Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কর্মক্ষেত্রে উপেক্ষিত শ্রমিকের নিরাপত্তা

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত ৪১৫৫, আহত ৭১১২ জন শ্রমিক
২০১৭ সালে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ৭৪৮, আহত ৫১৭ জন
হাসান সোহেল : দেশে গত পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছে চার হাজার ১৫৫ জন শ্রমিক, আর আহত হয়েছে সাত হাজার ১১২ জন। এর মধ্যে গতবছর কর্মক্ষেত্রে ৭৪৮ জন শ্রমিক নিহত ও ৫১৭ জন আহত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রানা প্লাজা ধস আর তাজরীন ফ্যাশন্সে অগ্নিকাÐের ঘটনা এর বড় প্রমাণ। এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা চরমভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত। শ্রমিক-অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অন্যতম; যদিও সস্তা শ্রমের ওপর ভর করে এ দেশে গড়ে উঠছে পোশাক শিল্প।
সদ্য শেষ করা এক গবেষণায় এমন তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। গবেষণায় আরো উঠে আসে, ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয় ৬৯৯ জন এবং আহত ৭০৩ জন; ২০১৫ সালে নিহত ৩৬৩ জন আর আহতের সংখ্যা ৩৮২ জন। ২০১৪ সালে নিহত হয় ৬০৩ জন আর আহত ৬৮৫ জন এবং ২০১৩ সালে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৭০৬ জন ও আহত শ্রমিকের সংখ্যা ৪ হাজার ৮২৫ জন। নিহত ৭৮৪ শ্রমিকের মধ্যে ২১ জন নারী।
বিলস’র তথ্য অনুযায়ী, পরিবহনখাতে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৩০৭ জন শ্রমিক মারা যায়। এছাড়া নির্মাণ খাতে মৃত্যের সংখ্যা ১৩১ জন। অন্যদিকে দিনমজুর ৫৫ জন, কৃষিশ্রমিক ৩৪ জন, ইলেক্ট্রিশিয়ান ২৪ জন, জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ২১ জন, পাথর উত্তোলনে ২১ জন, চাল কলে ২০ জন, মৎস শ্রমিক ১৭ জন এবং গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করতে গিয়ে ১৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। পাশাপাশি আহত ৫১৭ জন শ্রমিকের মধ্যে সর্বোচ্চ গার্মেন্টস শিল্পে ১৫৮ জন, নির্মাণ কাজে ৯২ জন, দিনমজুর কাজে ৫৪ জন ও পরিবহন খাতে ৪৮ জন শ্রমিক আহত হয়েছে।
ক্রমেই বেপরোয়া হচ্ছে নির্মাণখাত। তদারকির অভাবে বাড়ছে মৃত্যু। ২০১৭ সালে এইখাতে মারা যায় ১৩৪ জন শ্রমিক, আর আহত হয় ৯২ জন। ২০১৬ তে মারা যায় ৮৫ জন, ২০১৫ সালে ৬১ জন। তবে, ২০১৪ সালে প্রাণ হারায় ১০২ জন শ্রমিক। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৫ জন এবং ২০১২ সালে মারা যায় ১১৩ জন শ্রমিক। অর্থ্যাৎ নির্মাণখাতে দুর্ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মৃতের ঘটনা। তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই এ অবস্থা বলে মনে করছে বিলস।
কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাও দায়ী। ২০১৭ সালে দেশে ৪১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হয়। এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনা ১২৬টি, ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ৫৯টি, অগ্নিকাÐের ঘটনা ২৯টি এবং মাটি ধসের ঘটনা ঘটেছে ২৫টি। এছাড়া জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে সংঘটিত সহিংসতায় ২৫৮ জন নিহত ও ১২০ শ্রমিক আহত হয়েছে। ২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং ২৭ জন শ্রমিক নিখোঁজ হয়। গেল বছর ১৮১টি শিল্প বিরোধের ঘটনার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে ৯১টি, পরিবহন ক্ষেত্রে ৩৬টি, বিড়িশিল্পে ৭টি, কৃষি খাতে ৬টি, চিনি শিল্প ও নৌ পরিবহন খাতের প্রতিটিতে ৫টি করে বিরোধের ঘটনা ঘটেছে।
শিল্প অসন্তোষের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গেল বছরে সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ হয় বকেয়া মজুরির দাবিতে। এছাড়া অধিকার এবং দাবি-দাওয়া, কারখানা বন্ধ, শ্রমিক প্রহার-নির্যাতন, ওভারটাইম এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ চাইতে গিয়ে হয় আন্দোলন। দেখা যায়, দাবি আদায়ে গেল বছরে ৬৮টি বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন হয়েছে ২১টি। আর ধর্মঘট করা হয় ১৮টি, সড়ক অবরোধ ১৫টি এবং সমাবেশ হয়েছে ১২টি। এছাড়া বিক্ষিপ্ত কর্মসূচি ছিল।
বিলস এর নির্বাহী পরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, আট ঘণ্টা কাজের দাবি এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন হয়, রক্তও ঝরে। কিন্তু সেই দাবি পূরণে এখনো উদাসীন মালিকপক্ষ। শ্রমিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রও তেমন উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, শুধু সমাবেশ, মিছিল করে দিনটি পালন না করে শ্রমিকদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শ্রমিকদের অধিকার না দিলে ভালো উৎপাদন সম্ভব নয়।
পাঁচ শতাধিক কারখানার ত্রুটি সংশোধন হয়নি আজও: রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরও পাঁচ শতাধিক কারখানার পরিদর্শন এবং ত্রুটি সংশোধনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তবে বিদেশি ক্রেতা জোটের সংগঠন অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের সংস্কার কাজ প্রায় শেষের দিকে। গত পাঁচ বছর ধরে ইউরোপীয় বায়ারদের পরিদর্শন জোট অ্যাকর্ড এক হাজার ৬০০ কারখানার সমস্যা নিয়ে কাজ করেছে। এসব কারখানার ৯০ শতাংশের ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে অ্যাকর্ড বলছে, ফলোআপ পরিদর্শনের মাধ্যমে ৮৪ শতাংশ কারখানার সমস্যা চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে ৭৬৭টি কারখানা ৯০ শতাংশ ত্রুটি সারিয়েছে, সব ধরনের সমস্যার সমাধান করেছে ১৪২টি কারখানা। অন্যদিকে আমেরিকান বায়ারদের জোট অ্যালায়েন্স ছয় শতাধিক কারখানা নিয়ে কাজ করে। সর্বশেষ রিপোর্টে সংস্থাটি জানায়, বেশির ভাগ কারখানা তাদের ৯০ শতাংশ ত্রুটি সংশোধন করেছে। প্রায় ১৫ লাখ পোশাককর্মীকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০০ কারখানায় গঠিত হয়েছে নির্বাচিত কর্মী নিরাপত্তা কমিটি।
এখনো কাজে ফেরেনি অর্ধেক শ্রমিক : সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইড রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পাঁচ বছর উপলক্ষে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পাঁচ বছর আগে রানা প্লাজার ধস থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনো কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি আহত হওয়া অর্ধেক শ্রমিক। আহত শ্রমিকদের ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ এখনো কোনো কাজ করতে পারছে না। ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ২২ শতাংশ শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। অন্যদিকে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক আবারও পোশাক কারখানায় কাজে যুক্ত হতে পেরেছে।
বিলসের সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত চার বছরে গার্মেন্টস খাত নিরাপদ করার যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মূলে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যকে নিরাপদ করার জন্য। যেহেতু গার্মেন্টস খাত সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সেজন্য ক্রেতাদের চাপে পড়ে মালিক এবং সরকার সেদিকে বেশি নজর দিয়েছে। অন্য খাতগুলো যেহেতু গার্মেন্টেসের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে না সেজন্য সেসব খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে নজর কম। তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ শ্রমনির্ভর প্রতিষ্ঠান মনে করে না তাদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করা দরকার। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মনে না করবে যে তাদের অবহেলা এবং অবজ্ঞার কারণে কোনো প্রাণহানি ঘটছে এবং এই প্রাণের দাম তাদের দিতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র নিরাপদ হবে না। ###

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমিক

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ