Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে দুর্ঘটনা যৌন নিগ্রহ

মাদকাসক্ত বেপরোয়া বাসচালক

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:২৮ পিএম | আপডেট : ৫:১০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮

রাজধানীতে নেশার ঘোরে বেপরোয়া বাস চালান অধিকাংশ বাসচালক। ফলে বাসের চাপায় পড়ে অহরহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। হাত-পা বিচ্ছিনের ঘটনাও ঘটছে। শুধু তাই নয়, নেশাগ্রস্ত বাসচালক ও হেলপারদের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে বাসযাত্রী সাধারণ নারীরা। চালকরা মাদকাসক্ত হওয়ায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। আর কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না বাসের অসম প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকার শক্তি জোগাতে ইয়াবা ও গাজা সেবন করেন অধিকাংশ বাসচালক। বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট হলেও প্রতিরোধ বা প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণ ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। বাসচালকদের কাছে ইয়াবা ও গাঁজা পৌঁছে দিতে খোদ রাজধানীতে গড়ে উঠেছে ১২ থেকে ১৫টি স্পট। সক্রিয় রয়েছে শতাধিক মাদক সরবরাহকারী। সম্প্রতি সময়ে যাত্রীবাহী দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান কলেজছাত্র রাজীব। টানা দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই বেপরোয়া অপর এক যাত্রীবাহী বাসের চাপায় চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে যায় গৃহকর্মী রোজিনার পা। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সকাল সকাল রাজপথে নেমেছিলেন লালবাগ জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো: দেলোয়ার হোসেন। ট্রাফিক আইন অমান্য করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাস উল্টো পথে চলছিল। বাসটি থামানোর পর পুলিশের সঙ্গে উল্টো তর্কে জড়ান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাসচালক ও হেলপার। একপর্যায়ে চালক বেপরোয়া হয়ে বাসটি চালাতে থাকেন। এ সময় বাসের চাকায় পিষ্ট হয় ট্রাফিক ইন্সপেক্টর দেলোয়ারের পা। তিনি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাসপাতালে। বাড্ডায় তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে। পরে ওই বাসের চালক-সহকারী-কন্ডাক্টরকে গ্রেফতার করা হয়। জানা গেছে, কথা কাটাকাটির জেরে গ্রিনলাইন পরিবহনের বাসচালক ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাইভেটকার চালকের ওপর দিয়েই চালিয়ে দিলেন বাস। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাইভেটকার চালক রাসেল সরকারের (২৩) বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল শনিবার বেলা ৩টার দিকে যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড় এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে এ ঘটনা ঘটে। পা বিচ্ছন্ন রাসেল সরকারের বাবার নাম শফিকুল ইসলাম। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি এলাকার বাসিন্দা রাসেল। রাজধানীর আদাবর এলাকার সুনিবিড় হাউজিংয়ে বসবাস করতেন এবং স্থানীয় একটি রেন্ট-এ কার প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেটকার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
পুলিশ জানায়, রাসেল যাত্রীসহ সকালে কেরানীগঞ্জে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড় এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে পৌঁছলে পেছন থেকে গ্রিনলাইন পরিবহনের একটি বাস ধাক্কা দেয়। তখন প্রাইভেটকার চালক রাসেল গাড়ি থামিয়ে বাসচালকের সঙ্গে জানালা দিয়ে ধাক্কা দেয়ার কারণ জানতে চান। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে গ্রিনলাইন বাসের চালক ক্ষিপ্ত হয়ে রাসেলের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেন। এতে ঘটনাস্থলেই রাসেলের বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গ্রিনলাইন পরিবহনের বাসটিকে আটক করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ। তবে চালককে গ্রেফতার করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্ত চালকের হাতে গাড়ি বা যাত্রী কেউ নিরাপদ নয়। গাড়ি যেমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তেমনি ঝুঁকির মধ্যে যাত্রীদের জীবন। সময়োপযোগী আইন না থাকা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মাদকাসক্ত চালকের সংখ্যা।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাদকাসক্ত চালকদের কাউন্সেলিং করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাস মালিক ও সাধারণ মানুষ সকলের সমন্বয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, বেশিরভাগ চালক নেশা করে বেপরোয়া গাড়ি চালায়। তাদের নেশার পথ থেকে ফেরাতে হবে। তারপরও নেশা করলে তাদের গাড়ির চাবি দেয়া হবে না। চালকদের কোনো জবাবদিহি নেই। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাসে নারীদের আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মাদকাসক্তের কারণে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ে। মাদকাসক্ত চালকদের নিজেদের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঢাকার আবাসিক চিকিৎসক ডা: রাহেনুর ইসলাম জানান, যেহেতু চালকরা মাদক গ্রহণ করে তাই তাদের বিবেকবোধ কাজ করে না। দুর্ঘটনা বা ধর্ষণের ঘটনায় তাদের (মাদকাসক্ত চালক) অনুভূতি হয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে, বাসের চালকদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার তা নেই। সচেতনতার মাত্রা খুবই করুণ। তার ওপর তারা মালিকদের দ্বারা এমনভাবে পরিচালিত হয় তাতে তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং তাদের মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে দ্রুত বাস চালিয়ে টাকা রোজগার। সে তখন রুক্ষ ও আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ডিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের ডিসি এস এম মুরাদ আলী বলেন, বর্তমানে এটি (সড়ক দুর্ঘটনা) একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেপরোয়া গাড়ি শনাক্তে নজরদারিরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, মামলাও দেয়া হচ্ছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিচালিত গত ২০ ও ২১ এপ্রিলের বিশেষ অভিযানে মোট চার হাজার ৮৬৪টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ৫৩টি গাড়ি ডাম্পিং এবং ৬৫৫টি গাড়ি রেকারিং করা হয়েছে। ১৩ লাখ দুই হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৮০ ভাগ চালকই নেশাগ্রস্ত। চালক সঙ্কটের কারণে অনেক সময় মালিক বাধ্য হয়ে মাদকাসক্ত চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেন। এদিকে পরিবহন শ্রমিকদের বক্তব্য দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয় চালক ও তার সহকারীদের। ক্লান্তি দূর করতে তারা ইয়াবা সেবন করেন। নেশার ঘোরে দুর্ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তরঙ্গ বাসের এক চালক জানান, ১৮ বছর ধরে বাস চালান তিনি। দিনে দুইবার গাঁজা সেবন না করলে বাস চালাতে পারেন না তিনি। ২০ বছর ধরে গাঁজা সেবন করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় ইচ্ছার বাইরে ঘটনা ঘটে যায়। টাকার কথাই মাথায় বেশি থাকে।
রামপুরা রোডের বাসচালক শহীদ জানান, ইয়াবা খেলে ভালো লাগে। ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা বাসের স্টিয়ারিংয়ে বসে থাকতে হয়, ইয়াবা খেলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তাছাড়া গাড়ির গরম, যাত্রীদের গরম আর ট্রাফিক পুলিশের গরম এসব সামাল দিতে ইয়াবা ছাড়া চলে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চালকদের নিয়মের মধ্যে আনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে, যা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীদের সচেতন হতে হবে।



 

Show all comments
  • গনতন্ত্র ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ২:০৩ এএম says : 0
    জনগন বলছেন, “ রমজান – ২০১৮ “ ফজিলতে ভরা মাহে রমজান আসছে আগামী মাসে, জানিনা এর পরবর্তী রমজানে কে মরি কে বাঁচে ? ঘুষ,র্দুনীতি,ধর্ষন, গীবত একমাস যায়না করা বারন, কি দিবো তার কাছে জবাব যদি এমাসে হয় মরন ? নামাজ পড়বো, রোজা রাখবো এর মধ্যে যদি খাই ঘুষ, প্রিয় সন্তান যদি চলে যায় তারপর বুঝি হবে হুশ ? লক্ষ লক্ষ তরুন মরার পথে মাদক সেবন করে, রমজান মাসে কি না করলেই নয় হে মুহাম্মদের জাতি ! এসব কার তরে ? কিছু তোমার সাথে দিবেনা এক খানা সাদা চাদর ছাড়া, মাটির নীচে তোমাকে রেখে এসে তোমার টাকায় মাদক সেবন/ফূর্তি করবো তারা ?
    Total Reply(0) Reply
  • Saif Ahmed ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৫১ এএম says : 0
    আর কত দিন চলবে এসব??আর কত!!
    Total Reply(0) Reply
  • তমা ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৫২ এএম says : 0
    যতদিন মোড়লরা আর দেশের আইন এবং তার ঠিক প্রয়োগ না হবে, ততদিন এগুলো চলতেই থাকবে
    Total Reply(0) Reply
  • শুভ্র ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৫৩ এএম says : 0
    প্রতিনিয়ত চলন্ত বাসে নারী নির্যাতন। এখন অন্ধ মোড়লরা কই, যারা দোষী বাস ড্রাইভার ও হেলপারদের পক্ষে কথা বলে ?
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৪১ এএম says : 0
    Emon shob montri mp ase jara prothom thekei sromiq unioner shathe shora shori jorito tader ashkara paia eai sromikra dapoter shathe jaichsa tai kore ayner proti eakto shonman nai tarpor polishto shora shori madok bebosharshThe jorito.janina eai shomoshshar shomadhan kivabe hobe eak matro Allah valo bolte paren....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ঘটনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ