Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

ডানা মেলছে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়ন

আঙ্কারা থেকে মস্কো

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এশিয়া টাইমস : প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, হাসান রুহানি ও রজব তাইয়েব এরদোগান আঙ্কারায় সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে দ্বিতীয় রুশ-ইরান-তুরস্ক নিয়ে যখন শীর্ষ বৈঠক করছিলেন তখন মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয় ৭ম আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলন। এতে অংশ গ্রহণ করেন কয়েক ডজন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে চীন এতে শুধু উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলই পাঠায়নি, সবচেয়ে বড় কথা, সে জোরালো ও স্পষ্ট বার্তাও দিয়েছে। নতুন চীনা প্রতিরক্ষ্া মন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেংহে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেগেই শোইগুর পাশাপাশি বলেন, চীন আমেরিকানদের রুশ ও চীনা সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানাতে এখানে এসেছে। শোইগু রুশ-চীন অংশীদারিত্বের বিশেষ চারিত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ বৈঠকের আগেই গেøাবাল টাইমস জোর দিয়ে বলে যে রাশিয়ার অব্যাহত শক্তিশালী হয়ে ওঠা শক্তির প্রেক্ষিতে মার্কিন চীন চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু রুশ-চীন অংশীদারিত্বের বিশেষ চারিত্রকেই শক্তিশালী করবে।
এরপর ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বিষয়টিকে আরো সম্প্রসারিত করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যেও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিদেশী পরিকল্পনা অনিবার্যভাবে ব্যথ হবে। মস্কোতে যা হল তার সাথে অবশ্যই আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের যোগসূত্র রয়েেেছ।
অভিন্ন অঙ্গীকার
সিরিয়া বিষয়ে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক প্রথম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত বছর ২২ নভেম্বর রাশিয়ার সোচিতে। সোচি বৈঠক সিরিয়ান জাতীয় সংলাপ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। সিরিয়ার জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৫০ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। এ সকল প্রক্রিয়াই ২০১২ সালের জেনেভা শান্তি প্রক্রিয়ার গাইড লাইন অনুসরণ করবে। জাতিসংঘ সোচি বৈঠককে আন্তঃসিরিয়া আলোচনা প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করে।
আঙ্কারা বৈঠকের জন্য রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কেও পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা গত বছর এপ্রিলের গোড়াার দিকে আস্তানা বৈঠকে এর ক্ষেত্র তৈরি করেন।
এ শীর্ষ বৈঠকের পর চূড়ান্ত ইশতেহারে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব, ঐক্য, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতার ব্যাপারে অভিন্ন অঙ্গীকার করা হয়।
পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পুতিনের প্রথম বিদেশ সফর ঘটে আঙ্কারায়। সিরিয়া বিষয়ে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক কৌশল যুদ্ধমুক্ত অঞল ও একটি একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য এনেছে। এগুলো হচ্ছে দমেস্কেও উপকন্ঠে পূর্ব ঘুটা, ইদলিব, হোমস এবং সিরিয়া-জর্দান সীমান্ত। এর ফলে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধ এলাকা ত্যাগ করতে পারবে, বিশেসম করে ঘুটা।
ঘুটায় কয়েকটি আরব জিহাদি গ্রুপের সাথে লড়াইয়ে রাশিয়ার বিমান সমর্থন ও আলোচনা প্রক্রিয়া উভয়ের কারণে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) জয়ী হয়েছে। গড়–রুত্বপূর্ণ যে এখানে ইরানি সামরিক কমান্ডারদের কোনো ভূমিকা ছিল না। তথাকথিত মধ্যপন্থী বিদ্রোহীরা সবাই ইদলিবে চলে গেছে। ২০১৬ সালে আলেপ্পোতে জয় লাভের পর এসএএ-র এটি বড় বিজয়।
উত্তর সিরিয়ার অবস্থা জটিলই রয়ে গেছে। সেখানে ন্যাটো বনাম ন্যাটো উপ চক্রান্ত চলছে। তুর্কি সৈন্য বনাম ওয়াইপিজি লড়াই অব্যাহত রয়েছে। কূটনীতিকরা এশিয়া টাইমসকে বলেন, আফরিনে কুর্দি এলাকায় তুর্কি অলিভ ব্রাঞ্চ সামরিক অভিযানের পাশাপাশি ঘুটায় এসএএ-রাশিয়া অভিযান শুরু হয়। সিরিয়ায় তুর্কি অভিযানে বিক্ষুব্ধ ইরান সম্ভবত কোনো কারণেই ঘুটাতে ইরানি কমান্ডারদের হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দিয়েছে।
আঙ্কারায় ত্রিদেশীয় বৈঠকে ইদলিবের ঘটনা ছিল প্রধান আলোচনার বিষয়। ইদলিব এখন মধ্যপন্থী জিহাদিদের ঘাঁটি। সেখানে আল কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত হায়াত তাহরির আল শাম তুরস্ক সমর্থিত সিরিয়ান লিবারেশন ফ্রন্টের সাথে লড়াই করছে।
এখন কথা হচ্ছে আঙ্কারা এ সব বিভিন্ন গোষ্ঠিকে বুঝাতে পারবে কিনা যে যুদ্ধ আসলে শেষ হয়ে গেছে। অন্যথায় রুশ বিমান শক্তির সমর্থনপুষ্ট এসএএ আবারোর বিমান হামলা শুরু করবে যার পরিণতিতে তুরস্কে ৩৫ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুর সাথে আরো লাখ লাখ উদ্বাস্তু যোগ হবে।
যেটা নিশ্চিত সেটা হল যে তুরস্ক সিরিয়ার উত্তর পশ্চিম ও উত্তর মধ্য এলাকা থেকে শিগগিরই সরবে না। দামেস্কের কথা বাদ দিলেও মস্কো ও তেহরান এ ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা এক খোলাখুলি প্রশ্ন।
যথাসময়ে এস- ৪০০ পাওয়া
রাশিয়া-তুরস্ক অংশীদারিত্ব পুরোটাই বাণিজ্যিক যা জ¦ালানি, পরমাণু শক্তি ও অস্ত্র কেন্দ্রিক।
রাশিয়া তুরস্কে পরমাণু শিল্পের সূচনা করতে চলেছে। তুরস্কের আকুয়ুতে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দেশটির প্রথম পরমাণু শক্তি কেদ্র নির্মাণ করা হবে। ২০২৩ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হবে। তবে মালিকানা থাকবে রাশিয়ার।
ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী মস্কো ২০২০ সালের মধ্যে আঙ্কারাকে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করবে। পুতিন বলেন, তুর্কি বন্ধু ও অংশীদারদের অনুরোধেই ধারণা করা সময়ের আগেই তা দেয়া হচ্ছে। ন্যাটো এ খবরে খুশি নয়।
এরপর রয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলারের তুর্ক স্ট্রিম গ্যস পাইপ লাইন যার নির্মাণ এগিয়ে চলেছে। ইইউর কয়েকটি দেশ এতে খুশি নয়।
এ সব কিছুই বলে যে রাশিয়ার সতর্ক কূটনীতির লক্ষ্য ন্যাটো-ইইউর সুনিদির্ষ্ট সদস্য দেশের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ত রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তবর্তী দেশগুলো অথবা বাল্টিক থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত শীতল যুদ্ধেও সময়কালীন ২.০ আয়রন কার্টেন অঞ্চল থেকে ন্যাটোকে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ করা। সমন্বিত রশ-চীন প্রচেষ্টায় এরদোগান সাংহাই সহযোগিতা চুক্তিতে (এসসিও) যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করলে নিশ্চিতভাবে এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। আঙ্কারা এসসিওর পূর্ণাঙ্গ সদস্য পাকিস্তান ও বর্তমানে এ সংস্থার পর্যবেক্ষক মর্যাদার অধিকারী পূর্ণাঙ্গ সদস্য হতে চলা ইরানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গভীর করছে।
ইউরেশিয়ার একীকরণে রাশিয়া, চীন ও ইরান গুরুত্বপূর্ণ যার মধ্যে রয়েছে গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপন থেকে বাণিজ্য সংযোগ নেটওয়ার্কসহ প্রতিটি বিষয়। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়ন তার ডানা বিস্তার করছে ও শক্তি সঞ্চয় করছে। এ ইউনিয়নের হাতে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, বড় খেলোয়াড় ও বৃহৎ পরিকল্পনা। এরদোগান একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক হবেন না।
এ বছর শেষ হওয়ার আগে তেহরান রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়নে (ইইইউ) যোগ দেবে বলে আশা করছে। এটা রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের নিবিড়তার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শক্তি যোগাবে। মুক্ত বাণিজ্য ইইইউ-র বর্তমান সদস্য হচ্ছে রাশিয়া, কাজাখস্তান, বেলারুশ, কিরগিজস্তান ও ভিয়েতনাম যা চীন, ভারত ও ইন্দেনেশিয়া থেকে সার্বিয়া, ইসরাইল ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোসহ প্রত্যেককে আকৃষ্ট করেছে। এরদোগানের দৃষ্টিও এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে অবশ্যই।
এখন পুনর্গঠনের সময়
পাইপ লাইনের ব্যাপারে সিরিয়া শুরু থেকেই যুক্ত ছিল। ইরান-ইরাক-সিরিয়া গ্যাস পাইপ লাইনের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে। পরে তা হয় কাতার-তুরস্ক পাইপ লাইন।
কাতার ও সউদী রাজ পরিবার সিরিয়ায় ভূরাজনৈতিক ভাবে পরাজিত বলে স্বীকৃত। কাতারে সউদী অবরোধ দুঃখজনক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন পরিস্থিতিতে ওমান ও কুয়েতের সমর্থনপুষ্ট কাতার ইরান ও তুরস্কের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
আঙ্কারা কাতারে তারিক বিন জিয়াদ সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে। কাতার ও ইরান বিশে^র বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র যৌথভাবে পরিচালনা করে। এ গ্যাস সরবরাহের পাইপ লাইন নির্মাণের আগেই অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে চলেছে। চীন ও রাশিয়াও কাতারি গ্যস শিল্পের সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে।
সিরিয়ার পুনর্গঠন চূড়ান্তভাবে হাতে আসার পাশাপাশি বেইজিং তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সিরিয়াকে যুক্ত করার তার পরিকল্পনা জোরদার করবে।
এদিকে রাশিয়ার জ¦ালানি মন্ত্রী আলেকজান্দর নোভাক নিশ্চিত করেছেন যে বৃহৎ জ¦ালানি প্রতিষ্ঠান লুকওয়েল ও গ্যাজপ্রম নেফট ফেব্রæয়ারিতে স্বক্ষরিত সহযোগিতা রোডম্যাপের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই সিরিয়ার ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জ¦ালানি অবকঠামো পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব আরোপ করেছে।
রাশিয়ার কোম্পানিগুলোকে বানিয়াস তেল শোধনাগার উন্নয়ন এবং ইরান ও ভেনেজুয়েলার সাথে একটি নতুন শোধনাগার নির্মাণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দামেস্ক ও মস্কো বাণিজ্য সুবিধার জন্য একটি সরাসরি জাহাজ চলাচল পথ চালু করবে। তারা দু’দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করবে।
সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ওয়ায়েল আল হালিকি জানান, ইতোমধ্যে প্রায় ১শ’ কোটি ডলারের জ¦ালানি, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার আগে রাশিয়ায় সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত রিয়াদ হাদ্দাদ অঙ্গীাকার করেছিলেন যে যে সব দেশ সিরিয়াকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেছে, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তাদের অগ্রাধিকার থাকবে। তার অর্থ হচ্ছে অবশ্যই রাশিয়া, ইরান ও চীন। এরদোগানের নতুন অটোম্যানবাদ এক্ষেত্রে কি ভূমিকা পালন করে তাই এখন দেখার বিষয়।



 

Show all comments
  • কামাল ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:৪৯ এএম says : 0
    খুব ভালো খবর
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাশিয়া


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ