Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৫ অক্টােবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

আউলিয়াদের জীবন - আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)

প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইমরান হুসাইন (তুষার)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাংলাদেশে যখন প্রাতিষ্ঠনিকভাবে সুন্নিয়তের আওয়াজ তোলা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) সুন্নিয়তের এই অপরিহার্য কাজটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ছুটেছেন বাংলাদেশের প্রতি গ্রাম, শহর, বন্দরে অর্থাৎ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পথুরিয়া পর্যন্ত। শুধু তাতেই তিনি থেমে থাকেননি, ১৯৮৩ সালে তিনি সুন্নিয়তের সাংগঠনিক কর্যক্রম সূচনাস্বরূপ “আঞ্জুমানে আশেকানে মোস্তফা” প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে নবী প্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে ধর্মীয়, সামাজিক ও মানব কল্যাণকর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় এবং ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন বানভাসী ও অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে। দেশব্যাপী সুন্নি ওলামা-পীর মাশায়েখদেরকে সুসংগঠিত করে সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশের সুন্নি জনতা, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখগণকে রাজধানীমুখী করে তোলেন।
কারণ তিনি এটা জানতেন যে, কোনো আন্দোলনকে সফল করতে হলে তা করতে হবে রাজধানীকেন্দ্রিক। তাই তিনি রাজধানীভিত্তিক সুন্নি আন্দোলনকে বেশি প্রাধান্য দিতেন বলেই অন্যান্য অঞ্চল থেকে লোকজন রাজধানীর দিকে তার নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন। এ জন্য এই আন্দোলনের পরিধি বা তৎপরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। আর এ সবকিছুর পেছনে ছিল আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর এশকে রাসূল (সা.) ও সাংগঠনিক প্রজ্ঞা। তিনি ১৯৯২ সালে ঢাকায় আয়োজন করেন বিশ্ব সুন্নি মহাসম্মেলন। আর এটাই ছিল ঢাকায় সর্বপ্রথম বৃহত্তর সফল আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যা আজো হয়ে আছে সুন্নি আন্দোলনের অনুপ্রেরণার পাথেয়।
আশির দশকের শুরুতেই রাজধানীতে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন উপলক্ষে আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র নির্দেশক্রমে ও আঞ্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদীয়া সুন্নিয়ার উদ্যোগে ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুস আয়োজন করা হয় এবং ওই দশকের শেষ দিকে তারিখ পরিবর্তন করে ৯ রবিউল আউয়াল করা হয়। ফলে রাজধানীতে ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুস না হওয়ার কারণে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল তা পূরণে এগিয়ে আসেন আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)। তিনি বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও আঞ্জুমানে আশেকানে মোস্তফার যৌথ উদ্যোগে প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল রাজধানীতে পবিত্র জশনে জুলুস পালন করেন। তার এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের প্রায় সব দরবার শরিফ এবং সংগঠন জুলুস পালন করতে এগিয়ে আসে। যা আজ বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেছে। আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর কণ্ঠ ছিল সুমধুর এবং তার ওয়াজ সবাইকে আকর্ষণ করত। তিনি সব সময় যুক্তিপূর্ণ, তথ্যনির্ভর বক্তব্য পেশ করতেন। তার ওয়াজ ছিল মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রতি তাকওয়া, নবীপ্রেম সৃষ্টি ও পরিবর্তনের জন্য। হুজুরের ওয়াজ শোনার পর অনেকেই তওবাহ করে সৎ পথে ফিরে এসেছেন এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। অনেক আলেম-উলামা তার ওয়াজ শুনে মুগ্ধ হতেন। একবার তিনি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার শোল্লা গ্রামে ওয়াজ করার সময় বলে ওঠেন হে আমার যুবক ভাইয়েরা, যাদের দিলে আমার নবীর প্রেম বিদ্যমান, তারা আজকে থেকে ওয়াদা করেন জীবনে আর কোনো দিন দাড়ি ফেলবেন না। ঠিক সেই সময় উপস্থিত বিশ/ত্রিশ জন যুবক দাঁড়িয়ে ওয়াদা করেন। প্রতি শুক্রবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য লোক জমায়েত হতো তার ওয়াজ শোনার জন্য। তার অনেক ওয়াজের ক্যাসেট রয়েছে। তার মধ্যে শোহাদায়ে কারবালা চার খ-ে বের হয়। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে তা আজ বিলুপ্ত। আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর শোহাদায়ে কারবালার ওয়াজটি ছিল বাংলাদেশের বুকে অদ্বিতীয়। তার ওয়াজ শোনার পর রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতের মহব্বতে চোখের পানি ফেলেনি এমন একটি মানুষও পাওয়া যাবে না। শুধু তিনি অন্যকেই কাঁদাতেন না, রাসূল (সা.)-এর মুহাব্বতে তিনিও অঝোর নয়নে কাঁদতেন। ইসলাম ও সুন্নিয়তের বিভিন্নœ বিষয়ে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে গেছেন। এ ছাড়াও তিনি আঞ্জুমানে আশেকানে মোস্তফা (সা.) গঠনের পর প্রকাশনার দিকে বিশেষ নজর দেন। যখন এ দেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বাতিল ফেরকাদের ভ্রান্তির বিদ্যাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল, ঠিক তখনই তাদেরকে উদ্ধারের জন্য আঞ্জুমানে আশেকান মোস্তফার উদ্যোগে ‘মাসিক সোনার মদিনা’ নামক সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন, যার মাধ্যমে নবী প্রেমিকদের মনের খোরাক জুগিয়েছিলেন।
সারাদেশে যখন বাতিল ফেরকারা ব্যাঙের ছাতার মতো করে মাদরাসা করা শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময় তিনি ‘সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক ইসলামী শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ হিসেবে শিশু-কিশোরদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে’ ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের উত্তরে খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন উত্তর শাহজাহানপুরস্থ রেলওয়ে কলোনিতে ১৯৯২ সালে ‘রেলওয়ে হাফেজিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা’ গড়ে তোলেন। তিনি মাদরাসাকে অনেক ভালোবাসতেন এবং প্রায় বলতেন যারা এই মাদরাসাকে আঁকড়ে ধরবে তারা হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকার মতো পার হয়ে যাবে। আর যারা এই মাদরাসাকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। কেননা আমি এই মাদরাসার জিম্মাদারি আল্লাহর হাবিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) নিকট রেখেছি। মাদরাসার সেক্রেটারি আলহাজ এমএ খালেক সাহেব বলেন-আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) এই মাদরাসা ছাড়া কিছু বুঝতেন না। আর মাদরাসার সাফল্যে তিনি এত বেশি খুশি হতেন যে, তাকে আমি অন্য কোনো সাফল্যের ক্ষেত্রে এত বেশি খুশি হতে দেখিনি। আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) সুন্নিদের নিজস্ব একটি মিডিয়া পল্লীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন সব সময়। তাই তিনি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেই সন্তুষ্ট হননি। কেননা দেশে তখন সুন্নিদের অনেক সাময়িক পত্রিকা থাকলেও কোনো জাতীয় সাপ্তাহিক ছিল না। তাই তার বড় ছেলে পীরজাদা খাজা আরিফুর রহমান তাহেরীকে প্রকাশক ও স. উ. ম. আব্দুস সামাদ সাহেবকে সম্পাদক করে ‘সাপ্তাহিক মাতৃদেশ’ নামক পত্রিকার ডিক্লারেশনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যা ছিল তার পক্ষে অতি সাহসী একটি পদক্ষেপ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়নি। তাই আমি তার অসংখ্য গুণগ্রাহী, ভক্তবৃন্দকে উদাত্ত আহ্বান জানাই তার এই প্রত্যাশাকে পূরণের জন্য। যার মাধ্যমে তার আত্মার প্রশান্তি মিলবে বলে আশা করি। একজন যোগ্যতম অভিভাবক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকা-ে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। এদেশে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একমাত্র ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সাথে তার সম্পর্ক ছিল অতি গভীরতম। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার জন্মলগ্ন থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। ইসলামী ছাত্রসেনার নেতাকর্মীদের তিনি অত্যন্ত ¯েœহ করতেন এবং ভালোবাসতেন। যার অন্যতম সাক্ষী আলহাজ আল্লামা স.উ.ম. আবদুস সামাদ সাহেব নিজেই। ১৯৯০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকার এই সংগঠনের ব্যাপকতা লাভ করে। আর এই সম্মেলন হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর। যখন এই সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয় তখন তিনি সাথে সাথে নিজে ত্রিশ হাজার টাকা প্রদান করেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনাকে ভালোবেসে সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাতিল ফেরকাহর বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাহফিলে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বপক্ষে বজ্রকণ্ঠে বক্তব্য রাখছিলেন। ঠিক সেই সময় ওহাবী মওদুদী আক্বিদাপুষ্ট একদল সন্ত্রাসী হুজুরকে আঘাত করার জন্য এগিয়ে যান তার দিকে। তখন ইসলামী ছাত্রসেনার তৎকালীন সভাপতি স উ ম আবদুস সামাদ সাহেবসহ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ ঘটনায় তিনি একটুও বিচলিত হননি বরং তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওয়াজ করতে ছিলেন। এমন সাহসী ও নির্ভীক আলেম খুব কমই দেখা যায়। আরেকবার এক অনুষ্ঠানের দাওয়াতে তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বর্তমান নির্বাহী মহাসচিব মাওলানা মাসউদ হোসাইন আল-কাদেরীকে সাথে নিয়ে সেনাকল্যাণ ভবনে যান। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আউলিয়াদের জীবন - আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ