পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
“এক মেয়ে, এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে আমার সংসার। বড় মেয়ে কলেজে আর ছোট ছেলেটা স্কুলে যায়। স্বামী স্কুলে পড়ান। আমিও একটা ছোটোখাট স্কুল চালাই, যেখানে শিক্ষকতার মাধ্যমে সংসারে আর্থিকভাবে অবদান রাখার পাশাপাশি আমার গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি।’ নিজের সম্পর্কে বলছিলেন সাভারের বিরুলিয়া গ্রামে বসবাসকারী ফাতেমা বেগম।
“গ্রামে সবাই আমকে ডাকে ‘মাস্টারনি’। গ্রামবাসীরা ভালোই সম্মান দেয় আমাকে। সব মিলিয়ে নিজের গ্রামে আমার ছোট সংসারটা সুখেই কাটছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো তখনই, যখন আমার ছোট ছেলেটা মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলো। সে সুস্থ হতে না হতেই বড় মেয়েটাও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সদরের ক্লিনিকই হয়ে গেল আমার ঘরবাড়ি! অসুস্থ দুই সন্তানকে নিয়ে আমি তখন খুবই অসহায় হয়ে পড়লাম। সন্তানদের অসুখের টেনশন, ক্লিনিক, ডাক্তার আর ওষুধের বিল দিতে গিয়ে আমি আর আমার স্বামী আর্থিকভাবেও অসহায় হয়ে যেতে লাগলাম! সন্তানেরা অনেকদিন অসুখে ভুগে সুস্থ হয়। আমি জানতাম, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। মনে হলো, হয়তো আমি আমার বাড়ির খাবার পানি সঠিকভাবে বিশুদ্ধ করতে পারছি না। তাই পানি পরিশোধনের ক্ষেত্রে আমি আরো সতর্ক হতে লাগলাম। টিউবওয়েলের পানিও ফুটিয়ে ছেঁকে পান করাতে শুরু করলাম আমার পরিবারকে। কিন্তু এত সতর্ক হওয়ার পরও বাচ্চারা কয়েক মাস পর আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ল! আমি পড়ে গেলাম মহা বিপদে। গ্রামের সবার প্রিয় ‘মাস্টারনি’ হয়েও আমি নিজের পরিবারের সমস্যার সমাধান করতে পারছি না, এটা ভেবে আরো কষ্ট হতে থাকে।’ বলতে বলতে মনমরা হয়ে যান ফাতেমা বেগম।
শুধু ফাতেমা বেগমের পরিবার নয়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষগুলোর বেশির ভাগই দূষিত পানি পান এবং এ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হন। অনেক পরিবার তো এই ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনই নন। তারা এখনো মনে করেন, টিউবওয়েলের পানিই বুঝি সবচেয়ে বিশুদ্ধ। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের খাবার পানির উৎস এখনো টিউবওয়েল। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, কলকারখানার বর্জ্য, কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ভ‚গর্ভস্থ পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে, যা কি-না টিউবওয়েলের পানির সাথে উঠে আসে। তাই টিউবওয়েলের পানি পান করা এখন আর নিরাপদ নাও হতে পারে।
‘হাইজিন এবং এনভায়রনমেন্টাল হেলথ’ বিষয়ের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত স্টাডি থেকে জানা যায়, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের স্যানিটারি ইন্সপেকশন গাইডলাইন অনুসারে বাংলাদেশের ৪০টি উপজেলায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬২ শতাংশ টিউবওয়েলের পানি ‘মধ্যম থেকে উচ্চতর’ বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ এসব টিউবওয়েলের পানি দূষিত এবং এই পানি পান করলে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষাকালে এসব টিউবওয়েলের পানি আরো বেশি দূষিত হয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশের কাছে এখনো বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং সঠিক স্যানিটেশন পৌঁছায়নি। তাই ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) কর্তৃক গ্রহণকৃত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬*-এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের জন্য তাদের কাছে স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করা। ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ওয়াটার পিউরিয়ায়ার ব্র্যান্ড পির্ওইট ইউএনডিপি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গ্লোবাল গোল ৬-এর কার্যক্রমের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং সে ভাবেই ইউনিলিভার সাসটেইনেবল লিভিং প্ল্যানের (ইউএসএলপি) কর্মসূচি স্থির করেছে। এই কর্মসূচি উদ্দেশ্য হলো- বাংলাদেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের জন্য তাদের কাছে স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির জোগান নিশ্চিত করা।
ঐওঊঝ-এর ২০১০ সালের সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বাস করে গ্রামাঞ্চলে, যাদের প্রায় ৫.০৮ শতাংশ ডায়রিয়ায়, ২.১৯ শতাংশ আমাশয় এবং ০.৯৭ শতাংশ মানুষ টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। সুতরাং, এসব পানিবাহিত রোগ সম্পর্কে এই মানুষগুলোকে সচেতন করা গেলে এবং এর সমাধানে তাদের সাহায্য করলে তাদের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পির্ওইট এবং এসডিআই যৌথভাবে পরিচালনা করছে মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম, যা প্রধানত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, যারা সবচেয়ে বেশি দূষিত পানি পানের ঝুঁকিতে থাকে, তাদের বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এই মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম সম্পর্কে এসডিআইয়ের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শামসুল হক বলেন, “এসডিআই এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড আয়োজিত একটি অভিনব উদ্যোগ, যা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবন আরো স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সহায়ক হবে এবং এর মাধ্যমে পরবর্তীতে এসব মানুষ তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও আয়ের উন্নতি ঘটিয়ে সার্বিকভাবে নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সক্ষম হবে।”
মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী যে কেউ সুবিধাজনক মাসিক কিস্তিতে পির্ওইট ডিভাইস কেনার সুযোগ পাবেন। প্রতিটি পির্ওইট ক্লাসিক ডিভাইস থেকে একটি পরিবার ১৫০০ লিটার বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি পাবেন। আর এভাবেই পির্ওইটের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চার স্তরের পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে, আর তারা পাবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে পরিচালিত এই মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পির্ওইট ও এসডিআইয়ের সেফ ওয়াটার এজেন্টরা (এসডব্লিউএ) গ্রামাঞ্চলে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রতিটি মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানি পান সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই সাত হাজার পরিবারকে বিশুদ্ধ পানি পান সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। এই প্রোজেক্ট বর্তমানে সাভার এবং ধামরাই এলাকার চারটি গ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ফাতেমা বেগমের পরিবারও মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের সুবিধা নিয়েছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, “একদিন ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্র্যান্ড পির্ওইট এবং সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভসের (এসডিআই) পরিচালিত এক উঠান বৈঠকের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, পরিবেশ দূষণের কারণে পানির অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেছে যে, টিউবওয়েলের পানি বা ফোটানো পানি এখন আর পানের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়। সেখান থেকেই আমি জানতে পারি ‘পির্ওইট’-এর চার স্তর বিশিষ্ট পানি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতির কথা, যা দেয় ফুটানো পানির থেকেও নিরাপদ পানি। তাই মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের কথা জানার পর আমি আর দেরি করিনি। পির্ওইট ডিভাইস আমার পরিবারকে দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি। যার মাধ্যমে আমার সন্তানেরা থাকছে সুস্থ ও নিরাপদ!”
“মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের মাধ্যমে আমি উপকৃত হয়েছি ভীষণভাবে। একজন বেনিফিশিয়ারি হিসেবে এখন আমি আমার গ্রাম এবং পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোতে সবার মধ্যে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করি। অনেকেই এখন মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের সুবিধা নিয়ে কিস্তিতে বাড়িতে আসছেন পির্ওইট ডিভাইস। একইসাথে পরিবারের জন্য আনছেন নিশ্চিত সুরক্ষা।” সন্তুষ্ট মনে বলছিলেন ফাতেমা বেগম।
ফাতেমা বেগমের মতো বহু পরিবার মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের মাধ্যমে শুধু স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে নয়, বরং আর্থিকভাবেও উপকৃত হতে শুরু করেছে। পির্ওইট ওয়াটার পিউরিফায়ার মাত্র ৫০ পয়সা/লিটার হিসেবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা দিতে প্রস্তুত, যা নিঃসন্দেহে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পির্ওইট ডিভাইসের প্রযুক্তি কঠিনতর টঝ ঊচঅ গাইডলাইন মেনে চলে এবং এটি পির্ওইট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ইঈঝওজ-এর উজরঈগ ল্যাব দ্বারা যাচাইকৃত একমাত্র ওয়াটার পিউরিফায়ার, যা নিশ্চিত করে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ প্রতি পানি।
পির্ওইট ও এসডিআই পরিচালিত মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের মাধ্যমে এ দেশে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছে দিয়ে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬ অর্জনে বাংলাদেশ অনেকাংশেই এগিয়ে যাবে বলে প্রতিষ্ঠানদু’টি বিশ্বাস করে।
যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬ অর্জন করা কোনো সরকারি, বেসরকারি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একার পরিচালিত কার্যক্রমের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে পানি সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের সুপরিচিত সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের মতো বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে একত্রে এগিয়ে এলেই কেবলমাত্র বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।