পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম ও আসলাম পারভেজ : মাছের ডিম ৯৬ ঘণ্টায় ফুটে রেণু। রেণু থেকে পোনা। বলা হয়ে থাকে ‘মাছের পোনা দেশের সোনা’। ধান-গম বা খাদ্যশস্যের মতো ডিম-রেণু-পোনা হচ্ছে মাছের বীজ। আর সেই মৎস্যবীজ হালদা নদীর ডিম থেকে ফোটানো রেণু বিক্রির রীতিমেতা ধুম পড়ে যায় গতকাল (বুধবার)। দিনে-রাতে হালদা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে গমগম করে মানুষ। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নোয়াখালী, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, ফরিদপুর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, চাঁদপুরসহ মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষি ক্রেতারা সারাদেশ থেকেই হালদার রেণু কিনতে ছুটে এসেছেন। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ তথা বড় জাতের মাছের রেণুর গতকাল সর্বোচ্চ দর ওঠে কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। গত মঙ্গলবার কেজি ৭০ হাজার টাকা, এর আগের দিন (সোমবার) কেজি সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকায় রেণু বিক্রি হয়। গতবছর ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ কেজি এক লাখ টাকায় রেণু বিক্রি হয়। তবে গতবছর ডিম মিলে কম। এবার হালদায় মা-মাছেরা ডিম বেশি ছাড়ার কারণে রেণুর দাম কিছুটা কম হলেও মৎস্যজীবীদের মুনাফা হয়েছে অনেক বেশি। এবার ব্যাপকহারে রেণু বিকিকিনি হওয়ার ফলে ডিম সংগ্রহকারী জেলে ও তাদের পরিবার-পরিজনের মাঝে দীর্ঘদিন পর প্রচুর ডিম থেকে রেণু ফোটার সঙ্গে সুখের হাসিও ফুটে উঠেছে। আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত চলবে রেণুর বেচাকেনা।
এশিয়ায় মিঠাপানির মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। এটি মাছের ডিমের প্রাচুর্যে ভরা আল্লাহতায়ালার এক অপার রহমত ও বিস্ময়কর ‘মুক্তার খনি’। গত ১৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ (কার্প জাতীয়) বড় মা-মাছ দলে দলে ভেসে উঠে ডিম ছাড়ে। এবারের মৌসুমে বিগত ১০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে কমপক্ষে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম ছেড়েছে। গোড়াতে ডিমের রক্ষণাবেক্ষণে অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে। এ কারণে নষ্ট বা অপমৃত্যু ঘটে কিছু ডিম-রেণুর। দৈনিক ইনকিলাবে এ বিষয়ে সরেজমিনে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, শুরু হয় দৌঁড়ঝাঁপ। এরফলে বেশিরভাগ ডিম থেকেই রেণু ফোটানো সম্ভব হয়েছে এবং গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রেণুর বেচাকেনা চলে জমজমাট।
এদিকে হালদা পাড়ে গড়দুয়ারা, মদুনাঘাট, অঙ্কুরি ঘোনা, পশ্চিম গহিরা, কাগতিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে রেণু বেচাকেনার পয়েন্ট বা অঘোষিত ‘হাটে’ দেশের অনেক জেলা-উপজেলা থেকে আগত মৎস্যজীবী ক্রেতারা এক কেজি, আধাকেজি। এমনকি কেউ কেউ ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত রেণু কিনে নিয়ে গেছেন। সাধারণত পানি সমেত পলিপ্যাকে ভর্তি করে রেণু বিক্রি হয়ে থাকে। (অর্ধেক পানিতে ভাসমান অর্ধেক রেণু এই সমানুপাতে ওজন ধরা হয়)। ডিম সংগ্রহকারী ও বিশেষজ্ঞরা ইনকিলাবকে জানান, ৩/৪ দিন পর ডিম থেকে ফোটানো এসব রেণু ক্রেতা বা মাছচাষিরা যার যার এলাকায় নিয়ে গিয়ে নিজেদের নার্সারি পুকুরে ছেড়ে দেবেন। নার্সারি পুকুরে সাপ, ব্যাঙ, রাক্ষুসে মাছের কবল থেকে সুরক্ষা, পানির তাপমাত্রা, পরিচ্ছন্নতা ও অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ, পর্যাপ্ত মাছের খাবার প্রদান, ঝড়-বৃষ্টি-দুর্যোগে সতর্কতাসহ বিভিন্ন উপায়ে নিবিড় যতœ-আত্তি করবেন মাছচাষি বা নার্সারির উদ্যোক্তারা। এরপর রেণু আরও বিকশিত হয়ে যখন আঙ্গুল সমান পোনায় পরিণত হবে তখন প্রতিটি ১০ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। সেই অঙ্গুলি-পোনা মাছচাষিরা কিনে নিয়ে মজুদ পুকুরে, দীঘিতে চাষ করবেন। অবশেষে পোনা থেকে যখন পরিপূর্ণ মাছে রূপান্তরিত ২, আড়াই কেজি থেকে ৫, ৬ এমনকি ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, মৃগেল মাছ উৎপাদিত হবে তখন সেই হালদার ডিমে বড় মাছের লেনদেন হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। যা জাতীয় অর্থনীতিতিতে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। বিশেষজ্ঞরাগণই বলছেন, দেশে যে কোনো উৎসের ডিমের তুলনায় প্রাকৃতিক পরিবেশে হালদার রুই, কাতলা, মৃগেল মা-মাছের ডিম থেকে উৎপাদিত মাছের বর্ধনশীলতা অনেক বেশি।
হালদা ও কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ, হালদা রক্ষা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মনজুরুল কিবরীয়া গতকাল ইনকিলাবকে জানান, এবারের মৌসুমে হালদায় মা-মাছের ডিম আহরণে ইউ-টার্ন উন্নতি হয়েছে। সুষ্ঠু সংক্ষণের মাধ্যমে এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। এরজন্য সরকারি-বেসরকারি সকল মহলের মিলিত প্রচেষ্ট এবং সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে হালদা রক্ষায় বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টা এবং এবার আবহাওয়া ভালো থাকাসহ প্রাকৃতিক কারণগুলো সহায়ক হওয়ায় ১০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ পরিমাণে ডিম পাওয়া গেছে। আসন্ন পূর্ণিমায় মা-মাছেরা ফের ডিম ছাড়তে পারে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বলা কঠিন। কেননা পুরো বিষয়টিই প্রকৃতি-নির্ভর দান। এবার মৌসুমসহ বিভিন্ন বিষয় অনুকূলে থাকায় মা-মাছ বেশিহারে ডিম ছেড়েছে। এ কারণে সহসা আর তেমন ডিম নাও ছাড়তে পারে। তবে ইতোমধ্যে ডিম ধারণ করা বা গত সপ্তাহে কিছু মা-মাছ ডিম যদি না ছাড়ে তাহলে সামনে আবারও ডিম ছাড়ার আশা করা যাবে। তবে এরজন্য বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টির মতো বিশেষ আবহাওয়াগত অবস্থাও তৈরি থাকা শর্ত।
এদিকে মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর হ্যাচারিগুলো গতকাল পরির্দশন করেন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ), হালদা বিশেষজ্ঞ ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা। তারা হাটহাজারীর মদুনাঘাট, মাছুয়াঘোনা ও শাহ-মাদারী সরকারি হ্যাচারি পরির্দশন করেন। এখনো হালদার পাড়ে রেণু কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ভিড় করছেন ক্রেতারা। হালদার ডিম আজও বিক্রি করা হবে। পরিদর্শনকালে ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক বজলুর রশিদ, চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মমিনুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরীয়া, রাঙ্গামাটি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ছরোয়ার জাহাঙ্গীর, আইডিএফের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হক, হাটহাজারীর মৎস্য অফিসার স্বাপন চন্দ্র দে, অন্যন্যাদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন, রাউজান মৎস্য কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম, প্রফেসর শহিদুল আমীন চৌধুরী, ইফতেখারুল ইসলাম, এনায়েতুর রহিম, হাটহাজারীর সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম প্রমুখ।
তারা ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। ডিম থেকে রেণু ফোটানোর কাজে ব্যবহত হ্যাচারির কুয়া মেরামত ও পরিষ্কার পানির জন্য ডিপ-টিউবয়েল মেরামতসহ প্রয়োজনীয় সবধরনের কাজ দ্রæত সম্পন্ন করার আশ্বাস দেন কর্মকর্তারা। হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, কিছু অর্থলোভী জেলে হালদার মা-মাছ শিকারে উঠেপড়ে লেগেছে। মা-মাছগুলো যেন শিকার করতে না পারে সেদিকে মৎস্য বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। এর পাশাপাশি হালদার যেসব স্থানে মা-মাছ ডিম ছাড়ে সেখানে পর্যাপ্ত পাহারাদার বসাতে হবে। এদিকে আইডিএফের পক্ষ থেকে ডিম সংগ্রহকারী ও রেণু বিক্রেতাদের প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে। ডিম সংগ্রহকারী ও রেণু বিক্রেতারা কোনো ডিম ও রেণুতে ভেজাল যাতে না হয় এরজন্য হ্যাচারিগুলোতে ১৫ জন পাহাড়াদার বসানো হয়েছে। তবে এখনও ভেজাল অর্থাৎ অন্য মাছের রেণু মিশিয়ে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
গতকাল হালদা পাড়ের হ্যাচারী ও মাটির কুয়াগুলোতে দেখা গেছে রেণু ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম। কুমিল্লা, আনোয়ারা, মিরসরাই, নোয়াখালী, সীতাকুন্ড, বরিশাল, ফরিদপুর, চকরিয়া, ফেনী ও দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ক্রেতারা রেণু কিনে নেন। ফেনী থেকে আসা ক্রেতা মোঃ মাহাবুবুল আলম জাানান, হালদার মা-মাছের রেণু থেকে মাছ খুব দ্রæত বেড়ে ওঠে, মাছও সুস্বাদু হয়। তাই আমি এক কেজি রেণু কিনেছি ৬৫ হাজার টাকায়। রেণু বিক্রেতা আনোয়ার জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনো ক্রেতা আসছেন। আমরা উপযুক্ত মুল্যে রেণু বিক্রি করছি। তাতে ক্রেতারাও খুশি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।