Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বৈচিত্র্যময় ফসলের সম্ভার

কৃষকের ঘামে-শ্রমে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষি

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বোরো ধানের শীষে সোনালী আভা। ক্ষেতে ক্ষেতে বরবটি, চিচিঙ্গা, ঢেড়স, করলা, ঝিঙ্গে। আছে হরেক রকমের শাক, ক্ষিরা, তরমুজ, বাঙ্গিও। ঘরে উঠছে, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ফেলন, মসুর। বোরো কাটতেই শুরু হবে আউশ আবাদের তোড়জোড়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রতিটি জনপদে এখন এমনই কর্মব্যস্ত। সর্বত্রই বৈচিত্র্যময় ফসলের সম্ভার। কৃষকের ঘামে আর শ্রমে সারা দেশের মতো এই অঞ্চলেও সমৃদ্ধ হচ্ছে কৃষি।
আছে পাহাড়ি ঢল, বন্যা, লোনা পানির আগ্রাসন, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈরী আবহাওয়া। নগরায়ন আর শিল্পায়নের প্রভাবে কমছে চাষযোগ্য জমি। আছে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার বেদনা। তবুও দমে যায়নি এই অঞ্চলের প্রান্তিক চাষীরা। তাদের চেষ্টায় জমিতে সোনা ফলছে। এক ফসলি জমি পরিণত হচ্ছে তিন থেকে চার ফসলিতে। পতিত থাকছে না কোন জমি, এমনকি বাড়ির আঙ্গিনাও। দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নতজাতের বীজ বুনে ফলন বাড়িয়ে চলেছে এই জনপদের কৃষক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অঞ্চলের কৃষিতে রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান আরও বাড়বে। আরও সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ অর্থনীতি, নিশ্চিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। এখানকার মাটি বড়ই উর্বরা। পাহাড়, সাগর আর নানা নদ-নদীর কারণে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিতে আছে বৈচিত্র। এই কারণে এখানকার মাটিতে ফলে বৈচিত্র্যময় ফসল। সমতল ভূমির পাশাপাশি পাহাড়, টিলা, উপত্যকা, উচু ভূমিতেও চাষাবাদ হচ্ছে। ধানের পাশাপাশি এই অঞ্চলের শাক-সবজি আর হরেক মসলা দেশের অনেক এলাকার চাহিদা পূরণ করছে।
সীতাকুন্ডু, দোহাজারী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, হাটহাজারী, রাঙ্গুনীয়া, চন্দ্রঘোনার শীত ও গ্রীষ্মকালীন সবজির খ্যাতি দেশজুড়ে। এসব এলাকায় কিছু সবজির আবাদ হয় প্রায় পুরো বছরজুড়ে। শুধু এই মওসুমেই সীতাকুন্ডে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার শিম আর শিমের বিচি বিক্রি হয়েছে। শস্য ভান্ডার খ্যাত রাঙ্গুনীয়ার গুমাইবিলে প্রতিবছর ধানের ব্যাপক ফলন হয়। আছে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের জুম চাষের হরেক ফসল। কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু আর মাতামুহুরির দু-কূলের উর্বরা জমিতে ধানসহ সব ধরনের শাক-সবজির আবাদ হচ্ছে। পাহাড়, টিলায় নানা জাতের শাক-সবজির পাশাপাশি আবাদ হচ্ছে আদা, হলুদসহ অনেক রকমের মসলার। উপকূলের চাষিরাও বসে নেই। ধানের পাশাপাশি সেখানে আবাদ হচ্ছে মওসুমি নানান শাক-সবজি, ডাল, বাদাম, সরিষা, সয়াবিন।
কৃষি বিভাগের রের্কড বলছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধানসহ সব ধরনের ফসলের আবাদ বাড়ছে। চালসহ শাক-সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন। আমনের পাশাপাশি বাড়ছে বোরো আর আউশের আবাদও। চলতি বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়। আর ফলন পাওয়া গেছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ১৭৩ মেট্রিক টন (চাল)। বোরো আবাদেও আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। এইবার ২ লাখ ৩৭ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে-যা লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ বেশি। কৃষি বিভাগের প্রত্যাশা বোরোতে ফলনের পরিমাণ ৯ লাখ ৬২ হাজার ১১৯ মেট্রিক টন (চাল) ছাড়িয়ে যাবে। আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৮৬ হেক্টর। তাতে ফলন পাওয়া যাবে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন। আউশ আবাদে চাষিদের উৎসাহিত করতে দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা। পার্বত্য জেলায় ২৩ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে আমন, ২৪ হাজার ৩৮০ হেক্টরে বোরো আর ১৩ হাজার ৬৩৮ হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হচ্ছে। এর পাশাপাশি ওই তিন জেলায় জুম চাষেও ধানের আবাদ হয়।
ধানের পাশাপাশি এই অঞ্চলে এখন চলছে গ্রীষ্মকালীন নানা শাক-সবজির আবাদ। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে মরিচ, মুগ, আদা, হলুদ, তিল। তিন পাবর্ত্য জেলায় ৮১০ হেক্টরে জমিতে মরিচ, ৯ হাজার ৩১২ হেক্টরে শাকসবজি, ৯৭১ হেক্টরে তিল, ১৫ হেক্টরে মুগ, ৭ হাজার ৩৮২ হেক্টরে আদা এবং ৮ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে হলুদের আবাদ হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় চাষিদের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও হলুদ, মরিচ, আদাসহ মসলার আবাদ করছে বেশ কয়েকটি কোম্পানি। এ অঞ্চলে শীতকালীন শাকসবজির ফলনও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বাঙ্গি, ক্ষিরা, তরমুজ আবাদেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মওসুমী শাকসবজির পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় টমেটো, বেগুন, ধনে পাতাসহ বিভিন্ন সবজির ফলন হচ্ছে প্রায় সারা বছর। বার মাসি সবজি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় এসব সবজি। এতে কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। এ অঞ্চলের উঁচু ও পাহাড়ী ভূমিতে মওসুমের আগেই চাষ হয় শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির। ফলে আগাম সবজির জন্য খ্যাতি আছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষকদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ আবুল হোসেন তালুকদার ইনকিলাবকে বলেন, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কৃষিতে অফুরান সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনার পুরোটাকেই কাজে লাগানো গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান আরও বাড়বে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এখনও অনেক জমি পতিত রয়েছে। সব জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহওয়া বৈচিত্র্যময় ফসলের উপযোগী উল্লেখ করে এ কৃষিবিদ বলেন, এখানে ধানের পাশাপাশি শাকসবজি থেকে শুরু করে হরেক রকম তেলবীজ ও মসলা আবাদের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ফসলের পাশাপাশি ফলমূল আবাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষকের


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ