দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু শাসক-বাদশাহ্র জন্ম হলো যারা বাহাস-বিতর্ক ও মুনাজারায় উৎসাহী হয়ে উঠলেন এবং চারদিক থেকে মুনাজারা বিষয়াদি ও তার পন্থা-পদ্ধতি বিষয়ে বই-পুস্তক সংকলিত হতে থাকলো। স্বল্প যোগ্যতাধারী লোকজনও মাছআলা-বিধানে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করলো এবং পক্ষপাতিত্ব, কঠোরতা ও ধ্বংসাতœক বিবাদ-বিসম্বাদের দ্বার উন্মুক্ত হতে শুরু করলো। মুফতী পদ থেকে বিচারক পদে উন্নীত লোকজন শাসক-বাদাশাহদের সন্তুুষ্টি পেতে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পন্থা অনুসন্ধানে প্রয়াস পেলেন। যার কয়েকটি উদাহরণ নি¤েœ পেশ করা হলোঃ
কোনো প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করলেন, স্ত্রীকে বা গোপনাঙ্গ স্পর্শ করলে উযুর বিধান কি হবে? তখন জবাব পাওয়া গেল, “ইমাম আবূ হানীফা (র)এর মতে, এতে উযু ভঙ্গ হবে না।”
দাবা খেলা বা ঘোড়ার গোশত আহার প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, জবাব দেয়া হতো, “ইমাম শাফেয়ী (র) এর মতে, তা বৈধ।”
বিচারকের বিবেচনা প্রসূত শরীয়তের শাস্তি (তা’যীর) এর সীমা লঙ্ঘন,বাড়াবাড়ি প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, জবাব দেয়া হতো, “ইমাম মালেক (র) এর মতে প্রয়োজনে তা করা যায়।”
ওয়াকফ সম্পদ অলস, আয়হীন পড়ে থাকলে এবং মুতাওয়াল্লী তা আবাদ ও আয় বর্ধক করতে না পারার প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, তার জবাবে ওয়াকফ সম্পদ বিক্রয় করা জায়েয মর্মে ফাতওয়া দেয়া হতো। কারণ, ইমাম মালেক (র) এর মাযহাব মতে তেমনটির সুযোগ আছে। আর এভাবে বছর বছর ধরে ওয়াকফ সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় স্থানান্তরিত হতে লাগলো। অর্থাৎ সর্বত্র কেবল সহজিকরণ এবং দীন-ধর্মের স্বার্থের সার্বিক বিবেচনার পরিবর্তে জনগণের জাগতিক চাহিদা ও সরকারকে সন্তুষ্ট করাই যেন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো।
মতভেদের প্রকার ঃ
মতবিরোধ সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে। যথাঃ
(এক) ঃ উভয় পক্ষেরই দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। প্রত্যেকেই মনে করছেন আমি যা বলছি, তাতে ধর্মের কল্যাণ নিহিত এবং পতিপক্ষ যা বলছেন, তাতে দীনের ক্ষতি নিহিত। এমতাবস্থায় উভয় পক্ষের জন্য মতভেদ করা ফরয হয়ে যায় এবং উভয় পক্ষ সওয়াব প্রাপ্ত হন; মতবিরোধ পরিহার করা পাপ বলে গণ্য হয়।
(দুই) ঃ এক পক্ষের উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সন্তোষ কামনা এবং অপর পক্ষের লক্ষ্য কেবল প্রবৃত্তির অনুসরণ। উদাহরণত একজন কাউকে সালাতের ব্যাপারে ওয়ায-উপদেশ প্রদান করছেন, অন্যায় কর্ম থেকে বাধা দিচ্ছেন এবং তা মান্য না করায় তার সঙ্গে বিরোধ করছেন। অন্যজন এর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন এ বলে যে, তার সঙ্গে বিরোধ-বাধার কি প্রয়োজন? এমতাবস্থায় প্রথম ব্যক্তির পক্ষে মতবিরোধে জড়ানো ওয়াজিব এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনের পক্ষে বিরোধে জড়ানো হারাম।
(তিন) ঃ তৃতীয় প্রকার মতবিরোধ হচ্ছে তা, যেখানে দু’পক্ষই প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে মতভেদে জড়িয়ে পড়েছেন। এমন মতবিরোধ পরিহার করা উভয় পক্ষের জন্যই ওয়াজিব এবং তাতে জড়ানো হারাম। (আহসানুল-ফাতাওয়া ঃ খ-১,পৃ-৪৭৩-৪৭৪। )
মতবিরোধ বৈধতার শর্তাবলী ঃ
মতবিরোধ প্রশংসিত হওয়ার প্রধান শর্ত হলো, তা একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুুষ্টির নিমিত্তে হতে হবে।
বিরোধকারীগণের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতা বিবর্জিত বা বাস্তবতার পরিপন্থী হতে পারবে না। উদাহরণত, “ কেউ উটকে ছাগল বলতে থাকবে এবং দাবী করবে যে, এমনটাই আমার গবেষণা এবং আমি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই বলছি (?) এবং এমনটাই আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে!” এমনসব বক্তব্য পেশ করা সত্তে¡ও তার বিরোধ প্রশংসাযোগ্য না হয়ে বরং মন্দ ইখতিলাফ বলে গন্য হবে। একইভাবে কুরআন-সুন্নাহ্র বাস্তবতা ও যে আদর্শ ও বাস্তবতার ওপর আমি ও আমার সাহাবাগণ রয়েছে এর বিপরীতে বিরোধে জড়িয়ে পড়া যাবে না।
মতবিরোধ বৈধ হওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধ করা অথবা মুখ্য বিষয়াদি ফেলে রেখে গৌণ বিষয়াদি নিয়ে বিরোধ-দ্ব›েদ্ব জড়ানো যাবে না। যেমন হযরত আলী (রা) ও হযরত মুআবিয়া (রা.) এর পারস্পরিক দ্ব›েদ্বর কালে রোম সম্রাট হযরত মুআবিয়ার পক্ষে থেকে নিজেকে নিরাপদ ভেবে (কারণ, তাঁদের মধ্যে সখ্যতা ছিল) তৎকালীন ইসলামী সাম্রাজ্যের ইরানের কিছু অংশ যা হযরত আলী (রা) এর অধীনস্থ ছিল, তা দখলের পাঁয়তারা করেছিলেন। হযরত আমীর মুআবিয়া (রা) বিষয়টি জানতে পেরে রোম সম্রাটের কাছে এ মর্মে পত্র লিখেন ঃ
“হে অভিশপ্ত ! তুমি যদি তোমার পরিকল্পনা প্রত্যাহার না করো এবং নিজ সীমানা ও স্বদেশে ফিরে না যাও, তাহলে আমি ও আমার চাচাতো ভাই (আলী) অবশ্যই আপষ-রফা করে তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবো এবং তোমাকে নিশ্চিত তোমার পুরো দেশ থেকে বহিষ্কার করবো, পুরো পৃথিবী তোমার জন্য সংকীর্ণ করে দেবো।” একই রকম ঐতিহাসিক বক্তব্য ‘সিফফীন’ যুদ্ধ চলা কালীন সিরিয়ার কিছু অংশ দখলের পাঁয়তারার বিরুদ্ধেও হযরত মুআবিয়া (রা) কর্তৃক উচ্চারিত হয়েছিল। ( প্রাগুক্ত: পৃ-৪৭৪-৪৭৬)
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরবর্তী অবস্থা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতির উল্লেখ করে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী (র) লিখেনঃ
“খোলাফায়ে রাশেদাগণ একদিকে সমকালীন শাসকও ছিলেন, পাশাপাশি নবী-প্রতিনিধি বিশেষজ্ঞ আলেম ছিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি তৃতীয় শতাব্দী পেরিয়ে সম্মুখপানে এগুতে থাকলো তখন রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ এমনসব লোকদের হস্তগত হলো যারা জাগতিক বিষয়াদিতে অবশ্য অভিজ্ঞ ছিলেন কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান-বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। যে-কারণে শাসকগোষ্ঠির বিচার-ফায়সালা ও ধর্মীয় বিষয়াদি প্রশ্নে আলেম বিচারকদের সহযোগিতা গ্রহণ ব্যতীত বিকল্প ছিল না। তখন জনগণ মনভরে প্রত্যক্ষ করলো, কিভাবে ধর্মবিশেষজ্ঞ আলেম বিচারকগণের সম্মান, মর্যাদা প্রদান করা হচ্ছিল! এমতাবস্থায় কিছুলোক জাগতিক সম্মান-মর্যাদা অর্জনের মানসে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনকারী হয়ে গেল। ফাতওয়া ও ইফতার জ্ঞান অর্জন করে মুফতী পদে আসীন করার জন্য নিজেকে পেশ করতে শুরু করলো। তাঁদের মাঝে কিছু সংখ্যক তা থেকে বঞ্চিত থাকলো এবং কিছুসংখ্যক নিজ মন্দ উদ্দেশ্যে সফল হলো। এরা সরকারের কাছে মাথানত করে নিজেরা হেয় প্রতিপন্নের কাতারে উপনীত হলো। ইতোপূর্বে এঁদেরকে তালাশ করা হতো আর এখন এরা নিজেরা তালাশে জড়িয়ে পড়লো। প্রথমে এঁরা শাসক আমীর থেকে দূরে অবস্থান করে সসম্মানে ছিলেন এখন নিজেরা শাসকদের নৈকট্য অর্জন করে অপমান-অমর্যাদা সহ্য করতে লাগলেন। তবে হ্যাঁ কিছুসংখ্যক আলেমগণ ব্যতিক্রম ছিলেন যাঁদের মহান আল্লাহ তেমন সংশ্রব থেকে রক্ষা করেছেন।”
সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু শাসক-বাদশাহ্র জন্ম হলো যারা বাহাস-বিতর্ক ও মুনাজারায় উৎসাহী হয়ে উঠলেন এবং চারদিক থেকে মুনাজারা বিষয়াদি ও তার পন্থা-পদ্ধতি বিষয়ে বই-পুস্তক সংকলিত হতে থাকলো। স্বল্প যোগ্যতাধারী লোকজনও মাছআলা-বিধানে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করলো এবং পক্ষপাতিত্ব, কঠোরতা ও ধ্বংসাতœক বিবাদ-বিসম্বাদের দ্বার উন্মুক্ত হতে শুরু করলো। মুফতী পদ থেকে বিচারক পদে উন্নীত লোকজন শাসক-বাদাশাহদের সন্তুুষ্টি পেতে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পন্থা অনুসন্ধানে প্রয়াস পেলেন। যার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হলোঃ
কোনো প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করলেন, স্ত্রীকে বা গোপনাঙ্গ স্পর্শ করলে উযুর বিধান কি হবে? তখন জবাব পাওয়া গেল, “ইমাম আবূ হানীফা (র)এর মতে, এতে উযু ভঙ্গ হবে না।”
দাবা খেলা বা ঘোড়ার গোশত আহার প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, জবাব দেয়া হতো, “ইমাম শাফেয়ী (র) এর মতে, তা বৈধ।”
বিচারকের বিবেচনা প্রসূত শরীয়তের শাস্তি (তা’যীর) এর সীমা লঙ্ঘন,বাড়াবাড়ি প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, জবাব দেয়া হতো, “ইমাম মালেক (র) এর মতে প্রয়োজনে তা করা যায়।”
ওয়াকফ সম্পদ অলস, আয়হীন পড়ে থাকলে এবং মুতাওয়াল্লী তা আবাদ ও আয় বর্ধক করতে না পারার প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হলে, তার জবাবে ওয়াকফ সম্পদ বিক্রয় করা জায়েয মর্মে ফাতওয়া দেয়া হতো। কারণ, ইমাম মালেক (র) এর মাযহাব মতে তেমনটির সুযোগ আছে। আর এভাবে বছর বছর ধরে ওয়াকফ সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় স্থানান্তরিত হতে লাগলো। অর্থাৎ সর্বত্র কেবল সহজিকরণ এবং দীন-ধর্মের স্বার্থের সার্বিক বিবেচনার পরিবর্তে জনগণের জাগতিক চাহিদা ও সরকারকে সন্তুষ্ট করাই যেন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।