আবার আসব
আমরা ফিরে যাচ্ছি ক্যাম্পে। আবার আসব- আসতে হবে আমাদের। আগে বাড়া- পিছু হঠা- এটাই আমাদের
বর্তমানে যেই মাসটি চলছে সেটি হলো মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। অতএব, এই মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব তথা স্বাধীন অস্তিত্ব স্বাধীন অবয়ব স্বাধীন পথচলা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০১৮ সালটি, বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্ব›েদ্বর বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। ওই দ্ব›দ্বগুলোর সঙ্গে তথা একাধিক দ্ব›েদ্বর সঙ্গে, অবশ্যই অনেককিছু জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মাত্র আঙ্গিক উল্লেখ করছি। এক. আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত। দুই. আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে, আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত। তিন. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্ব›দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। এই কথা খেয়াল রেখেই, আমি দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের প্রসঙ্গে অতি ক্ষুদ্র আলোচনা পরের অনুচ্ছেদগুলোতে করছি।
প্রথমে দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল প্রসঙ্গ। রাজতন্ত্র দূর করার জন্য বহুবছর সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে একটি দল। অতঃপর সাফল্য এসেছে। রাজতন্ত্রবিহীন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি সহায়ক এমন সংবিধান রচনায় সময় নিয়েছে বহুবছর। বিগত বহুমাস যাবত টানাপড়েনের পর, অতি স¤প্রতি একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। নেপাল নামক দেশটির সংবিধানের কয়েকটি বিধান নিয়ে, প্রতিবেশী ভারত বিরূপ মনোভাব ধারণ ও প্রকাশ করে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে নেপালের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হয় ভারতের। ল্যান্ড লকড বা চতুর্দিকে ভূবেষ্টিত পাহাড়ী দেশ নেপাল বিস্তৃতভাবেই নির্ভরশীল ছিল ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের উপর। সেই ভারত নেপালের সীমান্তে অবরোধ করার কারণে, চার মাসের অধিককাল নেপাল অবরুদ্ধ ছিল; শত কষ্ট সত্তে¡ও নেপালী জনগণ ও নেপালী রাজনীতিবিদগণ ভারতীয় এই জিম্মি-নীতির নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। সেইসময় নেপাল নামক দেশটির অভ্যন্তরে, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছিল চরমভাবে; কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কোনো দলই গোপনে ভারতের সঙ্গে আপস করেনি। নতুনভাবে নির্বাচিত এবং ক্ষমতায় যাওয়া সরকারও ভারতের সঙ্গে আপস করেনি। প্রায় শতভাগ ভারতের সাথে বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য নেপাল অতি দ্রæত এবং অতি জোরালো উদ্যোগ নেয় চীনের সাথে রাস্তা খোলার; বাণিজ্যিক রাস্তা খোলার। চীন উদারভাবে এগিয়ে আসে। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশি যেমন ভারত তেমনেই নেপালের উত্তরের প্রতিবেশি চীন। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশির সঙ্গে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল ও সমতল প্রকৃতির। নেপালের উত্তরের প্রতিবেশির সঙ্গে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল নয় এবং অসমতল প্রকৃতির। এই বৈচিত্রের মাঝেই নেপাল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার পন্থা বের করে নেয়।
দ্বিতীয়ত. দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ। আজ থেকে দু’চার সপ্তাহ পূর্বেই দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক নামক গোষ্ঠির অন্যতম সদস্য মালদ্বীপ মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করে। মালদ্বীপের ভেতরে দ্ব›দ্ব হচ্ছে এইরূপ: চলমান ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এবং তার দল ক্ষমতায় থাকতে চায়, সদ্য অতীতে ক্ষমতায় ছিল কিন্তু এখন ক্ষমতা থেকে দূরে এবং দেশ থেকে নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার দল নতুনভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। মালদ্বীপকে তাদের বলয়ে নেয়ার জন্য চীন এবং ভারত উদগ্রীব এবং সক্রিয়। সা¤প্রতিক সংকটে চীন পাশে ছিল; মালদ্বীপের বর্তমান সরকার টিকে যায়।
তৃতীয়ত দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা। শ্রীলংকার উত্তর অঞ্চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিদ্রোহ ছিল। এলটিটিই বা তামিলদের একটি দল যাদের নেতা ছিল প্রভাকরণ; তারা শ্রীলংকা থেকে আলাদা হয়ে নতুন রাষ্ট্র করতে চেয়েছিল। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে, ভারত সরকার ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিরাট দলকে শ্রীলংকায় অবতরণ করিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দিয়েছিল শান্তিরক্ষী বাহিনী। ওই ভারতীয় তথাকথিত শান্তিরক্ষী বাহিনী, শুধু একপক্ষ নয় অনেক পক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে এবং আক্রান্ত হয় এবং বিপর্যস্ত হয়েছিল। অতঃপর ভারত সরকার নীতি বদলিয়েছিল। এলটিটিই বা তামিলদের সশস্ত্র সংগ্রামে সর্বোত সহায়তা দিয়েছে, অবশ্যই গোপনে, ভারত। শ্রীলংকার দক্ষিণ অংশে, চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তায় ভীষণ বড় একটি ডীপ-সী-পোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে এবং তার নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন, আগামী নির্বাচনে, চীনের প্রতি দুর্বল এমন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগণই পুনরায় ক্ষমতায় আসবে শ্রীলংকায়। পাঠক এই কলাম পড়ছেন ২৬ মার্চ ২০১৮ তারিখে; আজ থেকে তিন-চার সপ্তাহ আগে শ্রীলংকায় মুসলমান স¤প্রদায়ের উপরে, উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণের একটি অংশ, কঠোর ও মারাত্মক হামলা শুরু করে। এই ঘটনাকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের সফল প্রক্রিয়ার বাই-প্রোডাক্ট বলে মনে করা হয়; বিদেশি কোনো উস্কানী এই আক্রমণের পেছনে আছে কিনা, সেটা নিয়ে আজকে আলোচনা করছি না।
চতুর্থত. মিয়ানমার প্রসঙ্গ। উপরের তিনটি অনুচ্ছেদে আমি নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার আলোচনা করেছি। এখন কয়েকটি লাইনে মিয়ানমার প্রসঙ্গটি সামনে আনছি। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সেই রাজনীতির প্রভাব আমাদের উপর কী প্রকারের হতে পারে বা হচ্ছে সেটি নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দীর্ঘ আলোচনার বিষয়, কিন্তু এই কলামে অতি সংক্ষিপ্তভাবে করতেই বাধ্য হচ্ছি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে গণতন্ত্রকে স্বাগতম জানিয়ে আলিঙ্গন করলেও, বাস্তবে গ্রহণ করেনি। মিয়ানমারের অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জাতিগোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। ক্ষমতাসীন জাতিগোষ্ঠী এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সামরিক বাহিনী উভয়ে মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমার একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক. তারা একগুঁয়েমির পথ বেছে নেবে, দুই. তারা সামরিক তন্ত্রের পথ বেছে নেবে, তিন. তারা একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করবে হয় থাইল্যান্ডের দিকে অথবা বাংলাদেশের দিকে, চার. তারা নিজেদের দেশের সম্পদকে বিদেশের হাতে উন্মুক্তভাবে ও নিঃশর্তভাবে তুলে দেবে না। পাঁচ. প্রতিবেশি চীন ও ভারতের সঙ্গে যুগপৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে এবং কোনো প্রকারের দ্ব›েদ্বর আবির্ভাব হলে চীনের পক্ষ নেবে। ছয়. অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, তারা চীন এবং ভারত উভয়কেই তাদের ভূখÐ এবং রাখাইন প্রদেশ সংলগ্ন সমুদ্রসীমা ব্যবহারের সুযোগ দেবে। সাত. মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করবে। মন্তব্য: আমি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, নিশ্চিতভাবে জানি না যে, মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিনা বা এই মুহূর্তেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিনা: বাংলাদেশের ভূখÐে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য?
বাংলাদেশের জন্য ২০১৮ সালটি একাধিক আঙ্গিকের দ্ব›েদ্বর বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। কিঞ্চিত আলোচনা উপরের একটি অনুচ্ছেদে করা হয়েছে; বিস্তারিত করা হয়নি। ওই দ্ব›দ্বগুলোর সঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত, আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে, আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্ব›দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। সেজন্যই উপরের কয়েকটি অনুচ্ছেদে নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার নামক চারটি দেশের নাম নিয়ে আলোচনা করলাম।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে, পাঠক অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশ কোনদিকে যাবে বা বাংলাদেশ কোনদিকে যাওয়া উচিত বা বাংলাদেশকে কোনদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এর উত্তরটি সন্ধান করা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। যেহেতু ২০১৮ সালের শেষে বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, সেহেতু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে কি হবে না সেটাও আলোচনার সুযোগ আছে। সেজন্যই এই আলোচনা।
২০১৮ সালের শেষ নাগাদ অথবা ২০১৯ সালের অতি প্রারম্ভে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনেও পরিবর্তন হতে পারে; আবার নাও হতে পারে। একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন হোক, একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন না হোক বরং স্ট্যাটাসকো মেইনটেইন হোক বা বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকুক। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে কোনোটি স্বাভাবিক ও সুখকর ও কোনোটি অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক। বয়সের প্রবীণত্বে এসে, একান্ত কামনা করি যেন অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক পরিবর্তন পরিহার করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষত অনুন্নতদেশের বা কোনো না কোনো সময় ইউরোপীয়নদের কলোনি ছিল এমন দেশের, প্রশাসনে বা রাজনীতিতে পরিবর্তনগুলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বা রাজনীতির পর্যবেক্ষকগণ, অন্তত চারটি শিরোনামের অধীনে ক্যাটাগরাইজ বা পর্যায়ভুক্ত করেন। একটি ক্যাটাগরি হলো ব্যালটের মাধ্যমে তথা মানুষের স্বাভাবিক ভোট প্রদানের মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হলো বুলেটের মাধ্যমে তথা ভায়োলেন্স-এর মাধ্যমে তথা রক্তারক্তির মাধ্যমে। তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো ব্যালটও না বুলেটও না, গণদাবির মুখে তথা গণজাগরণের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। চতুর্থ ক্যাটাগরি হলো বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই দুর্বলতাগুলোকে সংস্কার করে, কাঠামোকে শক্তিশালী করে ব্যালট ও হস্তান্তরের যৌথ প্রক্রিয়ায়, যাকে আমরা বলতে পারি ‘সংস্কার’ ক্যাটাগরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে, প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ টেনে এনে আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশের গত ৪৬ বছরের ইতিহাস থেকেও প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ বা ঘটনার রেফারেন্স টেনে আনা যায়।
২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জীবন গণনা শুরু করলে, এখন বয়স ৪৮ চলছে। প্রথম বছরটি যেহেতু ছিল যুদ্ধ, সেটি বাদ দিলাম। পরের বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করতে করতে বাংলাদেশ আজ একটি অবস্থানে এসেছে। এরকম বলার কোনো অবকাশ নেই যে, বাংলাদেশ উন্নতি করেনি। বলতেই হবে, স্বীকার করতেই হবে যে, বহুবিধ আঙ্গিকে উন্নতি হয়েছে। মাত্র দশদিন আগে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিকে পত্র দিয়ে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করছে। খেলাধুলা, বিজ্ঞান, আইটি বা তথ্য-প্রযুক্তি, বহুবিধ রপ্তানি ইত্যাদি প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতির জন্য ১৯৭২ থেকে নিয়ে আজ অবধি সকল সরকার, আনুপাতিক হারে না হলেও, গড়পড়তায় অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সকলের অবদানেই বাংলাদেশ এই অবস্থায় এসেছে। এটা হলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে। উন্নয়নের অত্যন্ত কঠোর এবং কঠিন সঙ্গী হলো: দুর্নীতি। দুর্নীতিও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কিছু চিত্র নিচে তুলে ধরছি।
আমি গত পাঁচ-সাত বছরের শত সহস্র কোটি কোটি টাকার বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর কথা তুলে ধরছি না। যথা ডেসটিনি নামক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির কেলেঙ্কারি, হলমার্ক গ্রæপের কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রæপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করছি না। অতি সা¤প্রতিক সময়ে, ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার কয়েকটি শিরোনাম, দু’চার লাইন ব্যাখ্যাসহ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। এক নম্বর উদাহরণ। ১০ জানুয়ারি ২০১৮; মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: “সাড়ে আট হাজার ভুয়া পিএইচডি’র তদন্তে দুদক।” অর্থাৎ কিনা প্রাইমারি স্কুলের সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে, অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা, দশম শ্রেণির পর মাধ্যমিক পরীক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণির পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স লেভেল সবকিছুকে ধ্বংস করার পর, শিক্ষা জগতের সম্মানজনক অর্জন পিএইচডিকেও শেষ করা হয়েছে গত নয়-দশ বছরে। পত্রিকার ভাষ্য মোতাবেক প্রায় সাড়ে আট হাজার ব্যক্তি বাংলাদেশে আছেন যাদের পিএইচডি অর্জনটি ছিল ভূয়া বা প্রতারণা। এটা হলো শিক্ষা সেক্টরের তদারকির অমার্জনীয় অদক্ষতার প্রমাণ। দুই নম্বর উদাহরণ। ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৮; মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: “ঋণের টাকায় দানবীর ইউনুস বাদল।” বাদল নামক ব্যক্তিটি জীবন শুরু করেছিলেন বাস চালকের সহকারী হিসেবে। পত্রিকায় ভাষায় ২০১০ সালে তার হাতে আসে আলাদিনের প্রদীপ। ২০১০ থেকে নিয়ে পরের ছয় বছরে একক ব্যবসায়ী হিসেবে জনতা ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গড়ে তোলে এনন টেক্স গ্রæপ। পত্রিকার ভাষায় অনিয়ম করেই তার সকল লোন সংগ্রহ করা হয়েছে। তিন নম্বর উদাহরণ। ১১ মার্চ ২০১৮; বণিক বার্তা নামক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: “আইএফআইসি ব্যাংক: নদী, কবরস্থানের ভূমি বন্ধক রেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ।” আইনানুযায়ী সরকারি খাস জমি, শিকস্তি ও পয়স্তি এবং কবরস্থানের ভূমি জামানত রাখার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও এই ধরনের ভূমি বন্ধক রেখে রাজ হাউজিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। চার নম্বর উদাহরণ। ১ মার্চ ২০১৮; প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: “২৫ শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নেই প্রভাবশালীদের নাম।” বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বহু ঋণ খেলাপি আছেন অর্থাৎ যারা সময়মতো তাদের ঋণ বিভিন্ন কারণে ফেরত দিতে পারেননি। সেখানে দুই লাখ বা পাঁচ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি আছেন, ত্রিশ-চল্লিশ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি আছেন, এক-দুই কোটি টাকার ঋণ খেলাপি আছেন, একশো-দুইশো কোটি টাকার ঋণ খেলাপি আছেন, পাঁচশো বা হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি আছেন, তিন বা চার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি আছেন। যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি তাদেরকে বলা হচ্ছে শীর্ষ খেলাপি। সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সময় শীর্ষ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করেন; এবারও করেছেন। কিন্তু এবারের সেই তালিকায় যারা আসলে শীর্ষ বা বাস্তবিকভাবেই সবচেয়ে বড় খেলাপি, তাদের নাম নেই। এমন কৌশল ব্যাংকের মাধ্যমে অবলম্বন করা হয়েছে যেন তাদের নামগুলো খেলাপিদের তালিকায় জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হয়। পত্রিকার মন্তব্য: মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পুনতফশিল ও পুনর্গঠনের নামে প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। সংবাদের ভাষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-এর (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম-এর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়। মন্তব্যটি নিম্নরূপ: “খেলাপি গ্রাহকদের বিচারে বিশেষ ট্রাইবুনাল করতে হবে। তাদের সম্পত্তি জব্দ করে জেলে পাঠাতে হবে। এসব টাকা সহজে ফেরত আসবে না, কারণ বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতকে দিনে দিনে ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত করে ফেলা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে যে নতুন করে বড় খেলাপি সৃষ্টি হবে না তা বলা যাবে না। পাঁচ নম্বর উদাহরণ। ৩ মার্চ ২০১৮ বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম শিরোনাম: “কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার।” বিভিন্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশের ডলারের দাম বেশি, ক্রমশই বাড়ছে। অপরপক্ষে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের দাম কমছে। সংবাদের ভাষ্যে অর্থনীতিবিদগণকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের কারণ মূলত তিনটি। প্রথম কারণ হচ্ছে দুর্নীতি; দুর্নীতি বেড়েছে বলে অর্থপাচারও বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ, দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা; তৃতীয় কারণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা। এখন আমরা স্বাধীনতা দিবসে, স্বাধীনতার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত একটি শব্দকে নিয়ে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে আলোচনাটা কতদূর যায় দেখি।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখের কথা। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি; গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। তখন, যেই কয়জন নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তারা একত্রিত হয়েছিলেন কলকাতায়। তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (ইংরেজি পরিভাষায় প্রোক্লামেশন অফ ইনডিপেনডেন্স) রচনা, গ্রহণ ও প্রচার করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে যেই তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সাম্য’। এই কলামের উপরের অনুচ্ছেদটিতে, ছয়টি উদাহরণ দিয়েছি যেগুলো অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সাক্ষ্য বহন করে। এখন যেই উদাহরণটি দিচ্ছি তথা সাত নম্বর উদাহরণ, সেটি হলো সাম্যের লংঘন ও সাম্যের সঙ্গে পরিহাসের উদাহরণ। ১২ মার্চ ২০১৮ বণিক বার্তা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: “ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ: ১০ শতাংশের হাতে সবকিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।” পত্রিকার মতে, দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের হাতে, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ জমা হচ্ছে বা জমা আছে। আয় বণ্টন ব্যবস্থার এইরূপ কেন্দ্রীভবনের জন্য রেন্ট-সিকিং বা লুটপাট ও দুর্নীতির প্রবণতাকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী বা ইউএনডিপি। ইউএনডিপির মতে, আয়ের এতবড় অংশ কীভাবে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হলো, তা বুঝতে হলে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ ফেরত না দেয়ার ঘটনাগুলো জানতে হবে ও বুঝতে হবে, পুঁজিবাজারে কারসাজি করে অবিশ্বাস্য রকমের লাভ সংগ্রহ করার পদ্ধতি এবং সেই লাভের টাকার গন্তব্যস্থল জানতে হবে ও বুঝতে হবে, কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাগুলো জানতে হবে ও বুঝতে হবে, সরকারি কেনাকাটা ও সরকারি ব্যয়ে যেই দুর্নীতি করা হয় এবং সেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকাগুলোর গন্তব্য পথ জানতে হবে ও বুঝতে হবে এবং সর্বোপরি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ভূমি দখলের ঘটনাগুলো জানতে হবে ও বুঝতে হবে। ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, গত ছয় বছরে দেশের জনগণের মধ্যে আয়ের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে অনেক প্রকট হয়ে উঠেছে।
স্বাধীনতা দিবসে আমাদের প্রত্যয় এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। এই অবস্থা বলতে কী বুঝালাম? এই অবস্থা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, শুধু আজকের কলামে উল্লিখিত দুর্নীতির অবস্থা নয়। দেশের গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে সেটাকেও বোঝাতে চাচ্ছি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের একজন যোদ্ধা হিসেবে, আমার আবেগ আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। তাই আবেদন করছি এবং প্রত্যয় ঘোষণা করছি আসুন এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করি। যা-ই কিছু করি না কেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ এবং প্রশ্নাতীত রাখতেই হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।