Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পা হারানো রোজিনার উক্তি এবং-

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘মানুষ মানুষকে পণ্য করে/ মানুষ মানুষকে জীবিকা করে/ পুরনো ইতিহাস ফিরে এলে/ লজ্জা কি তুমি পাবে না-’ (ভুপেন হাজারিকা)। আমাদের দেশের পরিবহন মালিক, শ্রমিক, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা, আমলা নেতা-মন্ত্রীরা কী লজ্জা পান? নাকি পরিবহন ব্যবসার অংশিজনদের লজ্জা পেতে নেই?
রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে গতকালও বাসের চাপায় পা হারিয়েছেন মোঃ রাসেল নামের এক তরুণ। বেপরোয়া বাস চালানোর প্রতিবাদ করেছে রাসেল। ক্ষুব্ধ হয়ে বাস চালক তার শরীরের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দিয়েছে; এতেই পা হারান এই তরুণ। বাস চালক কত হিংস্র ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে গণতন্ত্র-আইনের শাসনের দেশে ভাবা যায়! এর আগে বনানীতে বাস চাপা দেয়ায় রোজিনা আক্তার নামের এক গৃহপরিচালিকা পা হারান। একই দিন গোপালগঞ্জে হৃদয় নামের এক তরুণ পা হারান বাসের চাপায়। তারও আগে বাস চালকদের যাত্রী ধরার বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় হাত হারান কলেজ ছাত্র রাজীব। র্দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ হারান তিনি। এই মধ্যে আরো কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই।
সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হলো বনানীতে বাসের চাপায় পা হারানো গৃহপরিচালিকা রোজিনা আক্তারের উক্তি। আইনের শাসন ও সমাজপতিদের তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। রোজিনা যখন হাসপাতালের বেডে শুইয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন তখন সাংবাদিকরা জানতে চায় যে, বাস চালকের বিচার চায় কিনা? জবাবে রোজিনা আক্তারের সাফ জবাব, ‘ওদের বিচার চেয়ে কোনো লাভ নাই। ওদের কোনো শাস্তি হবে না। তাই বিচার-শাস্তি চেয়ে কোনো লাভ নাই। কোনো কিছু হবে না ওদের। ওদের যদি কিছু হতো, তাহলে একটা অ্যাকসিডেন্টের আগে ওরা দশবার চিন্তা করতো। পত্রিকায় দেখেছি রাজীব ছেলেটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিন্তু কোনো বিচার কি হইছে?’ লেখাপড়া না জানা এক বালিকার ওই উক্তি কী গোটা সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসনযন্ত্রের প্রতি কি বার্তা দিচ্ছে? ২০১১ সালে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও ফটোগ্রাফার মিশুক মুনির মানিকগঞ্জে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংস্কৃতি সেবী, কবি, নাট্টকার, বিজ্ঞজনেরা সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তারা রাস্তায় নামেন দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। কিন্তু সাধারণ মানুষ গাড়ী চাপায় হা বা পা হারালে এমনকি প্রাণ হারালোর খবরও সমাজের ওই উপর তলার ব্যাক্তিদের হৃদয় স্পর্শ করে না। সমাজের প্রভাবশালী ও সুবিধাভোগী ব্যাক্তিদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই।
মন্ত্রী যখন ঘোষণা দেন, ড্রাইভারেরা গরু-ছাগলের পার্থক্য বুঝতে এবং চিনতে পারলেই তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। তখন কার কি করার থাকে? শুধু কি তাই; মাঝে মাঝে টিভি পর্দায় সড়ক দুর্ঘটনার রোধে যাদের মিটিং মিছিল করতে দেখা যেত তাদের এখন দেখা যায় মন্ত্রীর সঙ্গে টিভি ক্যামেরায় পোজ দিতে। হায়রে বুদ্ধিজীবীর বিবেক! সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিশৃংখল পরিবহণ সেক্টরে শৃংখলা আনা যে দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের কাজ তারা কী সে কর্মকান্ড করছেন? নাকি উল্টো কর্ম করছেন? ক্যালেন্ডারের পুরনো পাতা খুললে আমরা কি দেখি? ২০১৭ সালের এপ্রিলে রাজধানীতে ‘সিটিং সার্ভিস থাকবে, কী থাকবে না’ এ নিয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। সেটা থামতে না থামতে ‘মানিকগঞ্জে ইচ্ছা করে ট্রাকচাপা দিয়ে মানুষ হত্যা’র দায়ে একজন বাস চালকের আদালতের দেয়া ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে ওই সময় কী তান্ডব ঘটানো হয়? হঠাৎ দেখা গেল সব বাস বন্ধ। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়লো পরিবহন শ্রমিক চক্র। তাদের আন্দোলনের নের্তৃত্ব দেন একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী। শুধু কী তাই! মন্ত্রীর সরকারি বাসায় বৈঠক করেই ওই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কার্যত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নের্তৃত্বে তিন দিন সারাদেশের যানবাহন বন্ধ রেখে আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখা হলো। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলে গাড়ীর চাকা বন্ধ করে রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলে দেয়; এমন নজীর পৃথিবীর আর কোনো দেশে কী আছে? আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কী সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারেন? বাংলাদেশের মানুষ সেটাও দেখেছে। তারপরও ওই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কাম বাস মালিক-শ্রমিক নেতারা আছেন বহাল তবিয়তে।
প্রতিদিন টেলিভিশনের একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হয় ‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না’। সত্যিই তাই। পরিবহন সেক্টরের কাছে জিম্মী দেশের অসহায় মানুষকে হয়তো সারাজীবন রাজিব, রোজিনা, হৃদয়, রাসেলদের মতো বাসের চাপায় হা-পা হারিয়ে কাঁদতেই হবে। যাত্রাবাড়িতে রাসেলের পা হারানোর ঘটনা এমন যে ‘তুই বেপারোয়া গাড়ী চালানোর প্রতিবাদ করিস; তোর ওপর দিয়ে গাড়ী চালিয়ে দিয়ে কেটে নেব হাত-পা’। তবে রোজিনার মতো তরুণী হাসপাতালের বেডে শুইয়ে যে প্রতিবাদ করেছে সেটাই প্রত্যাশার কথা।



 

Show all comments
  • Kamal Uddin Mia ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:১৪ পিএম says : 0
    The bus drivers are very strong, because our honorable minister Shahjahan Khan is with them.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পা হারানো
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ