Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গোখলের ঢাকা দর্শনে ‘উপেক্ষিত’ তিস্তার পানি

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে যখন ঢাকায়; তখন নিলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারেজে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে খালেকুজ্জামানের বাসদ। শুকনো তিস্তার বালুর মাঠে হাজারো কণ্ঠে আওয়াজ ওঠে ‘তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই’, ‘ভারতের আগ্রাসী পানি নীতি রুখে দাঁড়াও’। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং ভারতের আগ্রাসী পানি নীতির প্রতিবাদে ঢাকা থেকে তিন দিন আগে রোডমার্চ করে দলটির নেতাকর্মীরা সেখানে যায়। পথে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুরে পথসভায় হাজার হাজার কৃষক জড়ো হয়। ভারতের আগ্রাসী পানি নীতির প্রতিবাদ ও তিস্তার পানির দাবিতে চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ রোডমার্চের খবর দেশের মিডিয়াগুলোতে গুরুত্ব পায়নি। এমনকি টিভির টকশোগুলোতে দেশের বুদ্ধিজীবীরা তিস্তা চুক্তির দাবিতে বাসদের রোডমার্চ নিয়ে কোনো আলোচনার গরজ দেখাননি। বরং ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন এ খবর খুবই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় মিডিয়াগুলোতে। আবার অতিথিকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের রুটিন ওয়ার্ক ও কিছু বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দৌঁড়ঝাপ দেখা যায়। গোখলেকে নিয়ে বৈঠক সেমিনার করা হলো। কিন্তু কোথাও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি নিয়ে আলোচনা হলো না। এমনকি অতিথির সামনে বুদ্ধিজীবীরা ‘তিস্তা চুক্তি’ শব্দটিও উচ্চারণ করার সাহস পেলেন না। প্রশ্ন হলো দেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা দিল্লীকে এতো ভয় করেন কেন? তিস্তার পানি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটি মানুষের জন্য জীবনমরণ সমস্যা। ভারত গজলডোবা পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি তুলে নেয়ায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমি হওয়ার পথে। পানির অভাবে ১২০০ নদী কমে গিয়ে ২৩০-এ নেমে এসেছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ ব্যবস্থা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিকল্প সেচ ব্যবস্থাও হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। অথচ লাখ লাখ কৃষকের চাষাবাদ তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। তিস্তায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক না থাকায় দেশের শত শত নদী কোনোটায় হাটু পানি কোনোটা শুকিয়ে গেছে। যে আলোচনা দেশের মানুষের জন্য অপরিহার্য সেটা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব পেল না?
জাতি হিসেবে আমরা অতিথি পরায়ন। অতিথিকে সমাদর করা আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস। ঢাকা সফরে আসা বিজয় কেশব গোখলেকে অভিনন্দন। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তিস্তার পানি নিয়ে কোনো কথা না বললেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এবং সেমিনার সিম্পোজিয়ামে গোখলে যে বক্তৃতা দেন সে জন্য তার সাধুবাদ প্রাপ্য। দিল্লীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নিজের দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দেবেন সেটাই স্বাভাবিক। তিনি দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ‘উইন উইন ফর্মুলা’ শব্দটি ব্যবহার করে বলেছেন এই অঞ্চলে বাংলাদেশ হবে ‘ইকোনমিক পাওয়ার হাউস’। দুই দেশের মধ্যে বর্তমান সরকারের আমলেই ৬৮টি চুক্তি হয়েছে সেটাও তুলে ধরেন। প্রশ্ন হলো দিল্লীর কাছে যেটা ‘উইন উইন ফর্মুলা’ বাংলাদেশ কাছে সেটা কি? এতোগুলো চুক্তি ও সমঝোতায় বাংলাদেশ কি পেয়েছে? ভারতের কোনো মন্ত্রী ও সচিব যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন সাধারণ মানুষ ধরেই নেন দ্বিপাক্ষিক আলোচানায় ঝুলিয়ে থাকা ‘তিস্তা চুক্তি’ প্রাধান্য পাবে। অন্য হাজার বিষয়ে সমঝোতার চেয়ে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বুদ্ধিজীবী মহল গোখলের সঙ্গে বৈঠকে কেউ ‘তিস্তা চুক্তি’ প্রসঙ্গ গুরুত্ব দিলেন না। আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে তিস্তা শব্দটি এসেছে এই আর কি!
গোখলের ঢাকা সফরে ইনস্টিটিউট অব পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (আইপিএজি) সেমিনারের আয়োজন করে। ‘ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক বিষয়ক’ সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, স্ট্যাটেজিক কমিউনিটি ও শিক্ষাবিদরা বক্তৃতা করেন। অধিকাংশ বক্তাই দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রæত সমাধানের তাগিদ দেন। তারা বিনয়ের সুরে বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, ঐতিহাসিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি রক্তের বন্ধন। নিশ্চিতভাবে দু’দেশের সম্পর্ক দিনে দিনে অত্যন্ত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এখন শুধু এগিয়ে চলা’। বক্তাদের কেউ কেউ রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত চুক্তি ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেও তিস্তা পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি বা দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে জোর দিয়ে কথা বলেননি। এমনকি অনেক বক্তা ‘ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই’ প্রবাদের মতোই তিস্তা নদী শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তারা বলেন ‘অমিমাংসিত ইস্যু’। যদিও ওই সেমিনারে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গোখলে প্রণিধানযোগ্য বার্তা দিয়েছেন। দুই দেশের ‘পিপল টু পিপল’ সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বন্ধুত্ব শুধু দুই সরকারের মধ্যে হয় না। এটা হতে হয় জনগণের পর্যায়ে। বাংলাদেশ-ভারত জনগণের পর্যায়ে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
এর আগে রোববার ঢাকায় পৌঁছার পর রাতেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন দেশের ১০ বিশিষ্ট নাগরিক। এই বুদ্ধিজীবীরা কিছুদিন আগে একটি সংগঠনের ব্যানারে ঢাকার রেডিসন হোটেলে দিল্লী ও কোলকাতার কংগ্রেসীয় কিছু বুদ্ধিজীবী নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। ওই সেমিনারে ওবায়দুল কাদের অতিথি ছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের আয়োজিত রাতের বৈঠকে ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। বুদ্ধিজীবীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকা তুলে ধরে দিল্লী প্রশাসনের বাংলাদেশের কোন দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া উচিত সে বয়ান দেন। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে সংক্ষিপ্ত যে বক্তৃতা দেন তা হলো ‘নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’। তার ভাষায় দিল্লীর ক্ষমতায় কংগ্রেস নয় বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর নের্তৃত্বাধীন দলটি নীতি নির্ধারক হলো আরএসএস। তিনি সরকারের কর্মচারী মাত্র। নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যোগদান করে মূলত সৌজন্য সফরে এসেছেন। ওই বৈঠকেও আমাদের বু্িদ্ধজীবীদের কেউ তিস্তার পানি ইস্যু নিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। ডালিয়ায় বাম নেতারা বলেছেন, ‘তিস্তা-পদ্মার পানি প্রবাহের অভাবে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মমতার অজুহাত দিয়ে তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রেখে ভারত অন্যান্য স্বার্থ হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি হবে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা প্রধান নিয়ামক হবে কেন? ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রধান এজেÐা হওয়া উচিত তিস্তা চুক্তি’। অথচ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরে আমাদের আমলা ও বুদ্ধিজীবী মহল তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতেই সাহস করলেন না? এরাই আমাদের বুদ্ধিজীবী এরাই আমাদের আমলা?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানি

২৫ অক্টোবর, ২০২২
২১ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ