Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বর্ষা ঘনিয়ে আসছে প্রস্তুতি নেই, খাতুনগঞ্জে পানিবদ্ধতার ভীতি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসছে। তাছাড়া সামনে পবিত্র রমজান মাসের ব্যস্ততা। অথচ পানিবদ্ধতার সেই পুরনো সঙ্কট নিরসরে এখন পর্যন্ত নেই পর্যাপ্ত পূর্ব-প্রস্তুতি। এতে করে আমদানিকৃত নিত্য ও খাদ্যপণ্যের বিকিকিনিতে দেশের সর্ববৃহৎ, শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জে পানিবদ্ধতার ভীতি-শঙ্কা বিরাজ করছে। এটি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান ‘সওদাগরী পাড়া’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। দৈনিক লেনদেন হয় প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পানিবদ্ধতার পুরো সময়েই এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক ভাটা পড়ে। শুধু তাই নয় কয়েক শ’ কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়ে যায় গত পর পর তিন বছরের বর্ষায়।
বর্ষার আগে তথা প্রাক-বর্ষায়, ভরা বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর সময়েও ভারী বর্ষণ ও সেই সাথে কর্ণফুলী নদী উপছে চাক্তাই খাল হয়ে জোয়ার শুরু হলে তখন এই বিরাট সওদাগরী পাড়া হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে যায়। দোকান-পাট, শত শত গুদাম, আড়তে মজুদ মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। দ্রæত পানির জোয়ার ও বৃষ্টির চাপ একত্রিত হলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে মালামাল সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না।
এ অবস্থায় আকাশে ঘন মেঘের বিচরণ অথবা আবহাওয়ার গুমোট ভাব ও সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হলেই চাক্তাই খাতুনগঞ্জের সবখানে রীতিমতো ভয়-আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পানিবদ্ধতার এই ভীতি কাটছেই না; বরং বছর বছর তীব্রতা বেড়ে গিয়ে ভয়ও বাড়ছে। প্রতি বর্ষায় ও আগে এখানে হঠাৎ করে কয়েক দফায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তখন কোটি কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয় পানি ও ময়লায় একাকার হয়ে। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ঘণ্টা খানেক ভারী বর্ষণ হলে অনেকেই ছুটে আসেন দোকান-পাট, গুদামে রাখা মালামাল বিনষ্ট হচ্ছে কিনা দেখতে। কেউ কেউ মালামাল কিছু সরিয়েও ফেলেন। তবে সাময়িক বর্ষণের সময়টিতে জোয়ার না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
তবে বর্ষা ও মাহে রমজান যতই এগিয়ে আসছে ততই চাক্তাই খাতুনগঞ্জের সাধারণ ব্যবসায়ীরা ভারী বর্ষণ ও জোয়ারে পানিবদ্ধতার কারণে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা নিয়ে রয়েছেন। সামনের জোয়ার ও বর্ষায় পরিস্থিতি কী হয় এ নিয়ে ব্যবসায়ীমহল ছাড়াও এলাকাবাসীর মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সীমাহীন। দেশের প্রধান নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ বিপুল অংকের রাজস্ব যোগানদার। বছর বছর এই পানিবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী নিরসন চেয়ে ব্যবসায়ী নেতারা ইতোমধ্যে কয়েকবার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন। কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই খালের মুখে এবং চাক্তাই খাল খনন, উঁচু বাঁধ নির্মাণসহ বেশকিছু আশারবাণী শোনানো হয়েছে। কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে না মূল সমস্যা নিরসনের আলামত।
বর্ষায় ও তার আগেই চাক্তাই খাতুনগঞ্জ শুধুই নয়; কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ, রাজাখালীসহ নগরীর বিশাল ব্যবসায়িক এলাকাটি প্লাবিত হয়। চাক্তাই খালের গভীরতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলীর মোহনায় নির্বিচারে দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে চাক্তাই খালের মুখ উঁচু ও ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে অল্পক্ষণ ভারী বর্ষণের সাথে কর্ণফুলী নদীর জোয়ার যুক্ত হয়ে চাক্তাই খালের উভয় পাড় ছাপিয়ে সমগ্র ‘সওদাগরী পাড়া’ ডুবে যায়। বিগত পর পর দু’বছরে এখানকার পানিবদ্ধতায় নিত্য ও ভোগ্যপণ্যসহ কয়েক শ’ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানান স্থানীয় পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায়ীরা। পানিবদ্ধতায় এখানকার সবক’টি সড়ক, রাস্তা-ঘাট, অলিগলি ২ থেকে ৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এটি অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে রূপ নিয়েছে।
দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসাকেন্দ্র চট্টগ্রামের ‘সওদাগরী বাণিজ্য পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জে দৈনিক গড়ে ১২শ’ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী হাতবদল এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থ লেনদেন হয়। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। প্রাচীনকাল থেকেই কর্মচঞ্চল ব্যবসায়িক এলাকা। বর্ষা ও দুর্যোগের মওসুমে পানিবদ্ধতা নিরসন ব্যবসায়ীমহল ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের প্রধান দাবি। অনুন্নত রাস্তা-ঘাট নালা-নর্দমা সংস্কার, ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ড্রেজিং ও সংস্কার, পরিকল্পিতভাবে সওদাগরী পাড়াটিকে আধুনিকায়নের দাবি জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে কর্ণফুলী নদী ও সংলগ্ন চাক্তাই খালের কিনারায় ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য স¤প্রসারিত হয় চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ কোরবানীগঞ্জে। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাব-জজ হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় স্ত্রী মোছাম্মৎ খাতুন বিবির নামানুসারে এখানকার সওদাগরী ব্যবসায়িক পাড়া খাতুনগঞ্জ গড়ে ওঠে। তবে পুরনো সওদাগরী পাড়া চাক্তাই গড়ে ওঠে আরও অতীতে। সম্রাট বাবরের শাসনকালে পালতোলা জাহাজ নিয়ে আরব, পারস্য ও মধ্য-এশিয়ার সওদাগররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপদ পোতাশ্রয় দিয়ে আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এসময়ে তুর্কী বণিকরা চট্টগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হন। প্রাচীন তুরস্কের চৌকস, বনেদী ও ‘জাত’ ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত ‘চুগতাই’ সওদাগররা এখানে ব্যবসার পেশাদারিত্ব চালু করেন। ‘চুগতাই’ সওদাগরদের সুনাম স্মরণীয় রয়েছে ব্যবসায়-বাণিজ্যিক অঞ্চলটির ‘চাক্তাই’ হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতির মধ্যদিয়ে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ