা বলতে কোনো বাধা নেই। আর গণমানুষের কথা বলতে গিয়ে কোনো সংবাদপত্র বন্ধ হলে বা রোষানলে পড়লে ইতিহাসের পাতায় তিনি হবেন জাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির একজন। জনগণ দাস সাংবাদিকতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তাদের অ-আদর্শকে নিন্দা করে। তাই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সম্পাদক-সাংবাদিককে নির্ভীক, নির্লোভ ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবাদপত্র জাতির দর্পণ শুধু কাগজ-কলমে নয়, বক্তৃতা-ভাষণে নয়; জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতির মোহমুক্ত হয়ে সাংবাদিকতা করতে পারলেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপ থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। স্মরণ রাখা উচিত, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত কোনো কথা সৃষ্টিকর্তার মুখ থেকে আশ্রিত এক প্রকার বাণী। জনগণের অধিকারের কথা, দেশের কথা সর্বাগ্রে পত্রিকার পাতায় স্থান দেয়া উচিত। তখন বলা যাবে সংবাদপত্র গণমানুষের অধিকারের কথা বলে। মজলুমের পক্ষে নির্ভীক ভূমিকা পালন করে।
লেখক : আইনজীবী ও খুলনা থেকে প্রকাশিত আজাদ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।