Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাণিজ্যের আড়ালে ভারতের ট্রানজিট

চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব ও মংলা বন্দর কব্জায় তোড়জোড়

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভারত থেকে ভারতীয় মালামাল ভারতেই পরিবহন করা হবে। অর্থাৎ ‘টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। যা ভারতের দীর্ঘদিনের চলমান একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পরও এবার একমুখী বাণিজ্য। এমনকি ‘বাণিজ্যে’র আড়ালে ভিন্ন মতলব। স্বার্থ হাসিলের জন্য সমুদ্রবন্দর, যোগাযোগ অবকাঠামোসহ বাংলাদেশের ভূখন্ডকে ভারত ব্যবহার করতে চায় পরিপূরক ও পরিপূর্ণ করিডোর সুবিধায়। কানেকটিভিটি আর ট্রান্সশিপমেন্টের আড়ালে করিডোরের আবদার পূরণ এবং অভিনব কৌশলে একে বহুমুখী কাজে লাগানোই টার্গেট। করিডোর সার্ভিস দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ এবং মংলা বন্দরকে কব্জা করে নিতে নেপথ্যে চলছে তোড়জোড়।
আর চট্টগ্রাম বন্দরের বছর বছর মুনাফালব্ধ নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে সদ্য গড়ে তোলা পায়রা বন্দরকে ‘ডামি পোর্ট’ হিসেবে দেখতে চায় ভারত। কেননা পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত পায়রা প্রকৃতিগতভাবেই বন্দরের উপযোগী নয় এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে ইতোমধ্যেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগামীতে ঢাকা সফরের পূর্বেই চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের ট্রানজিট, সড়ক-মহাসড়ক, রেলওয়ে রুটসমূহকে করিডোর হিসেবে ব্যবহারের সুবিধা পেতে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা (এসওপি) চূড়ান্ত অনুমোদন করাতে চায় নয়াদিল্লী। ভারত থেকে ভারতে পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা ইতোমধ্যে আংশিক চালু করা হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ করিডোর সুবিধায় ‘ভারত টু ভারত’ পণ্যসামগ্রী পরিবহনের ওপরই জোর দিচ্ছে দেশটি। ভারতের বাহ্যিক যুক্তি হলো দীর্ঘ ঘুরপথে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পণ্য পরিবহনে সময় ও আর্থিক অপচয় হচ্ছে।
করিডোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নকশা অনুসারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অভিমুখী বিভিন্ন সড়ক, রেল ও নৌপথ ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের সেই ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’ নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরজন্য ভারত নিজের স্বার্থ পূরণে ‘টোপ’ হিসেবে চড়া সুদসহ কঠিন শর্তে কিঞ্চিৎ ঋণ ‘সুবিধা’ দিচ্ছে। তবে সিংহভাগ ব্যয়ভার বাংলাদেশের। এভাবেই সীমান্ত অভিমুখে নতুন ও পুরনো শাখা রেললাইন, সড়কপথ, ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, আশুগঞ্জ নৌবন্দর সংস্কার এবং স¤প্রসারণের কাজে সহায়তা দিচ্ছে। তবে সেই ‘সহায়তা’ হিসেবে ভারত ঋণের অর্থ ছাড় করছে মর্জিমতো শামুক গতিতে। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) পরিকল্পনায় নির্মাণাধীন জ্বালানি খাতের গুচ্ছপ্রকল্পের (এনার্জি হাব) সঙ্গে বহুমুখী সমুদ্রবন্দর প্রকল্পেও একই কৌশলে বিনিয়োগ ‘সহায়তা’র তোড়জোড় করছে ভারত। এর পেছনে টার্গেট হলো, বঙ্গোপসাগরের কিনারে ভূ-কৌশলগত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অবস্থানে চীন কিংবা অন্যকোন দেশ বিনিয়োগের আগেই যৌথ উদ্যোগে ভারত নিজের মতো করে সমুদ্রবন্দর করতে পারে। চীনা বিনিয়োগে শ্রীলংকায় প্রতিষ্ঠিত হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দরের আদলে ভারত চায় কুতুবদিয়ায় সমুদ্র বন্দর স্থাপনে যুক্ত হতে। যাতে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব আরও জোরদার হয়।
অপরদিকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, দীর্ঘ ঘুরপথে ভারতে মালামাল পরিবহনে অসুবিধা থাকলে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে ভারতের অনীহা কেন? বেশকিছু বাংলাদেশের পণ্যের গুণগত মান ভারতের চেয়ে উন্নত, সুলভ এবং অনেকগুলো রাজ্যের সাধারণ জনগণের মাঝে চাহিদাও আছে। ‘ভারত টু ভারত’ তথা নিজেরই মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে করিডোর, কানেকটিভিটি অথবা ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী কোনো লাভ নেই। বরং বহুমাত্রিক ক্ষতির কারণ হবে। বঙ্গোপসাগরকে ফানেলের মতো ঘেঁষে রেখে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তাছাড়া বাংলাদেশ-ভারত দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ও নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করছে, আসলে ভারত শুধুই নিতে জানে- দিতে নয়। এখন ভারত ঋণ সুবিধা দেয়ার নামে নিজ স্বার্থ হাসিলে আমাদের টাকা দিয়েই করিডোরের উপযোগী করে অবকাঠামো ঠিকঠাক করাতে চায়। ভারতীয় ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। আর করিডোর সর্ভিস আয়ত্তে নেবে ভারত। তদুপরি উভয় বন্দর দেশের আমদানি-রফতানির ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতেই হিমশিম অবস্থায় রয়েছে। দেশের ৯২ শতাংশ রফতানি বাণিজ্যের দ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে বার্ষিক গড়ে ১৪ ভাগ হারে পণ্য হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া সমগ্র দেশের সড়ক-মহাসড়ক, সেতুগুলোর জরাজীর্ণ, নিত্যদিনের যানজটে নাজুকদশা। ভারতের করিডোর মালামাল পরিবহন করতে গেলে সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়বে। কেননা ভারতীয় করিডোর সুবিধার আবদার মেটাতে পলিমাটির এই দেশের রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়ক পণ্যবোঝাই ভারী যানবাহন (হেভি ভেহিক্যালস) চলাচলের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। রেলওয়ে অবকাঠামোও ভারতের মতো উন্নত ও মজবুত নয়।
ইতোমধ্যে ভারতীয় পণ্য বোঝাই কন্টেইনারবাহী ট্রেন বাংলাদেশে চলাচল শুরু হয়ে গেছে। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল (বুধবার) রাতে ভারত থেকে পণ্যভর্তি ৬০টি কন্টেইনার নিয়ে আসা ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে রেলওয়ে স্টেশন সিরাজগঞ্জে এসে পৌঁছায়। পরদিন গত বৃহস্পতিবার রেলপথে আনীত ভারতীয় পণ্য বোঝাই ৬০টি কন্টেইনার খালাস করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কোন পণ্যসামগ্রী রেলপথে কন্টেইনারযোগে ভারতে রফতানি করা সম্ভব হয় না। এরজন্য শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা-বিপত্তির দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছে আগেই।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত চট্টগ্রাম-মংলা বন্দরসহ করিডোর সুবিধা লাভের পর দেশটির বিশেষ করে স্বল্পোন্নত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যে (দি সেভেন সিস্টার) এবং বন্দর-সুবিধাবিহীন (ল্যান্ড লক্ড) প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভূটানেও বাংলাদেশের শতাধিক প্রকারের পণ্যসামগ্রী, সেবাখাতের সুবিশাল যে রফতানি বাজার সম্ভাবনা তা চিরতরে অবসান ঘটবে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কুনমিন, প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুযোগ খুলতে কানেকটিভিটির পথ হয়ে যাবে রুদ্ধ। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম ও মংলা উভয় সমুদ্র বন্দরের ভৌত অবকাঠামো, স্থান সংকুলান, কারিগরি ও যান্ত্রিক অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনের চাহিদা ও চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্দর-শিপিং নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পণ্যসামগ্রী শিপমেন্ট এবং খালাসের ক্ষেত্রে বেসামাল অবস্থা বিরাজ করছে।



 

Show all comments
  • নাজমুল হক ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১:০৮ এএম says : 0
    ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর চায় ১০০% নিজ স্বার্থে। এখানে ০.০০১% ও আমাদের দেশ ও জাতির লাভ নেই। বাংলাদেশকে বিশাল বাজার বানিয়েছে ভারত। তবু আরো চাই, আরো.....এই হলো ভারতের নীতি। আমাদের সেটা বুঝতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • একরাম উদ দৌলা ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১:২৭ এএম says : 0
    ভারত আমদেরকে বোকা বানিয়ে ধোকা দিচ্ছে। আর কিছু আঁতেল ও দালাল দিল্লীর তাঁবেদারী করতে গিয়ে মুখে ফেনা তোলেন। তারা এখন কি বলবেন? ইনকিলাবকে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Hajji Abdul Mabud ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ২:১০ এএম says : 0
    ভারত কেবল নিতে জানন
    Total Reply(0) Reply
  • এম জহিরউদ্দিন চৌধুরী ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:২৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশকে ভারতের জন্য করিডোর দেওয়া মানে খাল কেটে কুমীর আনা। আমাদের সম্পদ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর। একে সুরক্ষিত রাখতে হবে। ট্রানজিট দিয়ে ভারতের কলোনী বানানো যাবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • A K Azad ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৩৮ এএম says : 0
    'To and from India'!!! But what's benefit for Bangladesh? We can't never open transit and corridor for India. Thanks Daily Inqilab for the awareness news for national interest.
    Total Reply(0) Reply
  • রুবেল হোসেন ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৫১ এএম says : 0
    ভারতের আবদার শেষ হবেনা। কিন্তু দিতে দিতে আমরা তো ফতুর হয়ে যাচ্ছে। কই তিস্তার পানি তো পাই না
    Total Reply(0) Reply
  • আকরাম হোসেন ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৯:১৬ এএম says : 0
    দেশবাসী তিস্তা ও অভিন্ন নদ-নদীর পানি চায়। করিডর দেওয়া চলবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • A T M Akber ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৯:৪৫ এএম says : 0
    Corridor and transit for India will bring multiple troubles. Chittagong and Mongla seaports both are necessary for our exports imports. Thanks to Inqilab for the time demanding news.
    Total Reply(0) Reply
  • Syed Nurul Abser ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৯:৫৪ এএম says : 0
    ভারতের কথা হলো চাই আরও চাই। কিন্তু বাংলাদেশ তো দিতে দিতে......। সমগ্র দেশ ভারতীয় পণ্যের বাজার হয়ে গেছে। আরো চাই????
    Total Reply(0) Reply
  • Anwarul Islam ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০২ পিএম says : 0
    তাই‌তো কেউ কেউ ব‌লে, দেশ কে চালায় ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাণিজ্য

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ