বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী শক্তির ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ জাতীয়তাবাদী শক্তি ইংরেজদের হটিয়ে উপমহাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে কায়েম করেছে বাংলাদেশ; ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লব ঘটিয়ে সুদৃঢ় করেছে স্বাধীনতার ভিত্তি ও জাতীয় সংহতি। কিন্তু বর্তমান সময়ে পদে পদে জাতীয়তাবাদী শক্তি নজিরবিহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, হারাচ্ছে তাদের অমূল্য সংগঠকদের। দীর্ঘ দিন ধরে ইলিয়াছের কোনো খবর নেই, খবর নেই চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য সাহসী সংগঠকের, জেলের ভেতর মারা গেলেন নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টু। প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কত সংগঠক হারাবে জাতীয়তাবাদী শক্তি? বাংলাদেশের রাজনীতির চালকের শক্তি হয়েও কেন জাতীয়তাবাদী শক্তি আজ পদে পদে ব্যর্থ হচ্ছে? এর কারণ অনুসন্ধান কী জরুরি নয়? আমার কাছে মনে হয়, সব কিছুর আগে এই জায়গাতেই বিএনপির হাত দেয়া উচিত।
জাতীয়তাবাদী শক্তি আজ বিভক্ত, বিভাজিত ও আদর্শচ্যুত। তাদের মধ্যে নেই কোনো প্রতিবাদী স্পৃহা। জাতীয়তাবাদী শক্তির সিংহভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে ইসলামী শক্তি। তাছাড়া আরও ছোট ছোট ইসলামী দল ও সংগঠন তৈরি হয়েছে, চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের কোনো ভূমিকা নেই বা ভূমিকা রাখতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি; যার জন্য অসংখ্য মানুষের জীবন গেলেও কোনো সফলতার মুখ দেখা যায়নি। তাছাড়া জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক ও বাহক বিএনপির অভ্যন্তরেও একটা রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। বেরিয়ে গেছেন বি. চৌধুরী, কর্নেল অলিসহ আরও বহু তারকা ও ক্লিন ইমেজের নেতা ও সংগঠক। অন্যদিকে সংস্কারপন্থি নামে একটি বিরাট অংশও বিএনপির রাজনীতি থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। বিএনপি তাদের মূল স্রোতের সঙ্গে মেলাতে পারেনি। অর্থাৎ বিএনপির শক্তি শুধু ক্ষয়ই হয়েছে, রক্তক্ষরণ হতে হতে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক ভিত। অন্যদিকে বিএনপির ভ্যানগার্ড বলে খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জায়গা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ আরও ছোট-বড় অসংখ্য ইসলামী ছাত্র সংগঠন। তাদের মধ্যে বিভক্তি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই বিভক্ত, নড়বড়ে ও দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি নিয়েই, আওয়ামী লীগের মতো শক্তির সাথে বিএনপি নেমেছে রাজপথের অলআউট আন্দোলনে। ফল যা হওয়ার কার্যত তাই হয়েছে, আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এই বাস্তবতা বিএনপিকে নামতে হবে। নতুন করে পথ চলতে হলে, বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে। লোক দেখানো নয়, সাংগঠনিক শক্তি সুদৃঢ় করার বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ঐক্যে যে সফলতা আসে তার সুস্পষ্ট উদাহরণ ঢাকা বার, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সারা বাংলাদেশের আইনজীবী সমিতির নির্বাচন। এখানে ঐক্য ছিলÑএসেছে সফলতা। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগে এখন কোনো বড় ধরনের বিভক্তি নেই; এক সময়ের জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম দলগুলো আওয়ামী রাজনীতির সাথে একাকার হয়ে গেছে। তারা এখন একক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে আদর্শগত কোনো বিভক্তি-বিভাজন নেই। তাদের সাথে লড়তে হলে, সুদৃঢ় সাংগঠনিক ভিত ও ইস্পাত কঠিন ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
আন্দোলন ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিএনপি কার্যত একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তাদের অনেক কাজ করতে হবে এবং অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, রাজনীতিতে শুধু আওয়ামী লীগ ও তাদের সাংগঠনিক শক্তিই বিএনপির প্রতিপক্ষ নয়। প্রতিপক্ষ কিছু দলবাজ পুলিশও। এই দলবাজ পুলিশের সহায়তা ছাড়া শাসকদলের ক্ষমতায় থাকা কঠিন। কাজেই এসব নিয়েও বিএনপিকে ভাবতে হবে, তারপর মাঠে নামতে হবে; তাহলেই কামিয়াব হওয়া যাবে, বিজয় ঘরে আসবে।
একটি দিক অত্যন্ত স্পষ্ট, জনগণ বিএনপির সাথে আছে। বেগম খালেদা জিয়া যখনই আহ্বান জানিয়েছেন, তার ডাকে জনগণ সারা দিয়েছে। তিনি যেখানেই রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গেছেন, সেখানেই জনতার স্রোত উপচে পড়েছে; তার জনসভা কার্যত জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে, শাসকগোষ্ঠী ভীতু হয়ে তার গতি রোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয় সব মেশিনারি ব্যবহার করেছে এবং করছে। কাজেই জনগণ যে বিএনপির সঙ্গে আছেÑএটি নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। দ্বিমত আছে আদর্শচ্যুতি, অনৈক্য ও সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে। দ্বিমত আছে টাকার বিনিময়ে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি বিক্রি হওয়া নিয়েও, ঠিক এই জায়গাতেই বিএনপিকে হাত দিতে হবে। সংগঠনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে, ত্যাগী নেতাকর্মীদের খুঁজে বের করে যথাযথ মূল্যায়ণ করতে হবে এবং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়Ñএমন বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রাজধানী ঢাকাতে ক্লিন ইমেজের অধিকারী এমন কয়েকজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। বিগত সিটি নির্বাচন থেকে যেসব মুখ বেড়িয়ে এসেছে, তাদের কাজে লাগিয়ে বিএনপি উপকৃত হতে পারে। এমন আরও যারা আছেন, তাদেরও লাইমলাইটে আনতে হবে। দল বাঁচিয়ে রাখতে হলে, বিএনপিকে এসব কাজ অবশ্যই করতে হবে; এখানে কোনো রকম শৈথিল্য, আবেগ ও হঠকারিতার সুযোগ নেই।
লক্ষণীয় যে, বিএনপিতে আদর্শচ্যুতির দিকটি খুবই স্পষ্ট, এটি সবার চোখেই ধরা পড়েছে; এমনকি অতি সাধারণ মানুষের চোখেও! এ নিয়ে মানুষের প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হয়! অথচ বিএনপি সুস্পষ্ট আদর্শ ও চেতনা নির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিএনপির ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ সুস্পষ্ট একটি আদর্শ, এটি এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে; এটি উচ্চ আদলত কর্তৃক স্বীকৃত। কেননা নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনা মিশ্র স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ, ভাষা, ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি-অর্থনীতি এক বাক্যে বলা যায়, জীবনের পরিপূরক প্রতিটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে অটল-অবিচল রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে এটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য যে মেশিনারির প্রয়োজন-সম্ভব হয়নি তারও বিকাশ ঘটানোর। এই সীমাবদ্ধতাটুকু স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়। আজকের প্রজন্ম বিএনপিকে সেভাবে চেনে না।
বিএনপি যে একটি আদর্শ, একটি চেতনাÑএটা বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও জানেন না। ফলে প্রতিবাদী কোনো স্পৃহা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রাজনীতি করতে হলে এবং কামিয়াব হতে হলে, এই জায়গাতেই বিএনপিকে ফিরে আসতে হবে; দলের প্রতিটি কর্মকা-ের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দর্শন, যা এ দেশের মানুষ মনে-প্রাণে পছন্দ করে। কেননা এটি ধর্মান্ধও নয় আবার ধর্মহীনও নয়, সব ধর্ম, ভাষা ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের স্বীকৃতি রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। এই সুস্পষ্ট চেতনার মাধ্যমে সব ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। তৈরি করা যায় মানুষের মনে প্রতিবাদী স্পৃহা, যা আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য অপরিহার্য। প্রতিবাদী স্পৃহা ছাড়া কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না।
পরিশেষে বলতে চাই, বিএনপি কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে; এই কাউন্সিলে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে একটি উদ্যম তৈরি হয়েছে। এই উদ্যম কাজে লাগাতে হলে সাংগঠনিক চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। সভা, সেমিনার, গণমিছিল, মানববন্ধন অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে জনগণ সম্পৃক্ত হয় এমন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। জনগণের কাজে বিএনপি যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে বিএনপির ডাকে কেন সাড়া দেবে তারা? দেশে ইস্যুর পর ইস্যু যাচ্ছে কিন্তু বিএনপির কোনো সাড়া নেই। এমনকি রাজপথে একটি বিক্ষোভ মিছিল পর্যন্ত বিএনপি করেনি। এসব তো জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। জনগণ বলাবলি করছে- বিএনপি কোথায়, রাষ্ট্রীয় তহবিল লুটের ঘটনা ঘটছেÑবিএনপির কোনো সাড়া নেই! এর প্রতিবাদে রাস্তায় একটি বিক্ষোভ মিছিল পর্যন্ত বিএনপি করেনি। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমছেÑঅথচ দেশে কমছে না। এটি নিয়ে বিএনপি সোচ্চার হতে পারে। তৈরি করতে পারে নেতাকর্মীদের মাঝে প্রতিবাদী স্পৃহা, যা রাজনৈতিক দলের জন্য অপরিহার্য। কেননা প্রতিবাদী স্পৃহা ছাড়া কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে, আগে চেতনা জাগ্রত করতে; হুজুগে কাজ হবে না। অপশক্তির কালো হাত বাংলাদেশকে আষ্ঠে-পিষ্টে বেঁধে ফেলেছে। এই কালো হাত ভাঙতে হলে বা অপসারিত করতে হলে, সুস্পষ্ট চেতনা ও আদর্শনির্ভর রাজনীতি দিয়েই করতে হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।